অমৃতা প্রীতম – ইমরোজ ও সাহির লুধিয়ানভী
অমিত সেনগুপ্ত
লেখার কথা ছিল বিখ্যাত পাঞ্জাবী লেখিকা অমৃতা প্রীতমের বর্ণাঢ্য জীবনে প্রেম নিয়ে, যিনি বিবাহিতা হয়েও তখনকার সামাজিক বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে দুজনকে, ইমরোজ ও সাহির লুধিয়ানভী, শুধু ভালবেসেছেন তাই নয়, তাঁদের নিয়ে খোলাখুলি ভাবে লিখেছেন। এক্ষেত্রে কিছু লিখতে গেলে তিনজনের কথাই এসে যায়। এই লেখাটার তাই চারটে ভাগ।
- অমৃতা প্রীতমের পরিচিতি, খ্যাতি, সামাজিক অবস্থান, সাহির ও ইমরোজের প্রাথমিক পরিচিতি
- ইমরোজ ও অমৃতা এবং তাঁদের গভীর সহবাস
- সাহির ও অমৃতা এবং তাঁদের সৃষ্টিশীল কিন্তু পরিণতিবিহীন সম্পর্ক
- চিরপ্রেমিক সাহিরের অন্যান্য প্রেম
অসাধারণ অমৃতার কথা
বিংশ শতাব্দীর পাঞ্জাবী সাহিত্যের সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা কবি হলেন অমৃতা প্রীতম, যাঁর কলম প্রায় ষাট বছর ধরে সক্রিয় ছিল, লিখে গেছেন শতাধিক বই – কবিতা, গল্প, জীবনী, প্রবন্ধ, পাঞ্জাবী লোকগীতির সংকলন – কত বিষয় নিয়ে তাঁর কাজ। অমৃতাকে ধরা হয় পাঞ্জাবী সাহিত্যের এক সুদৃঢ় অকুতোভয় নারীকন্ঠ। ১৯৫৬ সালে তাঁর ‘সুনেহ্রে’ কবিতার বইয়ের জন্যে তিনি পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার আর একই বছরে লাভ করেন আকাদেমির ফেলোশিপ। ১৯৬৯ সালে পান পদ্মশ্রী, ২০০৪ সালে পদ্মবিভূষণ, ১৯৮২ সালে তাঁর ‘কাগজ তে ক্যানভাস’য়ের জন্যে পান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।
কথায় বলে লেখকের জীবন অসুখী, অস্থির হলে নাকি সৃজনশীলতার বিকাশ হয়। অমৃতার জীবনে প্রথম ট্রাজেডি নেমে আসে অতি অল্প বয়সে। তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা শহরে। মা রাজ বিবি স্কুল শিক্ষিকা, বাবা কর্তার সিং হিতকারী একজন কবি, ব্রজভাষার পণ্ডিত, শিখধর্মের প্রচারক ও একটি পাঞ্জাবী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। মাত্র ১১ বছর বয়েসে দুরারোগ্য রোগে মাকে হারান অমৃতা। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে মায়ের এইভাবে মৃত্যুর পর তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান, এরপর সারাজীবন তিনি ঈশ্বর অবিশ্বাসী থেকে যান।
এই ঘটনার পর তাঁরা লাহোর চলে যান ও সেখানে ১৭ বছর থাকার পর তাঁর ২৮ বছর বয়েসে দেশভাগ হলে চলে আসেন দিল্লী। এত ছোট বয়েসে মাকে হারানো, ছেলেবেলার সব ছেড়ে নতুন শহরে অপরিচিত পরিবেশে জীবন শুরু করা, ওদিকে অতিব্যস্ত বাবা, অমৃতা খুব তাড়াতাড়ি স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন ও ডুব দেন বাবার লাইব্রেরীর বইয়ে। পড়াশুনো চলে, মাত্র ১৬ বছর বয়েসে বেরোয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘অমৃত লেহ্রাঁ’। বাবার ইচ্ছে ছিল মেয়ে ধর্মের কবিতা লিখুক, কিন্তু অত্যন্ত স্বাধীনচেতা অমৃতা লিখে চললেন নিজের খুশি মত আর যে ভাষায় তিনি স্বচ্ছন্দ, সেই পাঞ্জাবীতে। মাতৃহারা ১১ বছরের বালিকাটি এখন ১৬ বছরের কিশোরী, এড়ানো গেলনা বাড়ির আর সমাজের চাপ, ইচ্ছে না থাকলেও বিয়ে হয়ে গেল, তখনকার রীতি অনুযায়ী যার সঙ্গে বিয়ে স্থির হয়ে রয়েছিল মাত্র চার বছর বয়েসে, সেই প্রীতম সিংয়ের সঙ্গে। লাহোরের আনারকলি বাজারে প্রীতমদের হোসিয়ারীর দোকান, চালু ব্যবসা।
পুতুলখেলার দিন হল শেষ, শুরু হল মেয়েটির স্ত্রী ও মা হয়ে ওঠার জীবন। তার মধ্যেও ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত হল আরও পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। তার সঙ্গে চলছিল লাহোর রেডিয়োতে কবিতা পড়া, এটা আবার প্রীতমের একেবারে না-পসন্দ। “তুমি ওই রেডিয়োতে বকবক করে যা পাও, ওই অর্থ আমি তোমাকে প্রতি মাসে দেব, ওসব তুমি ছেড়ে দাও।” অমৃতা রাজী নন। তিনি তো ওই কাজটা পয়সার জন্যে করেন না, যে প্রশংসা তিনি পান, যে পরিচিতি হয়ে চলেছে, সেটার দাম তাঁর কাছে অনেক বেশি। শুরু করেছিলেন রোম্যান্টিক কবি হিসেবে, এবার বদলাতে লাগল তাঁর সামাজিক মতাদর্শ। যোগ দিলেন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে, এর ছাপ পড়ল তাঁর লেখায়, লিখলেন ‘লোকপীড়’, ১৯৪৪ সালে, যা তুলে ধরল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গরীবদের দুরবস্থা, ১৯৪৩ এর বাংলার মন্বন্তরের চিত্র।
দেশভাগের মর্মান্তিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আবার তাঁর লেখার মোড় ঘুরলো। সপরিবারে লাহোরের সব ছেড়ে দিল্লী পালানো, যা দেখেছেন, যা শুনেছেন তাঁর ভিত্তিতে রচিত হল তাঁর বিখ্যাত শোকগাথা, ‘আজ্জ আখান ওয়ারিশ শাহ নু’, যা তাঁকে সাহিত্যের আঙ্গিনায় এক চিরন্তন প্রতিষ্ঠা দিল, কবিতাটি হয়ে রইলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে দেশভাগের বিভীষিকার এক কাব্যিক দলিল। এটি লেখা হয়েছিল তাঁর দেহ্রাদুন থেকে দিল্লী যাত্রার ট্রেনে বসে। কবিতাটি সূফী কবি ওয়ারিশ শাহকে উদ্দেশ্য করে, যিনি পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন হীর-রাঞ্ঝার অমর প্রেম কাহিনী। তিনিও পাঞ্জাবে অমৃতা’র শহরের লোক ছিলেন।
অমৃতা লিখলেন –
“আজ তোমাকে বলছি ওয়ারিশ শাহ,
চুপ করে থেকো না, কবরে বসে তোমার প্রেম কাহিনীর পাতা ওলটাও।
একদিন এই পাঞ্জাবের এক মেয়ের কান্নায় তুমি লিখেছিলে এই বিশাল কাহিনী
আজ দেখ, লক্ষ লক্ষ মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে তোমায় ডাকছে
জেগে ওঠো ওয়ারিস শাহ, যন্ত্রণার লিপিকার, তোমার পাঞ্জাবের দিকে তাকাও
আর দেখ, মাঠে মাঠে পড়ে আছে লাশ, চেনাব বইছে যেন রক্তনদী…”
দেশভাগ ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়। দেশভাগ কিভাবে ভুক্তভোগী মেয়েদের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করেছে, সেটা ‘পুরো’ নামে এক কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের চোখ দিয়ে দেখার বর্ণনা করেছেন তাঁর ‘পিঞ্জর’ উপন্যাসে। এটি নিয়ে একই নামে ২০০৩ সালে একটি সিনেমা তৈরী হয় ও সেটি সেবছর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পায়। তাঁর আরও কয়েকটি লেখা থেকে সিনেমা হয় যেমন, ‘ধরতি সাগর তে সিপ্পিয়াঁ – কাদম্বরী’, ‘উনাহ দি কহানী – ডাকু’। বহুবছর একটি পাঞ্জাবী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে দেশভাগের পরে তাঁর বেশিরভাগ লেখার ভাষা ছিল হিন্দি। কয়েকটি আত্মজীবনীমূলক লেখার মধ্যে পাই ‘কালা গুলাব (১৯৬৮)’, ‘রসীদী টিকট (১৯৭৬)’ ও ‘অকশরোঁ কে সায়ি (১৯৭৭)’।
অমৃতা প্রীতম ‘পাঞ্জাব রত্তন’ পুরস্কারের প্রথম প্রাপক। পেয়েছেন বুলগেরিয়ার পুরস্কার Vaptsarov (1979), ফ্রান্সের Degree of Officer dens, Ordre des Arts et des Lettres (১৯৮৭)। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ তিনি ছিলেন রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য।
কর্মক্ষেত্রে এত সাফল্য ও সম্মান পেলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল সংঘাতময়। দেশভাগের পর দিল্লী আসার পর অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে (পাঞ্জাবী সার্ভিস) চাকরী নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে স্থিত হচ্ছিলেন জীবনে, কিন্তু তাঁর বিবাহ ১৯৬০ এর পর আর টিকলনা, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেল। এর মূলে নানা কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার সাহির লুধিয়ানভীর প্রতি তাঁর একতরফা প্রবল ভালোবাসা।
সাহিরের সঙ্গে তাঁর প্রেমের গল্পটা ঠিক সাধারণ প্রেমের গল্প নয়। ১৯৪৪ সালে লাহোর ও দিল্লীর মাঝে প্রীতনগর বলে এক শহরে একটি কবি সম্মেলনে (মুশায়েরা) তাঁদের আলাপ হয়। প্রথম দর্শনেই প্রেম, অমৃতার দিক থেকে। তিনি তখন ২৫ বছরের তরুণী। তিনি লিখেছেন অনুষ্ঠান শেষে তিনি যখন লাহোরে ফেরার বাস ধরতে যাচ্ছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে চলেছে সাহিরের ছায়া, তাঁকে আবেষ্টন করে। সাহিরের ব্যাপারে নিজের আত্মজীবনী রসীদী টিকটে তিনি বহু কথা খোলাখুলি লিখে গেছেন। এমনকি কাদম্বিনী নামে একটি পত্রিকার ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন, “সাহির মেরে সার্ত্রে আউর ম্যাঁয় উনকি সীমোন থী।” তাঁদের প্রথম দিকের সম্পর্ক নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “তুম্হারে দরখ্ত কি তহানি কা যো আস্রা মিলা, মেরে টুটে হুয়ে দিল কা পরিন্দা ওহীঁ রুক গয়া (তোমার গাছের ডালে আশ্রয় পেয়ে আমার ভাঙ্গা হৃদয়ের পাখি সেখানেই সারাজীবন থেকে গেল)।”
কিন্তু এই প্রেমের ব্যাপারে অমৃতা যতটা খোলাখুলি, সাহির ততটাই চুপচাপ। অমৃতা বলেছিলেন, “আমাদের এই সম্পর্কে আমারই যত তাগিদ, আমার বই সুনেহ্রেতে সাহিরকে উদ্দেশ্য করে কত কবিতাই না লিখলাম, কিছুই তাঁকে গলাতে পারলোনা। তবে আমার প্রেম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। বইটা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার তো পেল।”
যেদিন অমৃতা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার খবরটা পেলেন, ছুটলেন সাহিরকে ফোন করে সংবাদটা দিতে। ফোন করার জায়গায় দেখলেন পড়ে আছে সেদিনের নতুন ব্লিৎস ম্যাগাজিন আর সেখানে একটি হেডলাইন, “Sahir has found his new love.” খবরটা সাহিরের নতুন প্রেমিকা গায়িকা সুধা মালহোত্রাকে নিয়ে। ফোন নামিয়ে রেখে তখনই বাড়ি চলে গেলেন অমৃতা। পরে তিনি লিখবেন ‘সাত বরষ’ যেটা সাহির ও তাঁর মধ্যে দীর্ঘ সময়ের নীরবতা নিয়ে।
ভেঙ্গে পড়া অমৃতা এবার সঙ্গী ও ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পেলেন চিত্রশিল্পী ও লেখক ইন্দারজিতের মধ্যে, যিনি ইমরোজ নামে পরিচিত। তাঁরা দুজন একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন হাউজ খাসের বাড়িতে। এই রকম বিবাহ বহির্ভূত সহবাস তখনকার দিনে এক অভাবনীয় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, যদিও তাঁদের থাকার ঘর ছিল আলাদা। তাঁদের চল্লিশ বছরের একসঙ্গে থাকা, অমৃতার প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ ইমরোজের আঁকা, পুরো বাড়িতে ইমরোজের আঁকা অমৃতার অজস্র ছবি, এইভাবে চলল তাঁদের জীবন। এঁদের কথা তুলে ধরেছেন উমা ত্রিলোক তাঁর ‘অমৃতা ইমরোজ: এ লাভ স্টোরি’ বইতে। সাহিরের নাগাল পাওয়া যায় না,। তাঁর ভালোবাসা পেতে উন্মুখ অমৃতা, কিন্তু পান না, এদিকে ইমরোজ কিন্তু অমৃতার প্রেমে একনিষ্ঠ। তাঁর জীবনীকার উমা লিখছেন যে ইমরোজের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর জীবনে জমে থাকা দীর্ঘ একাকীত্বের কঠিন বরফ গলাতে লাগলো। বয়েসে প্রায় এক দশকের ছোট ইমরোজ হয়ে দাঁড়ালো তাঁর জীবনের সবকিছু-প্রেমিক, সঙ্গী, গৃহচালক, ড্রাইভার, উপদেষ্টা …। ইমরোজ জানতেন সাহিরকে নিয়ে অমৃতার দুর্বলতা, কিন্তু আরও ভালো করে জানতেন তাঁর নিজের প্রেমের গভীরতা ও জোর, তাই কোনদিন কোন নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নই ছিলোনা তাঁর। বরং পরে সাহির ও ইমরোজ পরস্পরের ভালো বন্ধু হয়ে যান, এমনকি সাহিরের বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকে দেন ইমরোজ।
যদিও চারটে দশক তিনি কাটিয়েছেন ইমরোজের সঙ্গে, সাহিরের সঙ্গে সম্পর্কই ছাপ ফেলেছে তাঁর লেখায়, তাঁর সৃজনশীলতায়। যে সম্পর্ক পূর্ণতা পায়নি, পরিণতি পাবেনা, তার অতৃপ্তি বা অসম্পূর্ণতাই তাঁর লেখায় এমন অভিঘাত সৃষ্টি করেছে যা তৎকালীন সাহিত্য জগতে সাড়া ফেলে দেয়। নিশ্চিত ভাবে কি বলা যায়, তাঁদের মধ্যে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল? অমৃতা লিখেছেন, “কাহিনীর শুরুতে ছিল নৈঃশব্দ্য, আর তার তীব্রতাই বয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত, নীরবে।”
আরেকটা ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন, “পুরুষ এখনো জীবনে সমান তালে পা মিলিয়ে চলা বন্ধনহীন নারীর সঙ্গ বা বন্ধুত্বের স্বাদ পায়নি। দুই সমানাধিকারী স্বাধীন সত্তা হিসেবে নারীপুরুষের মেলামেশাও দেখা যায়না।” তাঁর মুক্ত জীবন যাপন, ধূমপান ইত্যাদি নিয়ে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। ধূমপানের অভ্যেস হয়েছিল কম বয়সে যখন তিনি সাহিরের জন্যে একরকম ঘোরে থাকতেন। সাহির তাঁর সঙ্গে লাহোরে দেখা করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে নীরবে ধূমপান করে যেতেন। সাহির চলে গেলে তাঁর ফেলে যাওয়া আধখাওয়া সিগারেটের টুকরো তুলে নিয়ে টানতেন। “আমাদের ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়, যেন আমাদের নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে, মিশছে আমাদের কবিতার শব্দগুলো,” তিনি লিখেছেন। সাহিরের ফেলে যাওয়া সিগারেটে টান দিয়ে নাকি তিনি সাহিরকে স্পর্শ করার অনুভূতি লাভ করতেন। আরেকটি কবিতায় তিনি লিখছেন, “যন্ত্রণা আমি সিগারেটের ধোঁয়ার মত নিজের ভেতরে টেনে নিই, বাকি পাপ টুস্কি মেরে ছাইয়ের মত ফেলে দিই।” দীর্ঘ সময়ের সঙ্গে প্রথম স্বামী প্রীতম সিংয়ের সাথে সম্পর্ক সহজ হয়ে আসে, প্রীতমের শেষ অবস্থায় তাঁকে প্রতিদিন দেখতে যেতেন, ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে আসতেন, শেষদিন পর্যন্ত।
ঘুমের মধ্যে গভীর শান্তিতে অমৃতা প্রীতম এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান ৩১ অক্টোবর, ২০০৫, সেদিন তাঁর ৮৬ বছরের জন্মদিন। তাঁর শেষ কবিতা ইমরোজকে উদ্দেশ্য করে, ‘ম্যাঁয় তেনুঁ ফির মিলাঙ্গি’ (ইমরোজ পর্বে প্রথম কয়েকটা লাইনের অনুবাদ করা আছে)। মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী কেবল তাঁর সন্তানেরা আর ইমরোজ তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন, কোন ভিড়, কোন বক্তৃতা ছাড়া। দেশের পরবর্তী নারী সাহিত্যিকদের জন্যে অমৃতা তাঁর লেখা আর জীবনদর্শনের মধ্যে রেখে গেলেন এক উত্তরাধিকার যা তাঁদের উদ্বুদ্ধ করবে সামাজিক নির্মাণ ও বাধ্যবাধকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে আর লিখে যেতে যেমন তিনি পেরেছিলেন, অবাধে, অকুতোভয়ে।
অমৃতায় একনিষ্ঠ ইমরোজ
অমৃতা প্রীতম, বিখ্যাত লেখিকা, কবি এবং ইমরোজ, তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী, মনের মানুষ ও একজন চিত্রশিল্পী।
স্টিভ মারাবোলি, বিখ্যাত মোটিভেশানাল বক্তা ও লেখক অন্য কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এই নারীর জীবনযাপন অগ্নিশিখার মত, যেন এক আলোড়নের নৃত্য … দুর্বলচিত্ত পুরুষ চাইবে এ আগুন স্তিমিত হোক, কিন্তু তাঁর প্রাণের সখা আনন্দ পাবেন এই অগ্নিশিখাকে জ্বালিয়ে রাখতে।” সহজ কথায় এটাই ছিল অমৃতার প্রতি ইমরোজের দৃষ্টিভঙ্গি। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা, সমাজের তোয়াক্কা না করা বৈপ্লবিক চিন্তাধারার অমৃতার জীবনে শান্ত, গভীর মানুষ ইমরোজের প্রবেশ। তাঁদের চল্লিশ বছরের সহবাসে প্রধান অঙ্গীকার ছিল অকথিত, অনুচ্চারিত, শর্তবিহীন পারস্পরিক ভালোবাসা।
অমৃতার স্বপ্নের মানুষ – অমৃতার কথায় তাঁর সান্নিধ্যে আসার আগেও ইমরোজ ছিলেন অমৃতার স্বপ্নে। তাঁর আত্মজীবনী “রসীদী টিকট’য়ে অমৃতা লিখেছেন প্রায় বছর কুড়ি ধরে তিনি স্বপ্নে দেখতেন এক পুরুষের সিল্যুয়েট, তাঁর জানালার ধারে বসা, হাতে রঙের তুলি। ইমরোজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি আর এই স্বপ্ন দেখেননি।
অমৃতা তো ইমরোজের মধ্যে পেলেন তাঁর স্বপ্ন-চারণ মানুষ, আর ইমরোজ? তিনি পেলেন তাঁর বিশ্বভুবন, জীবনের অনুপ্রেরণা। প্রায় প্রতিটি ক্যানভাসে তিনি অমৃতাকে এঁকে চলেছেন। তাঁদের হাউজ খাসের বাড়ির লবিতে ছড়িয়ে রঙের বন্যা আর প্রতিটি রঙের ভেতরে একটাই মুখ, অমৃতা – তাঁর প্রেমিকা আর তাঁর চিরন্তন প্রেম।
অমৃতাকে ঘিরে আবর্তিত ইমরোজের সারা জগৎ। অমৃতা যখন তাঁর জীবনে আসেন, অমৃতা বিবাহিতা ও দুই সন্তানের মা, তাছাড়া হাবুডুবু খাচ্ছেন সাহির লুধিয়ানভীর প্রেমে। অমৃতার অসুখী বিবাহের পরিণতি দেখে ইমরোজ কিন্তু তাঁকে কোন বিবাহের শর্ত দেননি। বরং অমৃতার সন্তানদের ‘আমাদের সন্তান’ হিসেবেই দেখেছেন। আজ ৯৬ বছরের ইমরোজ অমৃতার প্রয়াত পুত্র নভ্রাজের স্ত্রী অলকার কাছে মুম্বাইতে থাকেন।
ইমরোজ জানতেন অমৃতা সাহিরকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। একটি ইন্টারভিউতে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে তিনি কোনদিন অমৃতার এই অনুভূতিতে কেন আপত্তি করেননি। দেশভাগের পর যখন অমৃতা দিল্লী চলে আসেন ও অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কাজ নেন, বহু বছর ধরে প্রতিদিন ইমরোজ তাঁর স্কুটারে অমৃতাকে কাজের জায়গায় পৌঁছে দিতেন ও বাড়ি নিয়ে আসতেন। পেছনের সিটে বসে অমৃতা ইমরোজের পিঠে আঁকিবুকি কাটেন বা কিছু লিখে চলেন। একটু চেষ্টা করে ইমরোজ বোঝেন যে অমৃতা বারবার লিখে চলেছেন সাহিরের নাম, কিন্তু তাতে তাঁর কোন অসুবিধে নেই। এতো গভীর ও একনিষ্ঠ ছিল অমৃতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, এসব তাঁর ধর্তব্যের মধ্যেই আসতোনা। জিজ্ঞেস করায় তিনি হেসে উত্তর দিয়েছেন, “তাঁর অনুভব যেমন তাঁর, আমার পিঠটাও তো তাঁর। আমার খারাপ লাগবে কেন?” আজও নবতিপর বৃদ্ধ ইমরোজ বিশ্বাস করেন, যদি কাউকে ভালোবাসো, সেই মানুষটাকে সম্পূর্ণভাবে, সর্বান্তকরণে গ্রহণ কোর। তাঁদের মধ্যে কোনদিন মতবিরোধ হয়নি, মতান্তরও না, অবিশ্বাস্য হলেও এটা ঘটনা। তাঁর মতে, একজন সাচ্চা প্রেমিক কখনো প্রশ্ন করবেনা ‘কেন’, নিঃশর্তে সার্বিকভাবে সে গ্রহণ করে নেবে অন্যজনকে।
তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ, যখন ইমরোজকে ডাকা হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কৃত অমৃতার কবিতার বই ‘সুনেহ্রে’র প্রচ্ছদ করার জন্যে। ইমরোজ তখন নতুন উঠতি চিত্রশিল্পী, কাজ করেন ‘শামা’ বলে এক উর্দু পত্রিকায়। তাঁর মনে আছে তিনি অমৃতা কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই বইয়ের এত প্রেমের কবিতা তিনি কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন? একটু লজ্জা পাওয়া অমৃতার মুখে ছড়িয়ে পড়া লালের আভা তাঁদের দুই হৃদয়কে সারা জীবন রাঙ্গিয়ে রেখে দিল। তারপর তাঁদের দেখা আরো ঘনঘন হতে লাগল। শেষে ইমরোজ ও অমৃতা একসঙ্গে গিয়ে থাকতে লাগলেন হাউজ খাসের বাড়িতে। শুরু হয় তাঁদের প্রেম কাহিনীর এক নতুন অধ্যায়, যা আধুনিক কালের এক ধ্রুপদী প্রেমের আখ্যান হয়ে থাকবে।
ইমরোজ সম্বন্ধে অমৃতা লিখেছিলেন যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায়:
“বাপ, ভাই, বন্ধু, সঙ্গী শব্দগুলো
কোন সম্পর্ক গড়েনি মনে এতদিন
তোমাকে দেখার পর আমার জীবনে
এদের প্রতিটি অক্ষর উজ্জ্বল হয়ে উঠল।”
ইমরোজ নিজের জীবন সমর্পণ করেছিলেন অমৃতাকে। একটাই ইচ্ছে অমৃতার পাশে থাকা, চিরকাল, এবং তাঁর জন্যে করতে হয়েছিল বেশ আত্মত্যাগ। একদিকে অমৃতার খ্যাতি, ব্যস্ততা চড়চড় করে বাড়ছে, ভারতীয় সাহিত্যে তিনি এক অন্যতম স্থান পেতে চলেছেন, ঝুলি ভরে পাচ্ছেন একের পর এক পুরস্কার, আর নানা প্রতিভার অধিকারী ইমরোজ বেছে নিলেন নিঃশব্দ জীবন, অমৃতার ছায়া হয়ে। প্রেম, না সমর্পণ?
তাঁদের সহবাসের কথা সবাই জানত, কিন্তু তাঁরা একে অন্যের নিজস্ব একান্ত আঙ্গিনায় কোন অদরকারী পদক্ষেপ করেননি। অমৃতার ছিল যে কোন সময়ে মনে কিছু এলে লিখতে বসা, হয়তো গভীর রাতে, পাশে নিঃশব্দে এক কাপ গরম চা রেখে নিজের ঘরে চলে যেতেন ইমরোজ।
স্বাধীন জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী অমৃতা তাঁদের বয়েসের পার্থক্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং বলেছিলেন বাইরের জগতের স্বাদ নিন ইমরোজ ও তার পরে নিজের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন, কিন্তু ইমরোজ অনড় ছিলেন যে তাঁর সারাজীবন অমৃতাতেই আবর্তিত হবে। দুনিয়া জানতো অমৃতাকে এক সফল লেখিকা হিসেবে, ইমরোজের কাছে তিনি দুটোই, অসামান্যা নারী ও লেখিকা, এইভাবে তাঁদের জীবন সুখে কেটে যাচ্ছিল। যে অমৃতা রান্নাঘরে ঢুকতেন না, তিনি শিখলেন ইমরোজের জন্যে রুটি বানানো।
একদিন ইমরোজ তাঁর স্টুডিয়োতে, অমৃতা হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর কাছে তিনি কী। একটু হেসে ইমরোজ কোন কথা না বলে একটি তুলিতে এক ফোঁটা লাল রং নিয়ে তাঁর কপালে কেবল একটি টিপ এঁকে দিলেন। তাঁর কাছে অমৃতা ছিলেন প্রেমিকা, এক নারী ও জীবনসঙ্গী। শেষের দিকে যখন অমৃতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সেব্য করেন ইমরোজ। এখনো তিনি মনে করেন না যে অমৃতা নেই। “আছে আমার আশেপাশে, আমি স্পষ্ট অনুভব করি।” তাঁর মৃত্যুর পরে চিত্রশিল্পীও কলম তুলে নিলেন হাতে, প্রকাশিত হল তাঁর কবিতার বই “জশ্ন জারি হ্যায়” (উৎসব চলছেই)”, যা থেকে অমৃতার মৃত্যুর পর তাঁর মানসিকতাটা বোঝা যায়।
“আমি বসে থাকি নিশ্চুপ
আর আমার স্মৃতিও নির্বাক
কেবল হাল্কা ফিসফিস
ভাসে তার অনুভব
ভাসে তার যত শায়েরী …”
মৃত্যুশয্যায় অমৃতার অন্তর্দৃষ্টিতে নিশ্চয় ভেসে উঠছিল তাঁর ফেলে আসা জীবনের ছবি, ইমরোজ, তাঁকে একা ফেলে চলে যাওয়া ইত্যাদি। তাঁর শেষ পাঞ্জাবী কবিতাটা ‘ম্যাঁয় তেনুঁ ফির মিলাঙ্গি’ ছিল ইমরোজকেই উদ্দেশ্য করে, যার প্রথম কয়েকটি লাইনের অনুবাদ:
“তোমার সাথে আবার দেখা হবে
কোথায়? কিভাবে? জানিনা
হয়তো তোমার কল্পনার জগত থেকে
নেমে ছড়িয়ে পড়ব তোমার ক্যানভাসে,
বা তোমার ক্যানভাসের
এক রহস্যময় রেখা হয়ে নির্নিমেষে
তাকিয়ে থাকবো তোমার দিকে।
তোমার সাথে আবার দেখা হবে।“
এই প্রসঙ্গে তাঁদের পরস্পরের চিঠি বা প্রেমপত্রের আদানপ্রদান সম্বন্ধে কিছু না বললে অমৃতা – ইমরোজের প্রেমকাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
“বোম্বে তার শিল্পীকে স্বাগত জানাচ্ছে।” এক লাইনের চিঠি পেলেন ইমরোজ যখন কাজের সূত্রে বোম্বে এলেন। বেশ কয়েকবছর তিনি সেখানে ছিলেনও। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে সরকারী ডাকে পাওয়া হাতে লেখা চিঠি। সেই ক’বছর অজস্র পত্রবিনিময় হয়েছিল তাঁদের। প্রতিদিনের ঘটনা অন্যজনকে না জানালে চলতনা, যদিও চিঠি পৌঁছতে লেগে যেত বেশ কয়েক দিন।
২৪ অক্টোবর, ১৯৫৯ অমৃতার চিঠি পেয়ে ইমরোজ লিখছেন, “আমার দুনিয়া, ভক্ত আমি নতজানু হই, আর তখনই ৯০০ মাইলের মরুভূমি যা আমাদের আলাদা করে রেখেছে, যেন কোথায় মিলিয়ে যায়। আমার ভবিতব্য যেখানে তুমি, কোন দুর্ভাগ্যকে আমি ভয় পাইনা।”
২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬০ অমৃতা চিঠিতে, “যদি ট্রেনে রিজার্ভেশান রিজার্ভেশন না পাও, ফ্লাইট ধরে চলে এস প্লিজ। টাকার জন্যে ভেবোনা, ওটা আমার চিন্তা।”
নানা চিঠিতে নানা রকমের সম্বোধন, বোঝা যায় একে অন্যকে নানা নামে ডাকতেন। অমৃতার নাম দেখি আশি, অমি, অমৃতা, মাজা। ইমরোজ সম্বোধিত ইমা, ইম্মা, ইমওয়া, জীতি ইত্যাদি।
৩ মে ১৯৬০ ইমরোজের চিঠি, “আমার নিয়তি! আমার রাণী! আমি আসছি। এই বৃহস্পতিবার। পাঁচ তারিখ সকাল দশটায় তোমার শহরে পা দেব। তৈরী থেকো আমার সাহিবা। তোমায় নিয়ে আসব আমার কাছে, চিরদিনের জন্যে, সারাজীবন তোমার পাশে থাকার জন্যে। আমার দুপুর বেলা মিশে যাবে তোমার সন্ধ্যেয়, তুমি আরও সুন্দর, মহিমাময়ী হয়ে উঠবে। খালি আর একটা দিন। কেবল একটা দিন। আমাদের সুদীর্ঘ তিন বছরের অপেক্ষা, মনে হয় যেন সারাজীবন।
তোমারই জীতি।”
দুজনের দুই শহরে থাকাকে তাঁরা যেন নির্বাসন মনে করতেন।
২৭ নভেম্বর ১৯৬৭, অমৃতা লিখছেন, “এইখানে দিল্লীতে থেকে মনে হয় আমি তোমার নির্বাসনের এক অঙ্গ – আমার জীতির নির্বাসনের।”
ওদিকে ইমরোজ লিখছেন, “গতকাল আমি খুশি ছিলাম, কিন্তু আজ বড় বিষণ্ণ। মনে হয় সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে যাই, আর কখনো তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমায় ছেড়ে বেঁচে থাকা এক শাস্তি, জীবনে তুমি থাকতে কেন এই শাস্তি পেতে হবে? কাজ করার সময় এক অবসাদ ঘিরে ধরে, কাজ শেষ হয়ে গেলে মনে হয় কেন আমি এখানে? কেন আমি তোমায় ছেড়ে আছি? নিজের ওপর রাগ হয়, ভীষণ রাগ। তোমারই, একান্ত তোমারই …”
১৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬০ অমৃতা লিখছেন, “ক্রুশ্চেভকে লাঞ্চে ডেকেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। আমি গেছিলাম। পন্ডিতজিকে আমার ভালো লাগে। মানবতাবাদী মানুষ। বেশ কিছুক্ষণ আনন্দে ছিলাম, হঠাৎ তোমার না থাকাটা আমাকে চেপে ধরলো, সব কিছু অর্থহীন মনে হতে লাগলো – এই দিনগুলো, প্রতিদিনের রুটিন, সবকিছু।
তোমারই আশি।”
এই চিঠিগুলো এক অন্তর্দৃষ্টি দেয়, সম্পর্ক ও সহমর্মিতাকে বুঝে নিতে। দূরত্ব মাইল-এ , সময়ে, মনে, সব মিলে অধৈর্য করেছে তাঁদের।
অমৃতার ৬ অক্টোবর ১৯৬৮, এই চিঠিটাতে ফুটে উঠেছে – “আসার একটা তারিখ বলো যাতে আমি আমার হাতের আঙ্গুলে দিনগুলো গুনতে পারি। তাতে আমার আঙ্গুলগুলোকেই আমি ভালবাসতে থাকবো।”
অসমাপ্ত প্রেমে সাহির ও অমৃতা
সেই ১৯৪৪ এর প্রথম দেখার কথা আগেই বলেছি। এরপরে চলতে লাগলো তাঁদের পত্রবিনিময়। অন্তর্মুখী ও আদর্শবাদী সাহিরের সঙ্গে বাকপটু সুন্দরী অমৃতার চিঠিপত্রের মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাঁদের সম্পর্ক। সেই চিঠি আজও পাঠকের মনে নাড়া দেয়। প্রেমের আরেকটা সমস্যা হল, অনেক সময়ই গন্তব্যে পৌঁছোবার আগেই দ্বিধা দেখা দেয়, দুজনের যাত্রাপথ আলাদা আলাদা পথে পাড়ি দেয়। এরকম প্রেমের কবি সাহির লিখেছেন –
“ওয়ো আফসানা জিসে আঞ্জাম তক লানা না হো মুমকিন
উসে ইক খুবসুরৎ মূড় দে কর ছোড়না অচ্ছা।”
(গল্পটাকে পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া যখন অসম্ভব,
মোক্ষম এক মোচড় এনে তাকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো)
প্রেম অমর, সীমানায় বাঁধা যায় না, মানে না জাত, ধর্ম, সময়, বয়েস। প্রেমিক চরিত্রের মৃত্যুর পরেও তাঁদের প্রেম অমর হয়ে থাকে। এটা এমন একটা ধারণা বা বিশ্বাস যা আঁকড়ে ধরার লোক (পাঠক) যুগে যুগে উদগ্রীব। কত পুরোন (পুরনো?) শিরিন-ফারহাদ, হীর-রাঞ্ঝা, লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েটের উপাখ্যান, তারা নেই, রয়ে গেছে তাদের প্রেমের গল্প।
আর এই গল্প তো সাহিরের নিজের, প্রেমিকা অমৃতা প্রীতম। লোকে বলে ভিন্ন মানুষের ভিন্ন প্রেমকাহিনী। সাহির অমৃতার প্রেমও সাধারণ গতের বাইরে এক ভিন্ন সুরের গান। অসমাপ্ত প্রেমের এক খাঁটি উদাহরণ, অন্য সবের থেকে আলাদা।
তাঁদের প্রথম দেখা হওয়ার পরের কথা। তখন অমৃতা দিল্লীতে, সাহির লাহোরে। দুজনের মধ্যে আছে পত্রবিনিময়ের সেতু। তাঁদের দুজন থাকেন দূরে, কিন্তু হৃদয় কাছাকাছি, আত্মা একসাথে। চিঠির পাতায় রং ছড়ায়, কখনো উজ্জ্বল, কখনো ফ্যাকাশে, আলো-আঁধারের খেলা চলে। প্রেমের বার্তার যাওয়া আসা চলে দিল্লী লাহোরের মাঝে। অমৃতার চিঠি পড়লে বোঝা যায় তিনি সাহিরের প্রেমে কতটা ডুবে ছিলেন, সম্বোধনে লিখছেন, “মেরা শায়র”, “মেরা মেহবুব”, “মেরা খুদা” কখনো বা “মেরা দেওতা”।
তবে ওপরের শেরটায় ‘না হো মুমকিন’ বললেও সাহিরের সঙ্গে অমৃতার মিলন অসম্ভব ছিলো না। অক্ষয় মনওয়ানী, সাহিরের জীবনীকার (সাহির: আ পিপল্স পোয়েট) লিখেছেন, একমাত্র অমৃতার মতো নারীর পক্ষেই সম্ভব ছিল সাহিরকে বিয়েতে রাজি করানো। একবার সাহির তাঁর মা সর্দার বেগমকে বলেওছিলেন, “ওয়ো অমৃতা প্রীতম থী। ওয়ো আপকি বহু বন সকতি থী (ওই ছিল অমৃতা প্রীতম, যে তোমার পুত্রবধূ হতে পারতো)।”
সাহির যেন খামখেয়ালি কবি। কোন বন্ধনের অঙ্গীকারে তিনি নেই। তাঁদের প্রেম গভীর কিন্তু পরিণতির দিশা নেই। তবু এই দূরত্ব সরিয়ে ফেলার কোন চেষ্টা করেননি সাহির। অনেক চিঠি লিখতেন কিন্তু ওঁদের সাক্ষাৎ হত কদাচিৎ, আর হলেও কথা হত কম, নীরবতাই বেশি। অথচ অমৃতাকে মনে রেখে অনেক কবিতা, গান, গজল লিখেছেন সাহির। অন্যদিকে এই প্রেমের ব্যাপারে অমৃতার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ অনেক খোলাখুলি ভাবে তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। তাঁদের প্রেমের পথে নানা বাধাও এসেছিল। যেমন প্রথমদিকে দুজনেই লাহোরে থাকতেন, তারপর দেশভাগ হল। অমৃতা তাঁর পরিবারের সঙ্গে চলে এলেন দিল্লী, সাহিরের ঠিকানা হল বোম্বে (মুম্বাই)। এই দূরত্বের ব্যবধান ঘোচাতে অমৃতা তাঁর সংসার ছেড়ে বোম্বে চলে আসতে চেয়েছিলেন শুধু সাহিরের কাছে থাকার জন্যে। পরে যদিও তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হবে। কিন্তু তখন তিনি তৈরী ছিলেন পেছনে ফেলে আসতে দিল্লীতে তাঁর প্রতিষ্ঠা, সম্মান, খ্যাতি, সাহিত্যিক পরিচিতি – সব। আর সাহিরকে নিয়ে সেই সময় তাঁর এই উন্মাদনার কথা তিনি খোলাখুলি ভাবেই লিখে গেছেন আত্মজীবনী ‘রসীদী টিকট’-এ।
কিন্তু সাহিরের না নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোন দৃঢ়তা ছিল, না ছিল তাঁদের দুজনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন ধারণা। আবার সাহির অমৃতাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন বলেও জানা যায়না। অমৃতার প্রতি তাঁর ভালোবাসা হয়তো তাঁকে কেবল কিছু অসামান্য রোম্যান্টিক কবিতা লেখার প্রেরণা যুগিয়েছিল। কারণ সাহির বিখ্যাত ছিলেন তাঁর সামাজিক সমালোচনা ও রাজনৈতিক আদর্শের কবিতার জন্য, রোমান্সের জায়গা ছিল পেছনের সারিতে। তবু অমৃতার সঙ্গে তাঁর এই পরিণতিবিহীন অসমাপ্ত প্রেম তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল “মেহফিল সে উঠ যানে ওয়ালো” – (চলচ্চিত্র – দূজ কা চাঁদ, ১৯৬৪) ও অন্যান্য প্রেমের কবিতা লিখতে।
অক্ষয় মনওয়ানী জানাচ্ছেন, এই গানটার পেছনে ছিল অনেকদিনের পরে (১৯৬৪) অমৃতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ, যখন অমৃতা তাঁর সঙ্গী ইমরোজকে নিয়ে মুম্বাই এসে সাহিরের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করেন। অমৃতার সঙ্গে আরেকজনকে দেখে তাঁর কলমে বেরোয় –
“মেহফিল সে উঠ যানে ওয়ালো,
তুম লোগোঁ পর ক্যা ইলজাম
তুম আবাদ ঘরোঁ কে ওয়াসী
ম্যাঁয় আওয়ারা আউর বদনাম।”
(এই আসর ছেড়ে যারা উঠে যাচ্ছ তোমাদের আর দোষ কী দিই,
বড়ঘরের বাসিন্দা তোমরা আর আমি এক বদনামী ছন্নছাড়া)
এখানে অমৃতার সঙ্গে সম্পর্কে সাহির নিজেকে বেশ ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে দেখাচ্ছেন কিন্তু তাঁদের প্রেম থেমে গিয়েছিল তার চার বছর আগেই যখন সাহির বিখ্যাত গায়িকা সুধা মালহোত্রার প্রেমে পড়েছিলেন (১৯৬০)। অমৃতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শেষে এব্যাপারে তাঁর মনোভাব জানা খুব দুষ্কর কারণ মানুষ হিসেবে সাহির ছিলেন খুবই চাপা ও মিতভাষী। মহিলাদের প্রেমে আকর্ষিত হয়েছেন বারবার কিন্তু কারো কাছে নিজের কথা কখনো খুলে বলতে পারেন নি। নিজের কথা, কোন ব্যাপারে নিজের মত, প্রতিক্রিয়া এসবের বহিঃপ্রকাশ তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেত না। সাহিরের জীবনের নানা মহিলা ও তাঁদের সঙ্গে সাহিরের প্রেম একটি আলাদা পরিচ্ছেদ দাবী করে, অমৃতা পর্ব থেকে আলাদা করে যেটা সবশেষে দেওয়া হল।
যেমন একবার, তাঁদের সম্পর্ক যখন পুরোদমে, অমৃতা একটি ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশ করলেন, যেই গল্পগুলো ছিল তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎকে নিয়ে। অনেকদিন সাহিরের থেকে কোন খবর আসছিল না তাই অমৃতা ভেবেছিলেন তাঁর গল্পের নিশ্চয়ই কোন পাঠ প্রতিক্রিয়া আসবে সাহিরের থেকে। কোথায় কী? না সাহির তাঁদের বন্ধুমহলে কিছু বললেন, না লিখলেন অমৃতাকে কিছু। অনেকদিন পরে, তিনি অমৃতাকে একান্তে বলেছিলেন বইটা তাঁর ভালো লেগেছিল কিন্তু তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেননি পাছে বন্ধুমহলে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি হয়।
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে মেয়েদের প্রতি সাহিরের এইরকম মনোভাব বা ব্যবহার এসেছে তাঁর মায়ের জন্যে। তাঁর মা ছিলেন কর্তৃত্বময়ী ও স্বামীকে ছেড়ে এসে সাহিরকে একা মানুষ করেছিলেন বলে সাহিরের জীবনে তাঁর আধিপত্য ছিল অত্যন্ত বেশি। চলচ্চিত্রনির্মাতা বিনয় শুক্লা, সাহিরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সিনেমাতে গীতরচনার কাজ করেছিলেন। তাঁর মতে কেন সাহিরের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকাদের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হোত না বা পরিণতির দিকে এগোতো না তার প্রধান কারণ তাঁর মায়ের প্রতি সাহিরের এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা। তিনি আরও লিখছেন, “সাহিরের একরকম ঈডিপল (অয়দিপল) বন্ধন ছিল। আমাদের বুঝতে হবে যে ভালোবাসা আর সম্মানের আসনে তিনি নিজের মা’কে রেখেছিলেন, সেখানে অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ বেশিদিন ধরে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। এর মধ্যে অমৃতাই একমাত্র ছিলেন যিনি সাহিরের কাছ থেকে অতোটা মনোযোগ ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন।”
যদিও সুধা মালহোত্রার সঙ্গে সাহিরের নতুন প্রেম তাঁর সঙ্গে অমৃতার সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়েছিল, কিন্তু সেখানেও আরেক ছায়া চোখে পড়ার মতো। পাঞ্জাবী সঙ্গীত পরিচালক জয়দেবের কাছে শোনা সত্তরের দশকের একটি ঘটনার কথা শুক্লা বলেছেন। একদিন জয়দেব সাহিরের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে একটা গানের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন, তাঁর নজরে পড়ে কফি টেবিলের ওপর একটি আ-ধোয়া অপরিষ্কার কাপ। জয়দেব ওই কাপটা পরিষ্কার করার কথা বলতে সাহির বলে উঠলেন, “ওটা ওরকমই থাক। ওটা ধরবেন না। ওই কাপটাতে অমৃতা চা খেয়ে গেছে শেষবার যখন এখানে এসেছিল।”
আত্মজীবনীতে অমৃতা একটা ঘটনার কথা লিখেছেন যখন তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন। সাহির অল্প অসুস্থ, বিছানায় তাঁর পাশে বসে অমৃতা তাঁর বুকে পিঠে ভিক্স মালিশ করে দিচ্ছিলেন। সেই দিন মনে করে অমৃতা লিখলেন, “যদি এই মুহূর্তটাকে সারাজীবন ধরে রাখতে পারতাম!”
অমৃতার সঙ্গে সাহিরের সম্পর্কটার একটা সুখী সমাপ্তি হয়নি, নানাভাবে ওঁদের সম্পর্কটা তখনকার সময়ের হিসেবে সচরাচর রীতির বাইরে ছিল, হয়তো নিষিদ্ধ গণ্ডীতেই পড়ার মত, কিন্তু তার চলাচলও ছিল অন্যরকম, চিঠি আর নির্বাক সাক্ষাতে গড়ে ওঠা। কিন্তু পরিণতিতে না পৌঁছলেও, তাঁদের জীবনের এই পর্ব সেই সময় তাঁদের হৃদয় জুড়ে ছিল, আর থেকে গেছে মানুষের মনে, সাহির তাকে যতই নিভৃতে রাখার চেষ্টা করে থাকুন।
অমৃতা ও সাহিরের পর্বে দেখা যাচ্ছে নিস্তব্ধতাই সাহিরের সিগনেচার ব্যবহার। কিন্তু এও জানা যাচ্ছে সাহিরের জীবনে এসেছিলেন অনেক রমণী। সেখানে সাহিরের চালচলন কেমন ছিল? অল্পবয়সের প্রগলভতা কি তাঁকে প্রভাবিত করেনি?
সাহির স্বপ্নবিলাসী, সাহির অত্যন্ত রোম্যান্টিক, যাঁর চলাচল কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে- কিন্তু কোথাও পৌঁছোন না তিনি। তিনি জীবন আর প্রেমের অর্থ খোঁজেন এই যাত্রাপথেই, কোন অভীষ্ট গন্তব্যে নয়। এই চিন্তার ছাপ পড়েছে তাঁর অনেক কবিতায়, যেখানে তিনি চিরাচরিত প্রেমিক কিন্তু আলাদা তাঁর যাত্রাপথ।
চিরপ্রেমিক সাহির
সাহির নিজের জীবনে ও প্রেমের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ। তাঁর কিছু প্রেমিকারা ছিলেন তাঁর অলীক চিন্তায়, আর কেউ ছিলেন তাঁর বাস্তব জীবনে। এক নিরীহ নিষ্পাপ মানুষের মত তিনি নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন কিন্তু তাকে নিয়ে কি করবেন সেটা জানতেননা। প্রেমের কল্পনাতেই থাকতেন মশগুল, অন্যদিক থেকে একটুকু সাড়া পেলেই সেই খুশির কথা বন্ধুমহলে আলোচনা করতেন।
সাহিরের প্রথম মুগ্ধতা, যেটা প্রেমের দিকে বাঁক নেয়, ছিল লুধিয়ানা গভর্নমেন্ট কলেজে তাঁর সহপাঠী মহিন্দর (প্রেম) চৌধারীর প্রতি। ১৯৩৭ সাল, কলেজে সাহির বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছিলেন, কার্ল মার্ক্সের একনিষ্ঠ পাঠক, স্টুডেন্ট ফেডারেশানের সদস্য, কলেজে ব্রিটিশ বিরোধীতায় সক্রিয়। মহিন্দরের বাবা ছিলেন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা, বাড়িতে সেই রকম আবহাওয়া। মহিন্দরের হয়তো একটা ভালোলাগা ছিল। কিন্তু তাঁদের বাড়ি অত্যন্ত রক্ষণশীল। এদিকে সাহির বন্ধুমহলে জমিয়ে বলতেন নিজের হিরোগিরি ও মহিন্দর তাঁর প্রেমে কতটা মশগুল তার গল্প। কলেজে তাঁর রাজনীতি ও প্রেম নিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, “গায়ে হ্যাঁয় ইস ফাজা মে ওয়াফাওঁ কে রাগ ভি / নগমাত–এ আতিশি সে বাখেরি হ্যাঁয় আগ ভি (এই চার দেওয়ালের মাঝে আমি বিশ্বস্ততার গান যেমন গেয়েছি / আমার গানে বিদ্রোহের আগুনও জ্বালাতে চেয়েছি)।”
একবার লুধিয়ানায় মহিন্দরকে খুঁজে না পেয়ে সাহির হাজির হন তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। তাঁকে দেখে মহিন্দর আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। ভগ্নহৃদয় সাহির ফিরে আসেন। পরে জানতে পারেন মহিন্দর যক্ষ্মায় ভুগছিলেন ও কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। সাহির স্বভাবতই ভেঙ্গে পড়েন। তাঁর শেষকৃত্যের পর সাহির তাঁর উদ্দেশ্যে ‘মরঘট কি সরজমীন’ নামে এক মর্মস্পর্শী কবিতা লেখেন। তার কয়েকটি লাইন –
“মেরে তসব্বুরাত-এ-কুহান কি আমীন হ্যায় তু
মরঘট কি সরজমীন মুকাদ্দাস জমিন হ্যায় তু।”
(আমার চিরপ্রাচীন কল্পনা জগতের অধিকারী তুই
এই শ্মশানের মাটির মতই পবিত্র রয়ে গেলি তুই)
শীতের পর যেমন বসন্ত আসে, মহিন্দরের মৃত্যুর কিছুদিন পর আবার প্রেমে পড়লেন সাহির। সুন্দরী মেয়েটির নাম ঈশার কৌর। খুব চুপচাপ, মেশে না তেমন কারো সঙ্গে। কখনও সাহির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, বিব্রত মেয়েটি চোখ সরিয়ে নেয়। সাহির আবার দেখেছেন মেয়েটির নাম ISHAR আর তাঁর নাম SAHIR একই অক্ষরে তৈরী। মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাতেই হবে।
সাহির কলেজ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, কলেজ ফাংশানে গান গাওয়ার জন্যে ধরে বসলেন ইশারকে। অবাক, লাজুক ঈশার ভালো গায়িকা হলেও এক্ষেত্রে কোনমতেই রাজী হলেননা। তাতে দমে না গিয়ে দিনের পর দিন তাকে ইউনিয়নের কাজে ডাকতে থাকলেন। একসময় ঈশার রাজী হলেন। ইনকার (অস্বীকার) আর ইকরারের (স্বীকার) দূরত্ব ঘুচে গেল, ঈশারের মন বদলাল, তাঁরা আরও কাছাকাছি এলেন। কলেজে ও বাইরে তুমুল চর্চা তখন তাঁদের প্রেমের। ভয় পেয়ে গেলেন ঈশার, সাহির কে বলে দিলেন আর দেখা করবেন না, এড়িয়ে চলতে লাগলেন। এদিকে কলেজের ছুটি পড়ে যাচ্ছে, ঈশারকে কলেজে না পেয়ে সাহির চলে গেলেন মেয়েদের হস্টেলে, ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কথা বলার সময় ধরা পড়লেন, দুজনকেই কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হল। এও শোনা যায় সাহিরের রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ঈশারের মুখ ফিরিয়ে থাকার দিনগুলোয় সাহির লিখেছিলেন ‘কিসি কো উদাস দেখকর’, তার কয়েকটি লাইন –
“তুম্হে উদাস সা পাতা হুঁ ম্যাঁয় কয়ি দিন সে
ন জানে কৌন সে সদমে উঠা রহি হো তুম
ওয়হ শোখিয়াঁ ওয়হ তবস্সুম ওয়হ কহ্কহে ন রহে
হর এক চীজ কো হসরত সে দেখতী হো তুম।”
(তোমায় বড়ই উদাসীন দেখি কিছুদিন ধরে
জানিনা কোন আঘাত সামলে চলেছ তুমি
কই খুনসুটি, মুচকি নয়তো খিলখিল হাসি
সবকিছু যেন বিরক্তিভরে যাচ্ছ দেখে)
কলেজের পর ১৯৪৩ সালে লাহোর চলে যান ও দয়াল সিং কলেজে ফাইনাল ইয়ার বিএ তে ভরতি হন, সেখানে লাহোর স্টুডেন্ট ফেডারেশানের প্রেসিডেন্ট হন ও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিতাড়িত হন। তারপর লাহোরের ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
এরপর ১৯৪৪ থেকে সাহিরের জীবনে অমৃতা প্রীতম অধ্যায়, যা আমরা আগেই দেখেছি।
অমৃতার পরে সাহিরের দেখা খাদিজা মস্তুর নামে এক লেখিকার ও সাহিরের মুগ্ধতা। দেখাশোনা এগিয়ে চলে, সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে, এক সময় ভাবা হয় তাঁদের সম্পর্ক পরিণয়ে সমাপ্তি পূর্ণতা পেতে চলেছে, কিন্তু …, দুই বাড়ির অভিভাবকদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতের অমিল হয় ও তাঁদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
অল্প বয়েসেই কবি হিসেবে সফল সাহির, নাম ছড়াতে থাকে। তখন একবার একটি ফিল্মী পত্রিকায় কভার পেজে মধুবালার একটি ছবি ছাপা হয়, হাতে সাহিরের কবিতার সংকলন ‘তলখিয়াঁ’ (তিক্ততা)। এ দেখেই সাহিরের কল্পনা পাখা মেলল আর মধুবালাকে স্বপ্নে দেখতে লাগলেন। কল্পনায় পাখায় তিনি বিখ্যাত তারকার প্রেমিক। সারা বোম্বে শহরের বন্ধুদের ওই ছবি দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। শোনা যায় নার্গিসকে নিয়ে এরকম সরল আবেগ ছিল তাঁর। লতা মঙ্গেশকর, শাকিলা বানো ভূপালীর ব্যাপারেও দুর্বলতা ছিল তাঁর, কিন্তু এগুলো ছিল নিতান্ত সাময়িক হৃদয়ের ব্যথা।
তাঁর শেষ প্রেম সিনেমার নেপথ্য গায়িকা সুধা মালহোত্রার সঙ্গে। তাঁরা দুজনেই দুজনকে খুবই ভালো বাসতেন কিন্তু এটাও পরিণতিতে পৌঁছল না। বিরাট সামাজিক বাধা তো ছিলই, অন্যদিকে সুধার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, বিয়ের দিনও সবাইকে জানানো হল। ভেঙ্গে পড়লেন সাহির। তখন তাঁর বন্ধুরা তাঁর জন্য এক সন্ধ্যায় এক মেহ্ফিলের আয়োজন করলেন, সুধাকেও আমন্ত্রণ জানানো হল। সুধা এসেছিলেন, যদিও তিনি ভালোভাবেই জানতেন সাহিরের সঙ্গে এই তাঁর শেষবারের মত সময় কাটানো। এই মেহ্ফিলে বন্ধুরা সাহিরের নানা কবিতা পড়লেন। সাহিরকে যখন কবিতা পড়ার জন্যে বলা হল, সাহির তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘খুবসুরৎ মূড়’ বেছে নিলেন, প্রাণ ঢেলে পড়লেন, তার কয়েকটি লাইন –
“তারুফ রোগ হো জায়ে তো উসকা ভুলনা বেহ্তর
তালুক বোঝ বন জায়ে তো উসকা তোড়না অচ্ছা
চলো ইক বার ফির সে আজনবি বন জায়েঁ হম দোনো”
(পরিচিতি যদি সমস্যা হয়ে যায় তাকে ভুলে যাওয়াই ভালো
বন্ধুত্ব যদি বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাকে ভেঙ্গে দেওয়াই ভালো …
তাহলে চলো আমরা আবার পরস্পরের অপরিচিত হয়ে যাই)
সাহিরের পড়া শেষ হল, উপস্থিত সকলের মন ভারী, চোখে মুখে বেদনার ছাপ, কারো চোখের কোণ ভেজা, ঘরময় এক নিস্তব্ধতা। এবার হারমোনিয়াম টেনে নিলেন সুধা মালহোত্রা, বেছে নিলেন তাঁর নিজের গাওয়া সাহিরের একটি জনপ্রিয় মিলনের গান – “মুঝে গলে সে লগা লো, বহুত উদাস হুঁ ম্যাঁয়”। জীবন আর প্রেম ভালোবাসার এত স্বপ্ন, এত অভিলাষ নিয়ে সাহির হয়ে গেলেন সেই সময়ের এক চলমান প্রহেলিকা, আর আজও মানুষের মনে রয়ে গেলেন একই ভাবে। আর রয়ে গেলেন অমৃতার মন আচ্ছন্ন করে। এ কেমন আচ্ছন্নতা ছিল বোঝা যাবে বহু বছর বাদে তাঁর ডায়েরির একটি দিনে একটি লেখা দেখে। ১৯৮৬ সালে ডায়েরীর পাতায় তিনি লিখছেন, “আজ মেরা খুদা মর গয়া”। এই দিনেই ছবছর আগে, ১৯৮০ সালে, সাহির লুধিয়ানভী মারা যান।
তথ্যসূত্রঃ
Rising: 30 Women Who Changed India – Kiran Manral
Amrita Imroz: A Love Story – Uma Trilok
Sahir: A People’s Poet – Akshay Manwani
Rekhta: Various writings of Sahir Ludhianvi
Writings on Sahir – Anisur Rahman
About the author
অমিত সেনগুপ্ত – সারাজীবন ওতপ্রোতভাবে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট জগতে সক্রিয় থেকেও মাঝে মধ্যেই চেষ্টা করে গেছেন সাহিত্য ও নাট্যচর্চার জন্যে সময় বার করার। শেষে অবসর গ্রহণের পরে জড়িয়ে গেলেন ব্যাঙ্গালোরের নিয়মিত ইংরিজি ও কখনও বাংলা নাটকের সঙ্গে। এছাড়া লেখালিখি আবার শুরু হল প্রধানত অনুবাদ সাহিত্যে। আর আছে ঘুরে বেড়ানোর সখ।
অমৃতা প্রীতমের প্রেমকাহিনীতে উজ্জ্বল তাঁর প্রাণশক্তি, প্রতিভা আর সাহস।
১৬ থছর বয়সে বিয়ে, সন্তান। তার পর জীবনে আর কী থাকে? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর জীবনে।
বধিরতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিটোফেন তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, I will take fate by the throat; it shall not wholly overcome me. Oh, it is so beautiful to live — to live a thousand times! I feel that I am not made for a quiet life.
এই অসাধারণ কাহিনীটি পড়তে বসে মনে হল বিটোফেনের কথাগুলি যেন অমৃতারও।
So lovely. Neded time to read completely but interesting. Thanks Amit babu. Thanks to editor Blog too.
Bimal Dey