বিয়ে আর প্রেম-৩
সারা পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখলে প্রেম, বিয়ে আর লোক কমে যাওয়ার সমস্যা সভ্যতার বিচারে তথাকথিত পিছিয়ে থাকা আফ্রিকা ও এশিয়ার গরীব দেশগুলোতে নেই বললেই চলে। ব্যাপারটি তীব্র ইউরোপের সর্বত্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ইরান ও চীনে। ভারতবর্ষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়ের হিসেবে পিছিয়ে থাকা প্রদেশগুলি যেমন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে জনসঙ্কোচন ও বিবাহবিরাগ সবচেয়ে কম। সেগুলি প্রকট এগিয়ে থাকা প্রদেশগুলিতে, যেমন কেরালা, দক্ষিণের সব রাজ্য, লাক্ষাদ্বীপ, আসাম বা পশ্চিমবঙ্গে।
আদিবাসীদের মধ্যে, আফগানিস্তানে বা আফ্রিকায় এসব সমস্যা প্রায় ধর্তব্যের মধ্যে আসে না, তাই প্রশ্ন উঠছে, প্রেম বা বিয়ের সমস্যা কি আসলে সভ্যতার সঙ্কট?
হয়তো তাই, কারণ সভ্যতার স্তর, শারীরিক বা আর্থিক স্তরে যারা দুর্বল তাঁদের জীবনযাত্রা সুগম করার জন্য সমাজ কতটা করেছে তার ওপর নির্ভর করে। মেয়েদের শিক্ষা ও তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলা তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু, মেয়েদের শিক্ষা বিস্তার যত ঘটে ততই বাড়তে থাকে তাদের বিয়ের গড় বয়স আর কমতে থাকে শিশুজন্মের হার। মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হলে বিয়ের বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে একা থাকার প্রবণতাও বাড়ে। এ জন্য অনেকে মেয়েদের দায়ী করেন; কিন্তু, আসল কারণ সন্তানজন্মের জন্য ভাল সময় আর উচ্চশিক্ষা আর কেরিয়ারের ভাল সময়ের সাথে সংঘাত (২৪ থেকে ৩০ বছর)। একটি অতি কুশলী মেয়ে যৌবনের ঐ সময়টির দু’চার বছর বাচ্চা সামলিয়ে দেখে রিসার্চে কোন ভাল সুপারভাইজার তাকে নিতে চান না অথবা পেশাদার জীবনে তার সমসাময়িক পুরুষ সহকর্মীটি তার ধরাছোঁয়ার বাইরে এগিয়ে গিয়েছে। অফিসের বাইরে এই সময়টি তার পুরো পেশাদার জীবনে গ্রহণের মত লেগে থাকে, তাকে উঠতে দেয় না। বাচ্চা থাকলে সমস্যা, না থাকলেও যে কোন সময় হতে পারে ভেবে অল্প বয়সী মেয়েদের কোন বড় প্রজেক্ট দেওয়া হয় না। সে জন্যই আজকের আমেরিকার বড় কোম্পানিগুলির কর্পোরেট বোর্ডে মেয়েদের উপস্থিতি মাত্র ১১-১২%। ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে দেখছি মেয়েদের জন্য রিজার্ভেশন চালু করার পরেও ভারতের কর্পোরেট বোর্ডে মহিলাদের উপস্থিতি ২৪%-এর ওপর উঠতে পারে নি (লাইফ সাইন্স সেক্টর)।
পুরুষরাও সমস্যা মুক্ত নন। চীনে এক বিশাল সংখ্যক পুরুষ আর্থিক কারণে বিয়ে করতে পারে না। ১৯৮০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এক সন্তান নীতির ফলে ভারতের মতই পুত্রসন্তানের প্রতি ঝুঁকে থাকা চৈনিক সমাজে ছেলে জন্মিয়েছে বেশি, তাই যোগ্য পাত্রীর জন্য বিশাল অঙ্কের পণ দিতে হয় পাত্রপক্ষকে । আর চোখের মণি একমাত্র সন্তানদের নিজের মধ্যে জগৎ গড়ে নেবার প্রবণতাও অপরিচিত কাউকে অন্তঃস্থলে প্রবেশাধিকার দিতে চায় না।
অন্য দিক থেকে দেখছি, চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরেও মনের শুদ্ধিকরণ বাকি থেকে যাওয়ায় ও দেশের অনেক যোগ্য পাত্র চান তাঁদের স্ত্রীরা গৃহবাসী হয়ে সন্তান প্রতিপালন করুক। মেয়েদের শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ায় তারা এরকম অসহায় করে দেওয়া ব্যবস্থায় রাজি হলে পরে কি হতে পারে তা জানেন। আমার পরিচিতা এক জার্মান অধ্যাপিকা দু’বছর আগে বলেন, তাঁর দুই পড়াশোনায় ভাল বান্ধবী স্বামীদের কথায় বা মাতৃভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে গৃহাগতা হওয়ার বেশ কিছু পরে হঠাৎ তাঁদের স্বামীরা ধরেন বিবাহবিচ্ছেদের রাস্তা।
ভদ্র হওয়া সবসময় সমাজের পক্ষে সুফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। যাঁরা পুতুল নিয়ে সংসার পেতেছেন, তাঁদের অনেকেই খুব ভদ্র, অন্যদের বিরক্ত করতে চান না। ভদ্রতার চরম অবস্থা দেখা যায় একদা যুদ্ধবাজ ভাইকিংদের বাসস্থান উত্তর ইউরোপে। সেখানকার দেশ ফিনল্যান্ড বা আইসল্যান্ডে ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় সমতা আনার জন্য মেয়েদের পুরুষসুলভ শারীরিক ও মানসিক উগ্রতা ও ছেলেদের নারীসুলভ নমনীয়তা শেখানোর ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রেমের প্রথম ধাপ ‘আজকে তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে’ বললে যদি কারো আঘাত লাগে, তাই বলা হয়ে উঠছে না। বাইরে থেকে এক ভদ্রমহিলা ওখানে চাকরি করতে গিয়ে ভদ্রতার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
সভ্যতা ব্যাপারটিই ঠিক প্রাকৃতিক নয়। মাতৃত্ব প্রকৃতির সিলমোহর দেওয়া সম্পর্ক, পিতৃত্ব (ডিএনএ টেস্ট না করলে) প্রকৃতির কাছে ভাসমান একটি ব্যাপার। সে কারণেই অনেক জায়গাতেই পরিবার মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সেই ব্যবস্থা ঠেলে সরিয়ে পিতৃতান্ত্রিকতাও পরিষ্কারভাবে অপ্রাকৃতিক। সোজা কথাটা হ’ল, শিকারী- যোগাড়ি (হান্টার-গ্যাদারার)-র ইন্দ্রিয়নির্ভর স্তর থেকে উঠে কেতাবি শিক্ষা- বিশেষতঃ স্ত্রী-শিক্ষা, বিজ্ঞানী হয়ে ল্যাবরেটরিতে সন্তান প্রজনন এসব কাজ প্রকৃতিবিরোধী। খুব বেশী এগিয়ে যাওয়ার জন্য লাইফস্টাইল ডিজিজ-এর পাশাপাশি প্রজাতিরক্ষার বিড়ম্বনাও আপনা থেকেই জন্ম নিয়েছে। সন্তান যদি ল্যাবে জন্মায় আর বাড়িতে থাকে কথা বলা, সেবা করার হিউম্যানয়েড রোবট, তাহলে মানুষ প্রেম বা বিয়ের ঝামেলায় যেতে চাইবে কেন?
সমাজবদ্ধ হওয়া, পরিবার প্রতিপালন- এসবই একটি আস্থার পরিমণ্ডল তৈরি করে। এখন প্রতিটি সভ্য দেশ সেই কাজটাই করতে চেষ্টা করে, তাই মানুষ একলা থাকার দিকে যাচ্ছে। এই অবধারিত প্রবণতা থেকে বাঁচার উপায় দু’টি।
১। সব দেশ থেকে শিক্ষাদীক্ষা, বিশেষতঃ স্ত্রীশিক্ষা, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি তুলে দিয়ে তাদের আফগানিস্তান, কঙ্গো বা সোমালিয়া বানিয়ে দেওয়া (তাদের ধারে-কাছে এসব সমস্যা নেই)।
২। বিজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষা, রোবোটিকস নিয়ে কাজ করতে করতে তাদের প্রভাবে মানবপ্রজাতির নানা নতুন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবা। মানুষের মগজ অতীতে অনেক সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে, এবারও পারবে এই বিশ্বাস রাখা।
বিজ্ঞানী এডিসনকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কী করে মানুষের জন্য এত কাজ করলেন। ‘শুধু ধৈর্যের সাথে চিন্তা করে।‘-এডিসনের উত্তর। আর একজন বলেছিলেন, ‘পথে বাধাই যদি না আসে মানুষ তার অত বড় সৃষ্টিশীল মগজ নিয়ে করবেটা কি?’
ম্যাক্সিম গোরকি লিখেছিলেন, ‘মা-নু-ষ’ শব্দটার মধ্যে কত দৃপ্ত বিশ্বাস লুকোনো।’ সজনিকান্ত দাসের উচ্চারণ শুনি, জয় হোক মানুষের, ঐ নবজাতকের, ঐ চিরজীবিতের।’ আর শুনি রবীন্দ্রনাথের মঞ্জুভাষ-“আমি কান পেতে রই।”
মানুষের যাত্রা শুভ আর বিস্ময়কর হোক।
১০ই মার্চ, ২০২৪ -অরিজিৎ চৌধুরী
তথ্যসূত্র
Women’s representation on Indian Boards has tripled in 10 years: EY Report
Japan
https://youtu.be/ihuv9o04afA?si=yxXFQx6wK8bU1tXR
China 1
https://youtu.be/T0wgBREqV8g?si=T0g-CkSXSBMhzKu7
China 1 2
https://youtu.be/7dlxAkSjFfU?si=HMQsPBlv7emd_nJi
Iceland school
https://youtu.be/itm3x1YYEZ0?si=SssyRjIMJ5hWR7zQ
About the author
Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change, and fast-depleting groundwater reserves. Traveling, reading, writing articles, composing rhymes, and recitation are his hobbies.