দুর্গাপুজো – দুটি প্রবন্ধকথা | সম্বিৎ বসু

দুর্গাপুজো প্রবন্ধ

দুর্গাপুজো – দুটি প্রবন্ধকথা

✍️ সম্বিৎ বসু

আমি বিদেশে ক্রিসমাস দেখেছি, পালন করেছি। বিদেশে বলতে অ্যামেরিকায়। ক্রিসমাসের আসল মজা ক্রিসমাসের আগে। ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে, একমাস আগে থেকে দোকান থেকে শুরু করে মল সবাই ক্রিসমাসের সাজে সেজে ওঠে। বাজতে থাকে ক্রিসমাসের গান, বাজনা। অনেক রেডিও স্টেশন অন্যসব গান বাজানো থামিয়ে অষ্টপ্রহর বাজায় ক্রিসমাসের গানে। আমাদের মতন মধ্যবিত্তরা - সাহেব-নেটিব নির্বিশেষে - মইয়ে উঠে নড়বড় করতে করতে ক্রিসমাস লাইট লাগাই। ঘরের মধ্যে বসাই ভিন্ন মাপের ক্রিসমাস ট্রি, তার পাতায় পাতায় টুনিবালবের আলো। চাপে পড়ি নিকটজনের জন্যে ক্রিসমাসের উপহার কিনতে। এসব করেও কিন্তু ক্রিসমাসের দিনটা তুলনামূলকভাবে নিরেস। সকালে ক্রিসমাস ট্রির নিচে রাখা র‍্যাপিং পেপারে মোড়া উপহার খুলেই মধ্যবিত্তর পরবের ইতি।

পৃথিবীর বোধহয় সব বড় পরবেরই প্রস্তুতির মিল আছে। তাই পরব উদযাপনে মিল থাকলেও, ক্রিসমাস যদি উৎসব হয়, দুর্গাপুজো তাহলে মহামহোৎসব। তার ওপর দুর্গাপুজোর রমরমা বাড়ছে বছর-বছর। মাতৃমূর্তি ছাড়া দুর্গাপুজো হতে পারে, থিম ছাড়া যে দুর্গাপুজো হয় - শহর কলকাতায় এ জিনিস ভাবা আজ অসম্ভব। অথচ আজ থেকে তিরিশ বছর আগে থিমের প্রাদুর্ভাব যখন ঘটেনি, বারোয়ারি পুজোয়ও আটপৌরে, দেখনদারীর বাহুল্যবর্জিত আন্তরিকতার অভাব ছিলনা। যদিও আরও প্রবীনরা অন্য কথা বলবেন। কাজেই দুর্গাপুজোর বিবর্তন এখনও পুরোমাত্রায় চলছে।

যদি শতখানেক বছর পিছিয়ে গিয়ে দুর্গাপুজোর বিবরণ দেখি - সে আমলের দুর্গাপুজো সম্বন্ধে, সৌভাগ্যবশতঃ, লেখাপত্তরের অভাব নেই - তখনও দুর্গাপুজোয় আড়ম্বরের অভাব ছিলনা। আমি সে সব লেখার কথা বলব না। আমি মহেন্দ্রনাথ দত্ত-মশাইয়ের দুটো ছোট লেখার কথা উল্লেখ করব। মহেন্দ্রনাথ দত্ত মানে স্বামী বিবেকানন্দর মেজ ভাই। ভাইদের ধর্মভাব ধাপে ধাপে কমেছিল। মহেন্দ্রনাথ দত্ত বিলেতে আইন পড়তে গিয়েছিলেন। যদিও মাঝপথে আইন পড়া ছেড়ে ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি রকমারি বিষয়ে পড়াশুনো করে ১৯০২ সালে ফিরে আসেন। পরে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও তাঁর কাজকর্ম আর লেখাপত্র থেকে দারুণ ধর্মগতপ্রাণ বলে মনে হয়না। সংসদের বাঙালি চরিতাভিধান লিখেছিল, "গৈরিক বস্ত্র ধারণ না করলেও তিনি সন্ন্যাসজীবন যাপন করতেন"। বুঝ লোক, যে জান সন্ধান। নরেন দত্তর ছোট ভাই ভূপেন দত্ত তো ঘোষিত কমিউনিস্ট। মহেন্দ্রনাথ দত্তর 'দুর্গাপূজা' প্রবন্ধটিও মূলতঃ একটি বৌদ্ধিক প্রবন্ধ।

কী লিখছেন দেখুন - "বাংলাদেশে প্রচলিত যে সব দুর্গাপূজার গল্প পাওয়া যায় তাহাতে রাবণ বধার্থে রামচন্দ্র দুর্গাপূজা করিয়াছিলেন। ইহা রামায়ণ বা অন্য কোথাও নাই। কথক ও তৎশ্রেণীর লোক আধুনিক যুগে এইসব রচনা করিয়াছেন। প্রথম প্রশ্ন হইতেছে যে, চন্ডীগ্রন্থ কবে রচিত হইল? মধুকৈটভ বধের পঞ্চম শ্লোকে আছে 'ব্হূবুঃ শত্রুশে ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা।' কোলা মানে - শুকর খায়না এমন যবনরা আসিয়া আক্রমণ করিল। ইহা হইতে বোধ হইতেছে যে, মুশলমান আক্রমনের প্রারম্ভেই এই গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়।" এ কথা যদি সত্যি হয় - সত্যি না ভাবার কোন কারণ নেই - তাহলে এখনও কেন কাগজ-রেডিও-টিভি উচ্চৈঃস্বরে "অকালবোধন" বলে নিনাদ করে যায়।

লিখছেন, তাঁদের শৈশবে (জন্ম ১৮৬৯, তাহলে শৈশব মানে ১৮৭০-এর দশক) কলকাতায় বহু বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। মনে হয় বারোয়ারি পুজোর থেকে বাড়ির পুজোর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। খুব ইন্টারেস্টিং যেটা সেটা হল, শাক্ত বাড়ির আর বৈষ্ণব বাড়ির মূর্তির ফারাক। "শাক্তের বাটীতে দুর্গার সিংহ সাধারণভাবে এবং গোঁসাই-এর বাড়ীতে সিংহ ঘোড়ার মত মুখ হইত। সম্ভবতঃ শাক্ত ও বৈষ্ণবের ভিতর এই প্রভেদ রাখিত। ... আমরা যখন শিশু, তখন ডাকের গহনা উঠে নাই, মাটির গহনা হইত।" আমরা আজকাল যাকে ডাকের সাজ বলি, তার উপকরণ আসত জার্মানি থেকে, ডাকযোগে। তাই এই গয়নার নাম হয়েছিল ডাকের গয়না। অন্ততঃ একটি মত তাই। দেখা যাচ্ছে ডাকের গয়নার চল ১৮৭০-এর দশকের পরে হয়েছিল।

আরেকটা দেখার মতন বিষয় হল, তখন দুর্গাপুজোয় পাত পেড়ে খাওয়ানর চল ছিল। "তখনকার দিনে দুর্গাপূজা হ'লে দশজনকে পাত পাড়াতে হ'ত। ব্রাহ্মণের বাটী হলে ভাত, পাঁচ তরকারী, দই পায়েস। শাক্ত ব্রাহ্মণ হইলে মাছ চলিত, কায়েস্থের বাটীতে লুচি চলিত। ... সন্ধ্যার সময়ে ঝি, চাকর, ছেলেমেয়েদের বেড়াতে নিয়ে গেলে এক সরা জলপান দেওয়ার প্রথা ছিল। যাহোক দুর্গাপূজার সময় সকলকে মিষ্টি মুখ করান হ'ত।"

মিষ্টিমুখ তো আজও করান হয়। আমাদের কৈশোর-যৌবনে, দশমীর পরে, পাড়ায় বন্ধুদের ও পরিচিতদের বাড়িতে বাড়িতে বিজয়া করতে যাওয়া প্রাইম অ্যাট্রাকশন ছিল জলখাবার, বিশেষতঃ মিষ্টি। কাজেই মনে হতে পারে সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে। কিন্তু তা বোধহয় নয়। অন্ততঃ মহেন্দ্রনাথ দত্ত পড়লে তাই মনে হয়। "বিজয়ার দিন পাড়ার বুড়ো ব্রাহ্মণদের কিঞ্চিৎ প্রণামী দিয়া প্রণাম করিতে হইত। বিজয়ার দিন নারিকেলছাবা দেওয়া হইত। বিজয়ার কোলাকুলিতে সন্দেশ বা অন্য কোন খাবার চলিত না।" নো মাংসর ঘুগনি, নো রসগোল্লা। বোধহয় নারকোল নাড়ু নারিকেলছাবা-র জায়গা নিয়েছে। নারিকেলছাবা জিনিসটা কী, কে জানে!

'দুর্গাপূজা' প্রবন্ধর রেফারেন্স শেষ করব এই উদ্ধৃতি দিয়ে - "বিজয়ার রাত্রে পরস্পরের বিরোধ ভুলিয়া কোলাকুলি করিতে হইত। এখন যেমন মাসে-মাসে লোকজনের টাকা চুকাইয়া দেওয়া হয় আগে তেমন ছিল না। কথায় ছিল ঢাকে-ঢোলে অর্থাৎ দুর্গাপুজোয় এবং চড়কে লোকে দেনা চুকাইয়া দিত। তখন মুদীর দোকান থেকে উট্‌নো নেওয়ার প্রথা ছিল। সেটা বছরে দুবার পরিশোধ হইত (*দেখা যাচ্ছে - (১) দুর্গাপুজোয় ঢাকঢোল বাজত (২) EMI-এর চক্কর ছিল না (৩) মুদীর দোকানে লোকের খাতা থাকত - সম্বিৎ*)। সর্ব বিষয়ে তখন দুর্গাপূজায় মহা আনন্দের ভাব ছিল। এমন কি গ্রাম্য মুসলমানরা আসিয়া প্রতিমাকে তিনবার সেলাম সেলাম সেলাম বলিয়া চলিয়া যাইত। যাহাদের বাড়ীতে প্রতিমা না আসিত, তাহারা কয়েকদিন চন্ডীপাঠ করাইতেন। এইটা ছিল তখনকার দিনের জাতীয় উৎসব। হিন্দুমাত্রই তখন আনন্দে মাতিয়া উঠিত - এই হইল ভক্তিভাব ও জাতীয়তাভাব।" মন্তব্য করা থেকে নিরস্ত হলাম।

এই প্রবন্ধেরই পিঠোপিঠি আরেকটা প্রবন্ধ আছে - 'মহিষাসুর বধ'। এ এক আশ্চর্য প্রবন্ধ। পুরাণের ইতিহাস, আর্কিওলজি, আর্টের ইতিহাস - সব মিলিয়ে-মিশিয়ে মহিষাসুরের উৎস-সন্ধানের চেষ্টা। পুরাণের ইতিহাস নিয়ে তুলনামূলকভাবে অনেকটা লিখেছেন। আমি ধরতাইটা উদ্ধৃত করি - "রামায়ণে পাওয়া যায় যে, রামের সহিত সুগ্রীবের যখন প্রথম সাক্ষাৎ হইয়াছে তখন সে বলিতেছে - তোমার বাহুবল পরীক্ষা করিব। যদি এই মহিষের অস্থি দূরে নিক্ষেপ করিতে পার ইত্যাদি। এবং সেই স্থলে মহিষাসুর বধের একটি গল্প আছে। কোন কোন জায়গায় পাওয়া যায় যে কার্তিকেয় (দেব সেনাপতি) মহিষাসুর বধ করিয়াছেন এবং কোন স্থলে আছে যে দেবী মহিষাসুর বধ করিয়াছেন। ... গ্রীকদের বইতে এইরূপ Hydra বধ করার গল্প আছে এবং এই Buffalo demon বধ করার কথা অনেক প্রাচীন জাতির গল্পের ভিতর আছে।" এই আলোচনায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত নিয়ে আসছেন দক্ষিণ আফ্রিকার আর্কিওলজিকাল আবিষ্কার থেকে 'Aryan mythology', সেখান থেকে Buffalo demon-এর সার্বজনীনতা থেকে উমা-হৈমবতীর গল্প।

এরপরের অংশের আলোচনা আরও কৌতুহলোদ্দীপক। শিল্পের ইতিহাসের চিহ্ন বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন (পুরুষ ও নারী বিগ্রহের কোমর-বেঁকানর ধরণ থেকে বৌদ্ধ চিত্রকলার three block system দিয়ে) যে "প্রচলিত বাংলার দুর্গা ঠাকুর সাত আট শত বৎসরের অধিক হইবে না।" এর সঙ্গে আগে উদ্ধৃত চন্ডীগ্রন্থ রচনার সময়কাল যদি মুশলমান আক্রমণের শুরুর দিক ধরি, তাহলে কী ভাবতে পারি মহেন্দ্রনাথ দত্ত-মশাই এরকম একটা ইঙ্গিত করছেন যে বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন ও জনপ্রিয়তা আসলে মুশলমান আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত?

লেখাদুটো আছে ওনার 'কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা' কেতাবে।


About the Author:

সম্বিৎ বসুর জন্ম ষাটের দশকের শেষে। জন্মসূত্রে মোহনবাগান ও উত্তর কলকাতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ছুতোয় ল্যাদ ও আড্ডায় পাক্কা ট্রেনিং। ১৯৯৩ সালে উচ্চশিক্ষায় বিদেশ আগমন ও ঠ্যালার-নাম-বাবাজী দর্শন। গ্রাসাচ্ছাদন, তথ্য-প্রযুক্তির সূতিকাগার, সিলিকন ভ্যালির ছোট-বড় কোম্পানিতে। ব্যক্তিগত প্রবন্ধের সংকলন - "আপন বাপন জীবন যাপন"। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আপাততঃ একটিই। প্রবন্ধ-টবন্ধ বেরিয়েছে এদিক-সেদিক। স্ত্রী পারমিতা ও দুই কন্যা-সহ বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়ায় স্যান ফ্র্যানসিসকো শহরের তলিতে। স্বপ্ন দেখেন একদিন কলকাতায় ফিরে পেশাদার আড্ডাবাজের জীবন ফিরে পাবেন।



Comments & Related Articles

Explore more essays and reflections from Mélange — where ideas meet imagination.

Ganga Zuari International: Connecting Cultures Across the Globe

Join us in promoting cross-cultural dialogue, preserving heritage, and fostering global collaborations through art, literature, music, and festivals.

Latest Events View Activities
Blog - Mélange Read Articles

Congratulations!

Mr. Manguirish Pai Raikar

Heartfelt congratulations to Mr. Manguirish Pai Raikar, President of the Ganga Zuari Academy, on his esteemed election to the Managing Committee of the All India Red Cross Society National Headquarters in Delhi.

This is a prestigious honor, with the Honorable President of India serving as the Committee's Chairperson.

This remarkable achievement brings immense pride to the academy and reflects Mr. Raikar’s dedication and commitment to humanitarian causes.

We extend our best wishes for his continued success and good health, and look forward to his impactful contributions to the Red Cross Society.

Congratulations, sir, on this distinguished honor!