উজবুক উবাচ – কুন্তলা ভট্টাচার্য

(A regular column, in Bangla, by Ms. Kuntala Bhattacharya)

উজবুক-উবাচ ।
পর্ব -১

এখন পরীক্ষার সিজন। মহামারী-উত্তর নানা জল্পনা কল্পনার পর রাজ্যব্যাপী দশম শ্রেণীর পরীক্ষা অবশেষে নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষা-মরশুমে আমরা রোবট হয়ে যাই। আমরা মানে যারা পড়াই-টরাই ,আর কী। যে শব্দদ্বয় ব্যবহার করলাম, তার মধ্যে ব্যঙ্গ আছে, ধরতেই পারছেন। আসলে আমরা ‘টরাই’ অঞ্চলের কর্মী – একথা বললে বেয়াদবি হয়ে যায়। এমনিতেই আমরা নু্্যব্জ, ভীরু জাতি। কথায় কথায় শুনতে হয়, শিক্ষক হয়ে এ কাজ করতে পারে! আর সরকারি শিক্ষক হলে তো কথাই নেই। কাজ না করে ই মাইনে পায়। বসে বসে মাইনে নেয় অতেব পান থেকে চুন খসলেই মারো হতচ্ছাড়া মাস্টার দিদিমণিগুলাকে। জাতরাগ আছে জেনেই আমরা খুব সংকোচে থাকি। এই না জানি,কী থেকে কী হয়! পড়ানোর থেকে টরানো বেশি হোক না বাবাঃ, কী আছে তাতে? মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন, সাইকেল, অ্যাকাউন্টে টাকা, বিভিন্ন প্রকল্পের সুচারু বিলিবন্দোবস্ত আমরা করে থাকি। ঐজন্য বললাম: টরাই অঞ্চলের কর্মী। আর রোবোটিক। ওপরমহল থেকে সময়ে সময়ে চিঠি বার্তা আসে। অনায়াসে সেগুলো চিবিয়ে নি। চিঠি স্টাফরুমে পড়া হলে, ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে যায় ‘ ইতনা সন্নাটা কিউ হে ভাই”। সিরিয়াস শোকসভা। এই যেমন, দশম শ্রেণীর পরীক্ষা নিয়ে চিঠি এল সেদিন। রোবোটিক ব্রেইনে আমরা সব নিয়ম ভর্তি করে নিলাম। বুঝলাম, পরীক্ষার্থী সব একেকটা চোর। আমরা পুলিশ। রাজ্যব্যাপী চোর পুলিশ খেলা হবে। প্রত্যেকবারেই হয়। চিঠির নির্দেশ আমাদের মাথায় প্রসেসিং করছি,টের পাচ্ছি, আমাদের চরম শত্রু আসলে ঐ পরীক্ষার্থীরা। দুর্বিপাকে ফেলে দেওয়াই ওদের উদ্দেশ্য। সদাজাগ্রত ওপরমহল এজন্য আমাদের সুবিধার্থে এসব ব্যবস্থা করছে। প্রতিটি শিক্ষালয়ে থাকবেন একজন করে জেলর— আস্রানি-তুল্য জেলর। আংরেজোকি জমানার জেলর ব’লে কতা।

চিঠির নির্দেশ-নামা আমাদের বিপত্তারিণীর সুতো‌। হাতে গলায় ঝুলিয়ে এবার ফিল্ডে নামা। ওঃ বাবা ঃ ফিল্ডে নেমে দেখি,এ তো গ্রীনিচ মানমন্দির। যেদিকে তাকাই সেখানেই সব ঘড়ি। ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডের কাঁটা দেখতে দেখতে চোখে ধাঁধা লাগে। অ্যালিসের সাদা খরগোশের মতো কিনকিন করি: I’m late, I’m late. এগারোটা বাজলো। রণপায় একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।

এগারোটা চল্লিশ। চল্লিশ চোরের মাঝখানে আমি তখন আলিবাবার ফিমেল ভার্শন। মেয়েটাকে নাম্বার শেখাতে গিয়ে ইউটিউব দেখেছি। নম্বর থেকে কী কীভাবে পশুপাখি এঁকে দেয় ওরা! চারের ইংরেজি 4 আঁকতে গিয়ে হাঙর একেছিল, মনে পড়ছে। এগারোটা চুয়াল্লিশ ঘড়ির কাঁটায় এলে দুটো হাঙর করাত নিয়ে এগিয়ে আসছে যেন। এগারোটা চুয়াল্লিশেই প্রশ্নপত্র কাটতে হবে। সিল করা প্রশ্নপত্র ছিঁড়তে ছিঁড়তে পরীক্ষার্থীদের দেখাতে হবে: এই দেখ, প্রশ্ন কিন্তু আমরা ফাঁস করিনি। তোদের সামনে এই খুললাম দেখে নে। পরীক্ষার্থী-প্রীতি দেখাতে গিয়ে আমাদেরই কেউ কেউ হয়ত আগে ভাগে প্রশ্ন খুলে দেখে বিলিয়ে দেন। আমরা যে ততটা বিধর্মী নই, তাই প্রমাণ করতে হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে পরীক্ষার্থীর মনে যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকে তার জন্য এই ব্যবস্থা। ঘরের শত্রু বিভীষণ থাকে,সে বিচার করা ঠিক। শিক্ষক শিক্ষিকা তো কী হয়েছে, তুমিও বাপু কালশাপ হতেই পারো। তোমাকেও বিশ্বাস করি না। আমরা বয়সে ছোট ছোট ব’লে আমাদের চোখে ধুলো দিতে পারো না তোমরা। আমরাই তো ভবিষ্যৎ নাগরিক। বৃহত্তর জগতে আমাদের ঠকতে হবে,তার মোকাবিলা করতে শিখতে হবে না আমাদের? শেখার শুরুটা অতএব এখান থেকেই হোক। হ্যাঁ আমরাও তোমাদের সন্দেহ করি। মহাভারত শুরু হওয়ার আগে ‘ ম্যায় সময় হু’ বলে ভাষ্যকার ঘটনার খেই ধরিয়ে দিতেন। কেন জানি, আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে পরীক্ষার্থীরা যেন খুনখুনে গলায় ওরম বলে যায়।

প্রচন্ড ভীতু মানুষ আমি। টিভিতে ভূতের সিনেমা দেখে একা একা বাথরুমে যাই না। এগারোটা চুয়াল্লিশেই যদি অলৌকিক সমবেত স্বরে শুনি : আমরা আপনাদের, আপনাকে সন্দেহ করি— কার তখন মাথার ঠিক থাকে বলুন? দিদা শিখিয়েছিলেন, ভূতের মুখে রামনাম ছিটিয়ে দিলে ভয় দূর হয়। সেই বাক্যতাবিজ বের করি। গলা খাকারি দিয়ে সবাইকে চুপচাপ বসে থাকতে আদেশ দিই। ফাঁকা আদেশ। খাতা বিলি করে দিই। রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর খুব সাবধানে ঠিক করে লেখার জন্য সতর্ক করি। চারপাশটা ভয়-কম্বলে মুড়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কারণ আমিও যে ওদের সন্দেহ করি। আমরা দুপক্ষই একে অপরকে টেরিয়ে মেপে নিই। অনিশ্চিত সন্দেহ আমাদের বাটখারা। হায় রে, আমার হাজার হাজার বছরের পুরনো ছাত্র শিক্ষক!!!! তোমাদের সংস্কার আমাকে এখনও ধাওয়া করে। পাঁজা কোলা করে ছুঁড়ে ফেলে মনোহরপুকুরে। এই পুষ্করিণীর দেশ নেই, সময় নেই। অথচ যখন তখন ধাক্কা মেরে জলে ফেলে। ডুব দিলে ওষ্ঠপুটে বিন্দু বিন্দু জলের গুটিবসন্ত। বাসন্তী বাহারে তারা উচ্চারণ করে : তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ ( অধীত বিদ্যা আমাদের উভয়কেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই যেন তেজোদীপ্ত করে। আমরা পরস্পরকে যেন বিদ্বেষ না করি)। ওহে আমার সংস্কারতুতো অগ্রজরা, তোমাদের অ্যাডাল্টহুডের আর মনোবিজ্ঞানের দখলদারিত্ব নিয়ে এতযুগ পরে আমার মতো দ্বিতীয় লিঙ্গের মানুষ বড় চমকে যায়। তোমাদের সময়েও ছিল বিদ্বেষী ছাত্র শিক্ষক আর তারজন্য প্রার্থনায় তোমরা অন্তত চেষ্টা করেছিলে, ঐ নঞর্থক সম্পর্ক থেকে উত্তরণের। এ কম কথা নাকি। অতীতমুখী যাপনের সঙ্গে আজকের যাপনকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় থাকবো আজীবন। যতটুকু সম্ভব।

(সমাপ্ত)

 

লেখিকা পরিচিতি:

কুন্তলা ভট্টাচার্য। মেজাজে বাঙাল,চলনে ঘটি। পুরনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শখ। গান অন্ত প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ,স্বামী বিবেকানন্দের সময়কার কোলকাতা দেখার ভীষণ ইচ্ছে। উত্তর কোলকাতার বিশেষ ভক্ত। বর্তমানে শিশুকন্যার মা হিসেবে নিজেকেও তার সমবয়সী ভাবতে সাহস রাখে। পেশা: পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী স্কুলে দর্শনের শিক্ষিকা।

উজবুক উবাচ – কুন্তলা ভট্টাচার্য

4 thoughts on “উজবুক উবাচ – কুন্তলা ভট্টাচার্য

  • March 15, 2022 at 6:01 pm
    Permalink

    চা নিয়ে চমৎকার উপভোগ্য রচনা।

    Reply
    • March 20, 2022 at 3:48 am
      Permalink

      চা নিয়ে আমাদের মতো চা-তাল আছে যারা, তাদের কাছে এই লেখাটি সত্যি উপভোগ্য

      Reply
  • March 19, 2022 at 5:44 pm
    Permalink

    খুব ভাল লেখা, কুন্তলা। ভাল করে পড়লে হালকা কথায় মোড়া অনেক অন্তর্দৃষ্টিময়। দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। লেখার নামটা নিয়ে একটু ধন্দে থাকলাম। পরে বুঝব আশা করছি।

    Reply
    • March 20, 2022 at 3:47 am
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। নাম নিয়ে ধন্দে রাখবো না। খোলসা করে ব’লে দেবো ঠিক ☺️

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *