ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কার, Part 6 – Amitabh Moitro & Madhab Kumar Pal

Part 6 A

সময়ের দ্রুত পট পরিবর্তন

(1800 – 1850)
(নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা, তাদের আশ্চর্য ফলাফল, সেসবের কারণের ব‍্যাখ‍্যা, নতুন থিয়োরি, নতুন ফর্মুলা)

 

এতদিন পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটি তৈরী করার রাস্তা জানা ছিল শুধু ঘর্ষণ দিয়ে। হাত দিয়ে বা হাতে ঘোরানো ড্রাম দিয়ে ঘষে। সেটা দিয়ে যে আকর্ষণের প্রভাবটা তৈরী হতো, 150 বছর আগে তার নাম দেয়া হয়েছিল ইলেকট্রিসিটি। এক্সপেরিমেন্ট যা হতো তা এই স্ট‍্যাটিক চার্জ নিয়েই। আর সেটাও হতো emperical ধাঁচের, quantitive এক্সপেরিমেন্টের ধারাটা তখনও জনপ্রিয় হয় নি। আর flowing current এর ধারণাটাই তখনো আসে নি।

1785 তে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী কুলম্ব প্রথম সেই সব পরীক্ষার আকর্ষণের বলকে তুলনামূলক ভাবে মেপে বাকিদের সাথে আকর্ষণের সম্পর্ক নিয়ে একটা পরীক্ষামূলক সূত্র দিলেন।
F = k (q1. q2)/r2
এই সূত্র ধরে স্থির বস্তুদ্বয়ের চার্জ বা দুরত্বের(q1, q2 or r) পরিবর্তন ঘটলে আকর্ষণনের বলের সম্ভাব‍্য পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেয়া গেল।

1791 সালে ইটালির গ‍্যালভানি তার ব‍্যাঙের পরীক্ষা দিয়ে প্রথম দেখালেন যে ঘর্ষণ ছাড়াও সেই আকর্ষণ প্রভাব তৈরী করা যায়। অন‍্য ভাবে তৈরী করা সেই ইলেকট্রিসিটিকে তিনি বললেন Animal Electricity। তত্ত্ব দিলেন যে জীবের শরীরেও ইলেকট্রিসিটি উৎপন্ন হয়।

 

নতুন দিগন্তের পথে প্রথম ব্রেক-থ্রু – 1800 সালের নতুন খোঁজ

 

গ‍্যালভানির সূত্র ধরে তার পরীক্ষার ওপর আরো কাজ করলেন ইটালিরই আলেসান্দ্রো ভোল্টা। 9 বছর পর 1800 সালে বানিয়ে ফেললেন এক যন্ত্র, নাম দিলেন Voltaic Pile। তাতে ইলেকট্রিসিটি তৈরী হলো। আর সেই ইলেকট্রিসিটি তৈরী করতে কোন ঘর্ষণ বা জীবের শরীর দরকার হলো না। দরকার হলো রাসায়নিক (নুনজল, পরের নাম ইলেকট্রোলাইট) এবং দুটো আলাদা ধাতুর পাত (পরের নাম ইলেকট্রোড)। এবং সেই ইলেকট্রিসিটি আগেকার ইলেকট্রিসিটির মতো তাৎক্ষণিক ভাবে উৎপন্ন হয়েই মিলিয়ে গেলো না, সেটা স্থির প্রবাহ হিসেবে উৎপন্ন হতেই থাকলো।

Alessandro Volta, Italy

 

Demonstration of Voltaic Pile to Napoleon

 

এর সাথে ভোল্টা দিলেন ইলেকট্রিসিটির নতুন তত্ত্ব, গ‍্যালভানির আগের তত্ত্বকে নাকচ করে।

ভোল্টাইক পাইল আসাতে সহজেই flowing current তৈরী করা গেলো। তখন ইলেকট্রিসিটির ওপর নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা সব flowing current দিয়ে সুরু হয়ে গেল। স্ট‍্যাটিক চার্জের ব‍্যবহার পিছিয়ে পড়লো।

ভোল্টাইক পাইল তৈরী করা ছিল অতি সহজ ব‍্যাপার। উপকরণ অতি সামান‍্য, সবার ঘরেই পাওয়া যায়। বাজারে চলা পয়সা (কয়েন, পেনি বা শিলিং) যা একটা ধাতুর কাজ করে। দ্বিতীয় ধাতু জিঙ্কের পাত, সেটাও সহজেই পাওয়া যায়। আর নুন। অনেকেই বাড়িতে ভোল্টাইক পাইল বানিয়ে বিদ‍্যুত প্রবাহ তৈরী করে নিজেরাই নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় মেতে উঠলো।

 

পরের ব্রেক- থ্রু : 1820 সালের নতুন খোঁজ

 

1800 সালে ভোল্টার এই আবিষ্কার দেখে আকৃষ্ট হলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ‍্যালয়ের এক তুখোড় ছাত্র হান্স ক্রিষ্টিয়ান ওরস্টেড। তিনি তখন 22 বছর বয়সে সদ‍্য ডক্টরেট করেছেন কান্টের দর্শণতত্বের ওপর। ভোল্টার যন্ত্রের ডেমনস্ট্রেশন দেখে ওরস্টেড আকর্ষিত হলেন ইলেকট্রিসিটির ওপর নিজেই পরীক্ষা চালানোর ব‍্যপারে। পরের বছর ওরস্টেড একটা ট্র‍্যাভল স্কলারশিপ পেলেন, ইউরোপের বিজ্ঞানপীঠগুলোতে তিন বছর ধরে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন‍্য। এই ভ্রমনে জার্মানীতে এক বিজ্ঞানীর ধারণা তার মনে ধরলো – ইলেকট্রিসিটির সাথে ম‍্যাগনেটিসমের হয়তো কোথাও না কোথাও একটা যোগ আছে, দুটোই তো প্রকৃতি-প্রদত্ত ধর্ম। এটা ওরস্টেডের Kant-ইয় বিচারধারার সাথে (Unity of Nature) বেশ মিল খেয়ে গেল। তিন বছর পর ইউরোপ ভ্রমন থেকে কোপেনহেগেনে ফিরে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন এটার ওপর। সাথে ইউনিভার্সিটির প্রোফেসরশিপ এবং ছাত্রদের জন‍্য ক্লাস লেকচার।

শেষে 1820 সালে, তার 43 বছর বয়সে এসে তিনি দেখালেন যে একটা তারের মধ‍্যে দিয়ে যদি ভোল্টাইক পাইলের সাহায‍্যে ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত করানো যায় তবে সেই বিদ‍্যুত-বাহী তার, কাছে থাকা কোন কম্পাসের কাঁটাকে নড়িয়ে দেয়। দু -তিন মাস ধরে তিনি বারবার এই পরীক্ষা করলেন – কখনো অন‍্য ধরণের তার ব‍্যবহার করে, কখনো ইলেকট্রিক প্রবাহের দিক উল্টো করে, কখনো তার ও কম্পাসের অবস্থান পাল্টে পাল্টে বা কখনো তার আর কম্পাসের মাঝখানে কাঠ বা কাঁচের শীট দিয়ে কোন অদৃশ‍্য প্রভাবের রাস্তায় সম্ভাব‍্য বাধার সৃষ্টি করে। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই মূল ফলাফলটা একই থাকল, কম্পাসের নিডল প্রতি ক্ষেত্রেই নড়ে উঠল। তিনি নিশ্চিত হলেন যে ইলেকট্রিসিটি এবং ম‍্যাগনেটিসম এক অবিচ্ছেদ‍্য জোড়বন্ধনে আবদ্ধ। ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত হলে ম‍্যাগনেট নড়ে।

Hans Christian Oersted. Denmark

 

Oersted experiment.

 

ওরস্টেড সর্বসমক্ষে এই ফলাফল প্রকাশ করলেন 1820 সালে। ইলেকট্রিসিটি এবং ম‍্যাগনেটিসম যে সম্পর্কযুক্ত সেটা এর সাথে প্রমাণিত হল। এই আবিষ্কারের জন‍্য লন্ডনের রয়‍্যাল সোসাইটি তাকে 1820 সালের Copely Medal এ ভূষিত করল। এই মেডেল ছিল তখনকার দিনে নোবেল প্রাইজের সমতুল‍্য । আজকের নোবেল প্রাইজ শুর হয়েছে অনেক পরে, 1901 সাল থেকে।

 

আরও নতুন খোঁজ – 1821 সালে

 

ওরস্টেডের পরীক্ষায় ইলেকট্রিসিটির প্রবাহ দিয়ে ম‍্যাগনেটকে তো নড়ানো গেলো। এখন ভাবনা এলো যে সেই নড়ানোর ক্ষমতাকে কি কোনভাবে অন‍্য কাজে লাগানো যায় ? সেটা কে কি কোনভাবে একটা নিরবিচ্ছিন্ন ঘূর্ণগতিতে (rotation) পরিণত করা যায় ?

এ ধারায় মূল কাজ করলেন মাইকেল ফ‍্যারাডে। তার ফলশ্রুতি একটা যন্ত্র বা পরীক্ষা যা দিয়ে ভোল্টাইক পাইলের ফ্লোইং কারেন্ট দিয়ে একটা অবিরাম ঘুর্ণন গতি পাওয়া গেল। আধুনিক মোটরের (ইলেকট্রিকাল এনার্জি থেকে মেকানিকাল এনার্জিতে রুপান্থর) সেই ছিল আদি পুরূষ।

 

পশ্চাদপট

1801 সালে লন্ডনে স্থাপিত হয় রয়‍্যাল ইন্সটিটিউট। নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর জন‍্য এই ইন্সটিটিউটের স্থাপনা। সে বছরই এই ইন্সটিটিউটে যোগ দেন ইংল‍্যান্ডের হামফ্রে ডেভি। আগের বছর, 1800 সালে ভোল্টাইক পাইল তৈরী হয়ে গেছে। ডেভি নিজেই ভোল্টাইক পাইল বানিয়ে , তা দিয়ে বিদ‍্যুত প্রবাহ তৈরী করে তা দিয়ে নানান এক্সপেরিমেন্ট সুরু করে দেন। সেই ভাবে, ইলেকট্রোলিসিস পদ্ধতিতে তিনি অনেক মৌল আবিষ্কার করে ফেলেন পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক‍্যালসিয়াম, বেরিয়াম ঈত‍্যাদি।

1820 সালে যখন ওরস্টেডের অভিনব পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেল, তা নিয়ে ডেভি তৎক্ষণাত কাজে লেগে পড়লেন। উদ্দ‍্যেশ‍্য, বিদ‍্যুত প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে এক অবিরাম ঘুর্ণন তৈরী করা। ইংল‍্যান্ডেরই আর এক Copely Medal জয়ী এক্সপেরিমেন্টালিস্ট উইলিয়াম হাইড ওলস্টনও লাগলেন সেই কাজে। কিন্তু তারা শেষ অবদি সফল হতে পারলেন না। ইলেকট্রিসিটি দিয়ে ঘুর্ণন পাওয়া গেল না।

কিন্তু এই কাজে অচিরেই সফল হয়ে গেলেন ইংল‍্যান্ডেরই মাইকেল ফ‍্যারাডে, যাকে ডেভি নিয়োগ করেছিলেন 1812 সালে, রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটে তাকে রিসার্চে সাহায‍্য করার জন‍্য। কিছুদিন আগেই ল্ল‍্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালানোর সময়ে বিস্ফোরন ঘটায় ডেভি জখম হন। সেই সাময়িক কার্য‍্যক্ষমতা লোপকে সামাল দিতেই ফ‍্যারাডের নিয়োগ।

ফ‍্যারাডের জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে। স্কুলে যাবার সূযোগ ঘটে নি। 14 বছর বয়সে এক বুক-বাইন্ডারের কাছে অ‍্যাপ্রেনটিস হিসেবে ভর্তি হন, সামান‍্য কিছূ উপার্জনের জন‍্য। সেখানে তিনি 7 বছর চাকরি করেন। সেই সময়ে দোকানে বাঁধাইয়ের জন‍্য আসা বইগুলোকে তিনি গোগ্রাসে গিলতেন। এবং লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় হওয়া বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ের লেকচার নিয়মিত শুনতেন। 21 বছর বয়সে, 1812 সালে তিনি হামফ্রে ডেভির সহকারী হিসেবে রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটে যোগ দেন। তিনি এক আশ্চর্য‍্য এক্সপেরিমেন্টালিস্ট ছিলেন। তার নিজের চিন্তাগুলোকে তিনি খুব প্রাঞ্জল ভাবে সহজ ভাষায় বলতে পারতেন। মানব ইতিহাসের ওপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তারকারি কিছু গবেষণা তিনি করে গেছেন। তবে অঙ্কের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তাকে ব‍্যবহারিক দিকে বেশী সাফল‍্য দিয়েছে, মূল তত্ত্বের গাণিতিক ব‍্যাখ‍্যার দিকে তিনি বেশী এগোন নি।

1820 সালে হামফ্রে ডেভি যখন বিদ‍্যুত থেকে ঘুর্ণন পাবার চেষ্টায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটে তখন তার সহকারী হবার সুবাদে মাইকেল ফ‍্যারাডে ডেভির এই অসফল হওয়া পরীক্ষাগূলোর বিষয়ে জানছেন। আর ডেভি আর ওলস্টন দুজনেই রয়‍্যাল সোসাইটির কর্মকতা, পরস্পরের বন্ধু, একে অপরের কাজের বিষয়ে জানেন। সেই সুবাদে ফ‍্যারাডে ওলস্টনের অসফল পরীক্ষার প্রয়োগের বিষয়েও জানলেন।

ডেভি এবং ওলস্টন বিফল হলেও ফ‍্যারাডে কিন্তু এই কাজে তাড়াতাড়িই সফল হলেন। এক বছরের মধ‍্যেই 1821 সালে তিনি এক যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন যা দিয়ে তারে ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত করিয়ে একটা স্থায়ী ঘুর্ণন পাওয়া গেল। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই যন্ত্রই (বা পরীক্ষা) আজকের বহুল-ব‍্যবহৃত ইলেকট্রিক মোটরের আদি পূরূষ।

Michel Faraday, England

Faraday experiment : from current flow to rotation

 

এটা 1821 সালের কথা ।কিন্তু এই সাফল‍্যের অগ্রগতি রুদ্ধ হলো এক বিচিত্র কারণে। ফ‍্যারাডে এই অভূতপূর্ব পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সময়ে এর পেছনে ডেভি বা ওলস্টনের অবদানের কোন উল্লেখ করেন নি। এতে তিনি ডেভির বিরাগভাজন হন। ডেভি ছিলেন ফ‍্যারাডের ঊর্দ্ধতন কতৃপক্ষ, কর্মস্থল রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটে । এই ঘটনার পর ফ‍্যারাডেকে রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটের ইলেকট্রোম‍্যাগনেটিসমের পরীক্ষা থেকে সবিয়ে অন‍্য পরীক্ষায় রাখা হয়। ফ‍্যারাডে রয়‍্যাল ইন্সটিটিউটে ইলেকট্রোম‍্যাগনেটিসম পরীক্ষা নিরীক্ষার আবার সুযোগ পান এর 10 বছর বাদে, 1831 এ ডেভির মৃত‍্যুর পর। তখন ফ‍্যারাডের বয়স 40।

 

কারণ ব‍্যাখ‍্যার সন্ধানে
নতুন তত্ত্বের খোঁজ, নতুন সূত্রের খোঁজ

 

ভোল্টা, ওরস্টেড বা ফ‍্যারাডের ওপরে বলা পরীক্ষাগুলো ছিলো বস্তুর অন্তর্নিহিত প্রকৃতিদত্ত ধর্মের চমকপ্রদ প্রদর্শন। তাতে অভিনবত্বের চটক ছিল, অভাবনিয়ের বিস্ময় ছিল, পরবর্তি কালে মানবজীবনে কাজে আসবার ইঙ্গিত ছিলো। কিন্তু সেই প্রকৃতিদত্ত ধর্মকে করায়ত্ত করতে গেলে বস্তুর পাকৃতিক আচরণের রহস‍্যটা জানা চাই।

একদল বিজ্ঞানি যখন বস্তুর প্রাকৃতিক ধর্মের নতুন নতুন দৃশ‍্যমান প্রভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তখন আরেকদল সেই সমস্ত আচরণের কারণ খূঁজতে কাজ করেছেন।

এই পর্যায়ে প্রথমেই নাম আসবে জার্মানির জর্জ ওহমের। ওহম ছিলেন এক অসচ্ছল শ্রমিক পরিবারের সন্তান। বাবা অনেক কষ্টে তাকে স্কুলে পড়িয়েছেন। স্কুলে তার অঙ্কে অসাধারণ মেধা সকলের নজরে আসে। বড়ো হয়ে অনিয়মিত উপার্জনের অনেক আঁকাবাঁকা রাস্তা ঘুরে শেষে 1817 সালে তিনি কোলনের এক স্কুলে শিক্ষকতার পদ পান। সেই স্কুলে একটা ভাল ফিজিক্সের ল‍্যাব ছিল যা ওহম ব‍্যবহারের সুযোগ পান। তখন তার বয়স 28।

1820 র ওরস্টেডের পরীক্ষা থেকে কাজ শুরু করে ওহম প্রথম বার তারের ইলেকটিকাল রেজিস্ট‍্যান্সের ধারণা দেন যেটা তখনকার বিজ্ঞানীমহলের কল্পনায় ছিলো না। নানান পরীক্ষা চালিয়ে তাদের ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি 1827 সালে প্রকাশ করেন তার সূত্র যার সহজতম রূপ হচ্ছে V = I. R এতে তিনি পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স, Intensity of current flow আর রেজিস্ট‍্যান্সের ধারণার প্রবর্তন করেন যেগুলো তখনকার প্রচলিত চিন্তাধারায় ছিলো না।

এই তত্ত্ব এবং সূত্র অবিশ্বাস‍্য ভাবে সহজ ও সরল ছিল। কিন্তু এর পেছনের মতবাদ গুলো ছিল নতুন। রেজিস্ট‍্যান্সের ধারনাটা তখন বিঞ্চানীমহলে ছিল না। সেটা যে ক্ষেত্রবিশেষে কমবেশী হতে পারে, হয়ে পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে সেটা তখনও জানা ছিল না। এত সরলীকৃত সূত্র এবন তার প্রেক্ষাপটের তত্ত্ব জার্মানির বিজ্ঞানী মহলে গ্রহণযোগ‍্য হলো না। প্রকৃতির রহস‍্যের এত সহজ উদঘাটন জার্মানির বিঞ্চানীমহলের কাছে নিছক গল্পগাথা বলে মনে হল। ওহম এত বিদ্রুপ, অবমাননা, অপযশের শিকার হলেন যে তিনি কোলনে তার স্কুলের পদ থেকে ইস্তফা দেন।

( কিন্তু কয়েক বছরের মধ‍্যেই ইংল‍্যান্ডের কয়েক বিজ্ঞানী ( স্টার্জন, হুইটষ্টোন ) তাদের উল্লেখযোগ‍্য পরীক্ষার পেছনে ওহমের অবদান স্বীকার করেন। 1840 সালে লন্ডনের রয়‍্যাল সোসাইটি এই সূত্র আবিষ্কারের জন‍্য তাকে Copley Medal প্রদান করে।)

 

Part 6 B

*সমসাময়িক আরো নতুন তত্ত্ব ও সূত্র
অ‍্যামপিয়ার, 1827 সাল*

 

নতুন তত্ত্ব ও সূত্রের ক্ষেত্রে পরবর্তী অবদান ফ্রান্সের আঁন্দ্রে মেরী অ‍্যামপিয়ারের।

অ‍্যাম্পিয়ারের জন্ম 1775 এ, ফ্রান্সের এক ধনাঢ‍্য পরিবারে। বাবার ইচ্ছেয় তিনি স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে বসেই প্রচুর পড়াশুনা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ে – অঙ্কশাস্ত্র, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, দর্শণশাস্ত্র, ভ্রমন, কাব‍্য ইত‍্যাদি। কিন্তু মাত্র 17 বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে (ফরাসী বিপ্লবে গিলোটিনের বলি) এবং পারিবারিক সম্পদ হারান। হাতে কোন প্রথাগত ডিগ্রী নেই – প্রথাগত ভাবে স্কুলে যান নি, পারিবারিক সম্পদ হাতছাড়া। ছিল শুধু অঙ্কের ওপর অসামান‍্য ব‍্যূৎপত্তি আর নিজের অন্ন-সংস্থানের দায়। 22 বছর বয়সে 1797 তে, জীবনপালনের জন‍্য তিনি এক ফ্রিল‍্যান্স অঙ্কের শিক্ষক হন লিয়ঁতে। সেখানে শিক্ষকতায় তার আকাশ ছোঁয়া নাম হয় এবং সেই সুখ‍্যাতির জোরে ক্রমে 1804 সালে প‍্যারিসে এক স্কুলে সাধারণ টিউটর হিসেবে সূযোগ পান। সেখানেও তার আশ্ঢর্য‍্য পড়ানোর ক্ষমতার জন‍্য 5 বছরের মধ‍্যে সেই স্কুলেরই প্রফেসর নিযুক্ত হন, কোন প্রথাগত ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও। সেটা 1809 সাল।

এই স্কুলে প্রফেসর থাকাকালীনই 1820 সালে তিনি দেখেন ওরস্টেডের পরীক্ষার ডেমো। তখন তার বয়স 45। আর তিনি তখন বিজ্ঞানের এই নব-আবিস্কৃত ধারার ওপর পরবর্তী গবেষণা চালাতে সবচেয়ে সক্ষম ব‍্যক্তি।

ওরস্টেডের পরীক্ষা থেকে জানা তো গেল যে ইলেকট্রিসিটি আর ম‍্যাগনেটিসমের মধ‍্যে একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু কি সেটা ?

ওরস্টেডের আবিষ্কারকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অ‍্যামপিয়ার দেখালেন যে দুটো পাশাপাশি তারে বিদ‍্যুত প্রবাহ চললে সেই তার দুটো নিজেরাই পরস্পরকে আকর্ষন বা বিকর্ষণ করে, সেই আকর্ষণ/বিকর্ষণের জন‍্য ম‍্যাগনেটের দরকার পড়ে না। অ‍্যামপিয়ার এই ধর্মের নাম দিলেন ‘ইলেকট্রো-ডায়নামিজম’।

এই সাড়া-জাগানো আবিষ্কারের সাথে সাথে আবার শুরু হল এই ধারায় নানা সম্ভাবনার পরীক্ষা নিরীক্ষা।

অ‍্যাম্পিয়ার এক গাণিতিক এবং ব‍্যবহারিক থিয়োরীর রূপ দেবার চেষ্টা করলেন এই সম্পর্কটার একটা ব‍্যাখ‍্যা দিতে। এই ধর্মের প্রভাবের বাহ‍্যিক দিকটার ব‍্যখ‍্যা তিনি দিলেন এক ইলেকট্রা-ডায়নামিক মলিকুলের প্রস্তাবনা করে। তিনি বললেন যে এর কারনেই বিদ‍্যুত প্রবাহ বা আকর্ষনটা হচ্ছে। এই মতবাদ দিয়ে বর্তমান পরীক্ষার ফলাফল ব‍্যখ‍্যা করা গেলো, ভবিষ‍্যত পরীক্ষার ফলাফলের পূর্বাভাষ দেয়া গেল। রূপ পেল অ‍্যামপিয়ারের ফোর্স ল’। সেটা 1827 সাল।

Andre Marie Ampere, France

 

এতই যুগান্তকারী ছিল সেই স‍ূত্র যে তা নিয়ে 50 বছর পর আরেক দিকপাল বিজ্ঞানী ম‍্যাক্সওয়েল বললেন – The whole theory and experiments seems as if it had leapt, full grown and fully armed, from the brain of ‘Newton of Electricity’. It is perfect in form, unassailable in accuracy and it is summed up in a formula form from which all the phenomena can be deduced and which must always remain cardinal formula of Electrodynamism.

এই সূত্র 30 বছর আগে আসা কুলম্ব সূত্রকেও অনুসরণ করে। প্রায় 100 বছর পরে আইনস্টাইন- হ‍্যাস এফেক্ট এই সূত্রের প্রামান‍্যতা প্রতিপন্ন করবে।

 

আবার নতুন এক্সপেরিমেন্টের প্রদর্শপ : ম‍্যাগনেটকে নাড়িয়ে বিদ‍্যুত প্রবাহ উৎপন্ন করা

 

ওরস্টেডের পরীক্ষা ছিল যে বিদ‍্যুত প্রবাহিত হলে ম‍্যাগনেট নড়ছে। এবার চেষ্টা করা হলো সেটার উল্টোটা করার। মানে, ম‍্যাগনেট নড়লে কি বিদ‍্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে ?

এই ধারাতেও মূল কাজ মাইকেল ফ‍্যারাডের। এই পর্যায়ে ফ‍্যারাডে তিন ধাপে এগিয়ে শেষে বিদ‍্যুত প্রবাহ উৎপন্ন করেছেন।

 

প্রথম ধাপে 1821 সালেই। ফ‍্যারাডে একটা ফাঁপা কার্ডবোর্ডের টিউবে তার পেঁচিয়ে কয়েল বানিয়ে (বিদ‍‍্যুত বিহীন) টিউবের ফাঁপা জায়গায় এক ম‍্যাগনেট প্রবিষ্ট করালেন। তাতে সেই কয়েলে বিদ‍্যুৎ উৎপন্ন হলো।

 

Cardboard coil and magnet experiment

 

দ্বিতীয় ধাপে, একই বছরে ফ‍্যারাডে প্রথম ফাঁপা কার্ডবোর্ভ কয়েলের (বিদ‍্যুতহীন) ফাঁপা জায়গায় আরেকটা কয়েল ঢুকিয়েছেন যাতে বিদ‍্যুত প্রবাহ আছে। তাতেও প্রথম কয়েলে বিদ‍্যুত উৎপন্ন হয়েছে।

Cardboard coil and magnet experiment

 

তৃতীয় ধাপ আসতে 10 বছরের বিরতি। কারণ ডেভি-ফ‍্যারাডে সংঘাত। সেটা পেরিয়ে 1831 এ এসে ফ‍্যারাডে একটা লোহার রিংএর একপাশের আর্দ্ধেকটাতে তামার তার দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়ালেন। সামান্র তামার তার, তখনকার দিনে মেয়েদের টুপি বানাতে লাগতো সেই তার। লোহার রিং আর তারের মধ‍্যে তুলো দিয়ে ইনসুলেশান তৈরী করলেন। এভাবে লোহার রিং এর আর্দ্ধেক জুড়ে একটা কয়েল পেঁচিয়ে গেল। বাকি আর্দ্ধেকটাতেও আরেকটা কয়েল পেঁচিয়ে নিলেন। এখন রিং এর দু পাশে দুটো আলাদা কয়েল জড়ানো।
সেই দুই কয়েলের একটার সাথে ভোল্টাইক পাইল দিয়ে বিদ‍্যুৎ প্রবাহের ব‍্যবস্থা। অন‍্য কয়েলটাতে গ‍্যালভানোমিটার জোড়া, যদি এই কয়েলের মধ‍্যে দিয়ে কোন বিদ‍্যুৎ প্রবাহিত হয় তা জানার জন‍্য।
প্রথম কয়েলের সাথে জোড়া হল বিদ‍্যুৎ প্রবাহ। তাতে
দ্বিতীয় কয়েলের গ‍্যালভানোমিটারের কাঁটা নড়ে উঠলো। বিদ‍্যুত তৈরী হয়েছে দ্বিতীয় কয়েলে। কোন রকম ঘর্ষণ ছাড়া, কোনো রকম নুন-জল বা ইলেকট্রৌলাইট দ্রবণ ছাড়া, কোনো রকম অ‍্যানিমাল ইলেকট্রিসিটির প্রভাব ছাড়া।

Faraday’s original coil as used im his experiment.

 

Faraday’s coil experiment, schematic diagram.

 

নিঃশব্দে পৃথিবী পা দিল এক নতুল দিগন্তে। তবে ব‍্যাপারটার পেছনে যে ইলেকট্রো ম‍্যাগনেটিক ইন্ডাকশন সে তত্ত্বটি জানতে আরো কয়েক বছর লেগে যাবে।

ফ‍্যারাডের সেই দু কয়েলওয়ালা নিজের হাতে তৈরী লোহার রিং আজও লন্ডনের ফ‍্যারাডে মিউজিয়ামে (রয়‍্যাল ইন্সটিটিউশন) সযত্নে প্রদর্শিত আছে। 1931 সালে মানবকল‍্যানে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা এই আবিষ্কারের শতবর্ষ-পূর্তি উপলক্ষে লন্ডনে এক বিশাল আয়োজন করা হয় যাতে সারা বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা যোগ দিয়েছিলেন। এখন এর দ্বিশত বার্ষিকিও প্রায় এসে গেল।

 

(এর পর পরের সংখ‍্যায়)

   

ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কার, Part 6 – Amitabh Moitro & Madhab Kumar Pal

One thought on “ইলেকট্রিসিটির আবিষ্কার, Part 6 – Amitabh Moitro & Madhab Kumar Pal

  • August 8, 2023 at 5:45 pm
    Permalink

    এই ধারাবাহিক অত মূল্যবান লেখাটি একসাথে বই হিসেবে বেরোলে তা গঙ্গা-জুয়ারি’র অবিস্মরণীয় অবদান হয়ে থাকবে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *