
ঋতু আসে ঋতু যায়। ছোট থেকে বড় হলাম। বড় থেকে আরো বড়, তারপর বুড়ো। কত কত নববর্ষ পেরিয়ে এলাম। এবছর তো হীরক জয়ন্তী। ষাট বছর তো এক বিরাট ঘটনা। কত কিছু শুনি, এই ষাট বছর বয়েস মানেই নতুন জীবন শুরু, এইসময় হল জীবনের সেকেন্ড ইনিংস খেলার সময় ইত্যাদি। অথচ তেমন কোনো বোধ আমার হয় না। মা তো ষাট পার হবার আগেই চলে গেল। আমার এতদিন মনে হতো আমিও হয়তো ষাটের আগেই চলে যাব। এখন মনে হয়, এই যে বেঁচে আছি, এটা উপুরি পাওনা। চিত্রগুপ্তের খাতায় হয়তো কিছু জমা খরচের হিসেব এখনও বাকি আছে, সেটুকু সম্পূর্ণ না করে তো যাওয়া যাবে না। তাই ইদানিং নতুন করে একটু পড়াশুনা করতে শুরু করেছি, যা কিছু পড়া হয়নি সেগুলো যদি একটু পড়ে নেওয়া যায়। প্রতিদিন ভাবি কী কী কাজ এখনো করতে হবে? কোথায় কোথায় যেতে হবে ইত্যাদি। অথচ রেঁধে খেয়ে আর খাইয়ে, পরিবার পরিজনের দেখাশুনা করার পরে সময় আর বাঁচে না। আজকাল মনে হয়, দিনটা যদি চব্বিশ এর বদলে আটচল্লিশ ঘণ্টার হতো, তাহলে বেশ হতো। আকাঙ্খার তো শেষ নেই এদিকে, ওদিকে শরীরের শক্তি তো আর আগের মতো নেই, তাই সবকিছু যে তড়িঘড়ি সেরে ফেলব, তারও উপায় নেই।
নতুন বছর তো ঘুরে ফিরে আসে, আসে না শুধু হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া দিন আর সময়গুলো। আর আসে না হৃদয়ের সঙ্গে মিশে থাকা, রক্তের সঙ্গে মিলে থাকা, চেনা অচেনা মানুষগুলো। কারা যেন দুর থেকে গেয়ে যায়,
"এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।"
সত্যিই তো, কত মানুষের স্পর্শে এই জীবন পূর্ণ হয়েছে। কত হাসি কান্না স্নেহ ভালবাসা, অবহেলা, অসম্মান আর অনেক আদর পেয়েছি সারাজীবনে। সেই সব আপনজন, যারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার জীবনকে ভরে দিয়েছেন, সব কি আর মনে আছে? নতুন বছর এলে আনন্দ হয় তো ঠিকই কিন্তু কিছু মানুষের কথা এত বেশি করে মনে আসে, তখন দুঃখও হয়।
নববর্ষের প্রাক্কালে কিছু মানুষের কথা বলে যাই, যারা আমার জীবনপথে পাথেয় দিয়ে গেছেন অক্লান্ত ভাবে, আজও তারা আমাকে ভোরবেলার স্নিগ্ধতায়, নিস্তব্ধ দুপুরে, গভীর রাতের একাকীত্বে নিঃশব্দে প্রেরণা দিয়ে যান, আগামী দিনগুলো যেন ঠিকভাবে কাটিয়ে উঠতে পারি।
মেজ জ্যেঠিমাকে বাড়ির বড়রা ডাকতেন বিশু বলে। তার নাম ছিল বিদিশা। আমাদের সবার বিশু জ্যেঠিমা। মেজ জ্যাঠা ছিলেন বিমলেন্দু।
জ্যাঠা প্রায়ই রাতে বাড়ি থাকতেন না। আমি এসব জানতাম না কিছুই, জানার কথাও নয়, মামার বাড়ীতে বড় হয়েছি, বছরে দুবার বাড়ী যেতাম, গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের ভিতরের খবর ওই বয়েসে আমার সঙ্গে কেউ আলোচনা করতো না। বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, মেজ জ্যাঠা যেহেতু পরিবারের জমি জমা দেখাশুনা করতেন, তাই মাঝে মাঝেই দশ পনেরো দিন রাতে বাড়ি আসতেন না। বলা বাহুল্য, তার এই না আসা শুধুমাত্র কাজকর্মের জন্যে নয়, পুরুষ মানুষের বাইরে থাকার অনেক কারণের মধ্যে মহিলা সংসর্গ একটি। জ্যাঠার কোনো নির্দিষ্ট কাউকে কেন্দ্র করে কোনো বন্ধন ছিল না। তাই কেউই জানতো না, তিনি কখন কোথায় আছেন বা থাকতেন। জ্যেঠিমা ছয় সন্তানের জননী। সব জেনেও সংসার করে গেছেন, কোনোদিনও তেমন অভিযোগ করেন নি কাউকে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন একা হাতে। এখনকার দিনের মেয়েরা যেভাবে প্রতিবাদ করতে পারে, সেইসময় তা মোটেই সম্ভব ছিল না।
অনেকদিন বাদে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে সে বছর বাড়ী এসেছি, পরীক্ষার ফল বেরোলে আবার ফিরে যাব। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে সবাই উঠেছে, হৈ চৈ হচ্ছে। বিমল জ্যাঠা বাড়ী ফিরেছে অসুস্থ অবস্থায়। কারা যেন জ্যাঠাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। পরের বেশ কিছুদিন বাড়ীর সবাই ব্যস্ত জ্যাঠাকে নিয়ে। সেইসময় মেজ জ্যেঠিমাকে দেখেছি, নিজেকে ভুলে অসুস্থ স্বামীকে কিভাবে সেবাযত্ন করেছেন! বেশ কিছুদিন পরে জ্যাঠা সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং জ্যেঠিমা খানিকটা স্বস্তি বোধ করেন।
দুদিন পরে চৈত্র সংক্রান্তি, চড়ক পুজো হতো বাড়ীতে। সেইসব মিটে গেল, পয়লা বৈশাখের দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। রাত্রে দেখেছি, বাড়ীর কাজের লোক টুলুর মা একে একে সব জ্যেঠিমা, কাকীমাদের চুল বেঁধে দিচ্ছে সুন্দর করে। সবাই খুব আনন্দে আছে। রাতে খাওয়া হবে লুচি মাংস মিষ্টি। আমরা ছোটরা গল্প আড্ডা খাওয়া সেরে যে যার ঘরে। মাঝ রাতে আবার কান্নার আওয়াজ, জ্যাঠা চলে গেছেন বাড়ী থেকে। মেজ জ্যেঠিমা দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। যেন কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। ধীরে ধীরে সবাই শান্ত হয়ে ফিরে গেল, এই ঘটনা তো এ বাড়ীতে নতুন না। মা তখন জ্যেঠিমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে, মায়ের ঠিক পিছনে আমি। শুনলাম জ্যেঠিমা মা কে বলছেন, "কি জানিস তো, একটু কষ্ট হয়, তাই কাঁদি। আমার হাতে তো কিছুই নেই। এই নিয়ে যদি বসে থাকি তো ছেলেমেয়ে মানুষ করবো কি করে?এই এতবড় সংসার, ছেলে মেয়ে শ্বাশুড়ি, তোরা সবাই, চণ্ডীমণ্ডপ, নিত্য পূজা, আপদ বিপদ সব ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে যাব কোথায়?নিজের দিকে তাকালে তো আর চলবে না। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। আমি কাউকে কাছে টানলে সে আসবেই এমন কি হয়?ওর কাছে সংসারের বাঁধন আলগা, কিন্তু আমাকে তো ধরে রাখতেই হবে, তা নাহলে সব তো ভেসে যাবে। আজ কষ্ট হচ্ছে, কাল সব ভুলে যাব রে। নতুন বছর পড়ে গেল, সব কিছু নতুন করে আবার ভাবতে হবে, এসব তো চলতেই থাকবে। একটা কথা মনে রাখিস, ভালবাসাও আমার, যন্ত্রণাও আমার, এর ভাগ নেবার কেউ নেই"। তখন বুঝি নি হয়তো সবটা, কিন্তু আজ বুঝতে পারি, সংসারে বেঁচে থাকার জন্যে, সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে নিরন্তর এক পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় আমাদের। শুধু নিজেকে নিয়ে থাকতে পারি না আমরা, সবার মাঝে সবাই কে নিয়ে বাঁচতে হয় আমাদের।
মামার বাড়ীতে যেখানে আমি থাকতাম, তার থেকে পাঁচ সাতটা বাড়ী পেরিয়েই আমার ছোটবেলার বন্ধু তপতীদের বাড়ী। যেখানে গেলে সময়ে অসময়ে মায়ের স্কুল জীবনের কথা, বড় হবার কথা শুনতে পেতাম। আর বাড়ী থেকে দূরে থাকার ফলে সেসব কথা জানার আগ্রহ কম ছিল না। তবে মায়ের কথা বলবো না আজ। কারণ মায়ের কথা বলতে গেলে শেষ তো হবে না। সব সন্তানের কাছেই মা একটা এমন অনুভূতি, যা কোনোদিন বলে বা বুঝিয়ে শেষ করা যায় না। মায়ের এক বান্ধবী ছিল। অদ্ভুত ভাবে, মা এবং তার বান্ধবীর নাম কিন্তু একই। সে যাই হোক, মায়ের বান্ধবীর মেয়ে আর আমি দুজনেই আবার একই স্কুলে, একই ক্লাসে পড়েছি। তাই আমাদের বন্ধুত্বও সেই ছোটো বেলা থেকে। তপতী আর আমি দীর্ঘ দশ বছর একই সঙ্গে স্কুলে গিয়েছি, পড়াশুনা করেছি, খেলেছি, গান গেয়েছি, সব থেকে বড় কথা একে অন্যের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলাম। তপতীর মা কে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। কাকীমার মত মহিলা আমি দেখি নি তেমন। ইংরিজীতে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করার আগেই বাড়ির অমতে বিয়ে করে চলে আসে কাকুর বাড়িতে। পরে কাকিমা পড়া শেষ করে চাকরী করতে শুরু করে। কাকু ছিল পুলিশের কনস্টেবল। শঙ্কর সোম। মায়ের বন্ধু তো মাসীই হয়, কিন্তু আমি তো কাকু আর কাকীমাই বলতাম।
জলের যেমন কোনো রং নেই, আকার নেই, আমার কেমন যেন মনে হয়, সংসারটাও ঠিক তেমনি। সংসার যেমন করে গড়ে ওঠে, তার ওপরে কারো কোনো হাত নেই। তপতী, বুবুন, কাকু, কাকীমা আর কাকুর মা এই নিয়ে ওদের সংসার। আমাদের ছিল সকালে স্কুল। ভোর বেলায় এ ওর বাড়ি হয়ে স্কুলে যাবার সময় দেখেছি, কাকীমা ঘুঁটে দিচ্ছে দেওয়ালে, কোনোদিন হয়তো তরকারি কাটছে না হলে রান্না বসানোর প্রস্তুতি চলছে। কিছুদিন পরে তপতীর একটি বোন হয়ে ছিল, তার ভালো নাম মনে নেই, ডাক নাম ছিল বুচাই। আমরা তখন একটু বড় হয়েছি, নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা হতো নানা বিষয় নিয়ে। কাকিমার কথা তপতীর কাছে শুনতাম, উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হতো কাকীমাকে সংসার ঠিক রাখতে গিয়ে। একটি ছোটো স্কুলে পড়াতো কাকিমা, সব কাজ সেরে স্কুলে যেত কাকিমা বেলা দশটায়, ফিরে আসতো বিকেল চারটের সময়। সেইসময় আমাদের অঞ্চলে ইলেকট্রিক আসে নি। হারিকেনের আলোতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় কাকিমা কয়েকটি মেয়েকে পড়াতেন, উপায় ছিল না, কাকুর একার রোজগারে তিনটি সন্তানের লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া, শ্বাশুড়ির দেখাশোনা সবকিছু হয়তো সম্ভব হতো না। বিশেষত যেহেতু বাড়ির অমতে নিজেরা বিয়ে করেছিল তাই কাকীমাকে কেউ সাহায্য করবে, এমন পরিস্থিতি ছিল না। তপতীর কাছে এর পরে অনেক বড় হয়েও শুনেছি, বিয়ে হবার পরে কাকিমা কোনোদিনও তার বাপের বাড়ি ফিরে যায় নি। সন্ধ্যেবেলা কখনো ওদের বাড়িতে গিয়েছি হয়তো, দেখেছি তপতী রান্না সেরে নিচ্ছে, কতই বা বয়েস তখন আমাদের, বারো তেরো হবে, কিন্তু তপতী তখন থেকেই মায়ের সাহায্য করতো। ওর ঠাকুমা মারা গেল, তপতীর ভাই কিছুতেই ন্যাড়া হবে না, মনে আছে কাকু জোর করে চেপে ধরে আছে বুবুন কে, আর নাপিত তার কাজ করছে।
জীবন তো আর থেমে থাকে না আমাদের। আমরা বড় হই চারপাশকে সঙ্গে নিয়ে, কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের বোধ বুদ্ধি অভিজ্ঞতা একটু একটু করে আমাদের বড় করে তোলে।
গরু বাছুরের যত্ন, দুধ বিক্রি করা, সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম, ছেলে মেয়ের দেখাশুনা, স্কুলের চাকরী, পড়ানো -- সব মিলিয়ে কাকীমার জীবন চলছিল, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছে ছিল অন্যরকম, তাই হঠাৎ একদিন কাকুর জীবন শেষ হয়ে গেল। আমরা তখন মাধ্যমিক দিয়েছি সবে। অথৈ জলে পড়লো তপতীদের পরিবার। কাকু মারা যাবার পরে কাকীমা কি যে কষ্ট করে তিনটি সন্তান মানুষ করেছেন, তা একেবারে নিজের চোখে দেখা।
সেইসময়ই প্রথম জানতে পারি, কাকীমার বেসরকারী স্কুলের চাকরী থেকে রোজগার দুশো টাকা, আর টিউশন পড়িয়ে একশো পঞ্চাশ টাকা। এতেই ওদের চলতে হবে। কাকুর জমানো টাকায় তো হাত দেওয়া যাবে না, কারণ পরিবারে দুটি মেয়ে আছে, তাদের ভবিষ্যত আছে। বুবুন তখন ক্লাস এইটে পড়ে, আর বুচাই তখন আট বছরের।
যে কাকীমাকে দেখেছি প্রাণ দিয়ে সংসার করতে, সেই কাকিমা এখন সবই করে, কিন্তু ভালোবাসার থেকে এখন কর্তব্য অনেক বড়। টাকা পয়সার অভাব, আপনজনের সান্নিধ্য বঞ্চিত কাকিমা নিশ্চুপে তিনটি সন্তানকে বড় করছে।
কিছুদিন পরে ঘুরে এল নববর্ষ। সেদিন ও গিয়েছি তপতীদের বাড়ী। তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, সবাই অপেক্ষা করছি ফলাফলের। কিছুদিন পর তো সবাই নতুন ক্লাসে পড়বো।
সাদা কাপড়, সিঁথিতে সিঁদুর নেই, নিরাভরণ কাকিমা সেই সকালে আমাদের হাতে দিয়েছিল ছাতুর লাড্ডু। আমার মনে পড়লো, কতবার এই বাড়ীতে নববর্ষের দিনে কত কিছুই তো খেয়েছি, কিন্তু সেদিনের মত এমন স্বাদ বোধহয় আর কখনও পাই নি।
নববর্ষ শুনলেই মনে ভিড় করে আসে কত কথা, আর ভুলেও গিয়েছি যে কত তার ঠিক নেই। নতুন বছর সবার জীবনেই নতুন কিছু নিয়ে আসে। প্রকৃতির কাছে শীতের পাতা ঝরানো যেমন সত্যি, তেমনি বসন্তে নতুন করে।
সেজে ওঠাও সত্যি। আমাদের এই স্বল্প বিস্তর দিন রাত্রির মাঝে আমরা নিজেদের নিয়ে এত মগ্ন থাকি, অনেক সময় অনেক কাছের মানুষকে দেখেও দেখতে পাই না, বুঝেও বুঝে উঠতে পারি না। ঠিক তেমন একজন মানুষের কথা না লিখলেই নয়।
আমাদের পাড়ার ভোলাদা, কেউ বলে ভুলু, কেউ বলে ভোলেনাথ, ভুলু বাবু, কেউ বলে ভোল্কি, যে কোনো নাম কী করে বিকৃত করতে হয় তা আমরা বাঙালীরা ভালোই জানি। সে যাই হোক, মানুষটি এমন একটি হৃদয়ের অধিকারী যাকে কোনোভাবেই হৃদয় থেকে দূরে রাখা যায় না। চিরবসন্তের হৃদয় ছিল এই ভোলাদার। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে মা বাবার কাছে দু তিন মাস ছিলাম। তখন খুব কাছ থেকে দেখেছি ভোলাদাকে।
যখন আমি দেখেছি ভালো করে ভোলাদাকে, তখন আমার বয়েস আঠেরো বছর, আর ভোলাদা তখন বছর পঁচিশ। ওই বয়েসটা এমন একটা বয়েস, যখন ভালোলাগার বোধগুলো নতুন করে জন্মায়। আমাদের পরিবারে বহু লোকের আসা যাওয়া ছিল প্রতিদিন। আমি আগে কখনও হয়তো দেখে থাকতেও পারি, কিন্তু সেই বছরে যেভাবে দেখেছিলাম, তেমনি ভাবে আর কখনও দেখি নি।
অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, বাড়ীতে মা বাবা দুই দাদা, বোনেরা সবাই মিলে আটজনের পরিবার। ওদের ছিল জমিজমা ধান চালের কারবার, গোটা তিনেক রাইস মিল, দাদারা ছোটোখাটো চাকরী করতো, বোনেরা বিবাহিত।
বি. এ. পাশ করেও ভোলাদা কোনো চাকরী করে না। সারাদিন ওই চাষের কাজ দেখাশুনা আর সমস্ত পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো নিয়েই থাকে।
নিজেদের পাড়া এবং তার আশেপাশের প্রায় সবাই ভোলাদাকে চেনে, ভালোবাসে। বর্ষার শেষে মেঘলা আকাশকে সূর্যের সোনালী আলো যেমন ভাসিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি ছিল ভোলাদার হাসি। সেই হাসি দেখলে হেন মানুষ নেই যার ভিতরে সেই খুশীর ছোঁয়া না লাগে। সকলের বাড়ীতে তার ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ ছিল ভোলাদার খোলা হওয়ার মত স্বভাব, ইচ্ছে মতো যেদিকে খুশী বয়ে যেতে পারে। কোথাও কোনো বাধা নেই।
প্রভাতকাকু তার মেয়ে শিখাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষা দিতে। রাস্তায় দেখা ভোলাদার সঙ্গে। ভোলাদা খুব সহজেই বলে, "কাকু, তুমি অফিস যাও, আমি শিখাকে পৌঁছে দিচ্ছি।" শিখাও এসে বসে যায় ভোলাদার সাইকেলের পিছনে। কোথাও কারো কোনো অসুবিধা হয় না।
স্কুল থেকে ফেরার পথে সে নীলিমাদির জন্যে একটু বাজার করে নিল, নীলিমাদির কোনো সন্তান নেই, শ্বশুর শ্বাশুড়ী এবং স্বামী তিনজনেই গত। বছর তিরিশ বয়েস এই নীলিমাদির সঙ্গেও ভোলাদার অদ্ভুত আত্মীয়তা, যে বিষয়ে কেউ কিছুই মনে করে না। এ বাড়ীর দরজা ভোলাদার জন্যে সবসময় খোলা।
আমি সেই প্রথম দেখলাম এমন একজন মানুষকে, যার সুন্দর মুখের ঝরঝরে হাসির মধ্যে লেখা আছে, "সবারে করি আহ্বান"। এত ভালো লাগতো দেখতে, ওই বয়েসের মুগ্ধতা তো অন্যরকম। আসা যাওয়ার ফাঁকে মাঝে মাঝেই কথা হতো, কারণ ওইরকম উন্মুক্ত মন যাদের, তারা তো সবাইকে নিয়েই বাঁচে।
আমি কলকাতায় পড়াশুনা করি, গ্রামের বাড়ীতে একটা বয়েসে বড় ছেলের সঙ্গে বেশী মিশতে পারি না। মনে হয়, লোকে কি ভাববে! আসলে নিজের মনটাই তো সংকীর্ণ, খোলা মনে মিশলে ভালোলাগার ব্যাপারটা সবাই বুঝে যাবে, তাই কথা বলি, তবে তেমন মিশতে চাই না, এই ভাব বজায় রাখি।
একদিন আমাদের ছোটো পিসির পা ভেঙে গেল পুকুর থেকে কাপড় কেচে ওঠার সময়, কেউ খবর দিয়েছে বোধহয়, ভোলাদা পিসিকে নিয়ে চলে গেল আর ফিরেও এল প্লাস্টার করিয়ে, কবেকার কথা, বললাম, "খেয়ে যাও এখানে।" নির্দ্বিধায় বসে পড়লো খেতে।
একদিন বিকেলে হঠাৎ দেখা, দেখলাম মুখের হাসি একটু মলিন, এমন তো দেখি নি আগে, প্রশ্ন করে জানলাম, পাখীদি কে আজ যারা দেখতে এসেছিল, তারা চলে গেছে এবং পাখীদিকে তাদের পছন্দ হয় নি। গায়ের রং তাদের মনের মতো হয় নি।
সরলা বলে একজন বৃদ্ধা ছিল গ্রামে, তার বাড়ী কোথায় বা কোথা থেকে এসেছে জানি না, শুধু দেখতাম জোড়া আম গাছের নীচে শুয়ে ঘুমাতো, যে যা খেতে দিত তাই খেতো। ভোলাদা, প্রতিদিন এই মানুষটিকে বিকেলে একবার দেখে আসতো, দুটো কথা বলতো, কিছু লাগলে দিয়ে যেতো।
দাদা বৌদি, জ্যেঠিমা, কাকী, মামা, দিদি, এ বাড়ী, ও বাড়ী সবার কাছের লোক ভোলাদা। আমি ফিরে এলাম কলকাতায়, আবার লেখাপড়ার মধ্যে, কিন্তু ভোলাদাকে অন্যদের মতো ভালোবেসেও ফেললাম। কিছু মানুষকে ভুলতে চাইলেও তারা কোনোদিন মন থেকে মুছে যায় না।
দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর কখন পাল্টে যায়, নতুন বছর এসে যায়, আমরাও বড় হয়ে যাই। পাঁচ ছয় বছর পরে আমারও বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছে, বাপের বাড়ী যাওয়া তেমন আর হয় না।
সেবারে গিয়েছি, সঙ্গে টুবলু, মাত্র একবছর বয়েস। একটু বেলায় বেরিয়েছি কিছু কেনাকাটার জন্যে, হঠাৎ সুমনাদিকে দেখে অবাক আমি। আমার থেকে বড় একটু, কিন্তু একই কলেজে পড়েছি আমরা, অনেক কথা বলতে বলতে জানলাম, সুমনাদি এই গ্রামেই সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা।
প্রথম দিন চাকরী করতে এসে ট্রেন থেকে নামতেই একজন লোক সুমনাদির জিনিসপত্র নিয়ে যেতে শুরু করলে খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল, "খবরদার, আমার জিনিসে হাত দেবে না। চোর কোথাকার!" চিরসুখী ভোলাদা এই প্রথম বোধহয় দুঃখ পেয়েছিল এই ভেবে যে, এতদিন ধরে, এত বয়েস পর্যন্ত তাকে কেউ চোর বলে নি। অনেক কষ্টে সে বোঝায় গ্রামের হেডমাস্টার সুভাসদা তাকে বলেছে, নতুন দিদিমণি কে স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে, সুমনা দি বিশ্বাস না করায় দুজনে আলাদা দুটো রিকশায় করে আসে। শেষে দুজনের মিটমাট হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে সুমনাদি ভোলাদার পরিচয় পায়। কথা বার্তা তেমন না হলেও পথেঘাটে দেখা তো হয়েই যেত।
ভালবাসা মানেই তো একটি অনুভূতি, সেই অনুভূতির আকর্ষণ আমাদের নিরন্তর পূর্ণতা দিয়ে যায়। পূর্ণতার বন্ধন ভোলাদা আর সুমনাদির জীবনকে ভরে দিয়েছে। মাঘ মাসে পরিচয়, আর পয়লা বৈশাখে বিয়ে। ওইদিন নাকি বিয়ের দিন ছিল না। কিন্তু সুমনাদির বাবা কলকাতা থেকে দূরে মেয়েকে রেখে চিন্তায় ছিলেন। ভোলাদার মতো একটি ছেলেকে তিনি হাতছাড়া করতে চান নি। তাই ওইদিনই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। গ্রাম জুড়ে সকলের নিমন্ত্রণ ছিল।
নববর্ষ প্রতিবার আসে, কিছু দিয়ে যায়, কিছু নিয়ে যায়, ঈশ্বরের পৃথিবীতে দেওয়া নেওয়া তো চলতেই থাকে। মানুষের জীবনের সুখ দুঃখের অবিরাম উত্থান পতন নিয়ে বয়ে চলে চির নতুনের ধারা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রজ্ঞাপারমিতা রায়
Prajna Paramita Royearned her Master’s degree in Bangla from Visva-Bharati University, Santiniketan. Deeply inspired by Rabindranath Tagore’s ideals, she has dedicated over three decades to teaching Bangla Literature and Language, instilling in her students a holistic approach to education that blends knowledge with creativity and sensitivity. Based in Kolkata, she nurtures a lifelong passion for both teaching and music.
Stories of remembrance, resilience, and the quiet poetry of life.
Join us in promoting cross-cultural dialogue, preserving heritage, and fostering global collaborations through art, literature, music, and festivals.