কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজো (বুড়ি মা) – কুন্তলা ভট্টাচার্য্য

কৃষ্ণনগরের বুড়িমা। এই মাতৃমূর্তি যে পাড়ায় পূজিতা,সে পাড়ার নাম চাষাপাড়া। নিশ্চয়ই কৃষকদের বাস ছিল। কৃষ্ণনগরের একেকটি পাড়ার নাম জীবিকাবাহিত। যেমন – কাঠুরিয়া পাড়া,মালোপাড়া,রায়পাড়া,বাগদীপাড়া,চুনুরিপাড়া। রাজার আমলে, মানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে জীবিকা নির্বাহের জন্য যারা এসেছিলেন,তারা পেশাতুতো ভাইবেরাদার নিয়ে হয়ত community settlement করেছিলেন। এখনকার রাজারহাট নিউটাউন বা ব্যাঙ্গালোরের শহরগুলির বা অন্যান্য শিল্পনগরীর মতো। কৃষ্ণনগরের পাড়াগুলির নাম দেখে, আজকের পেশাকেন্দ্রিক শহরগুলির আদিরূপ বলে মনে হয়। চাষাপাড়ার বুড়িমার ইতিহাস তেমন জানা নেই। Present tense যা অভিজ্ঞতা দিয়ে দিল তা বর্ণনা করা সাধ্যাতীত। শুধু এক বুড়িমাকে দেখতে লক্ষাধিক মানুষ ছুটে আসছেন। গোটা কৃষ্ণনগরে পরিবহন বন্ধ। পায়ে হেঁটে মানুষ যাচ্ছেন। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন স্কুলফেরত বুড়িমার পাশ দিয়ে আসার সময় টের পেয়েছি,কাকে বলে ভীড়!!!!! মা গো মা! মানুষের কালো মাথার রান সেলাই! ঘনসন্নিবিষ্ট।ঐ ভীড় ঠেলে বের হওয়ার থেকে লটে মাছের কাঁটা বাছা অনেক সহজ। পাছড়াপাছড়ি করে কোনো রকমে বের হয়েছি। সব কিছু ছাপিয়ে অবশ্যই বুড়িমার বিসর্জনযাত্রা। শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর অনেক প্রতিমাই যাচ্ছে। উসখুসানি সবার: কখন বুড়িমা আসবে! সারারাত জেগে মানুষ অপেক্ষা করছে। স্কুলছুটির পর পিলপিল করে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে, অভিভাবকের চোখ খোঁজে নিজেরটাকে। বুড়িমা সেই নিজরটাই। দেরি হচ্ছে কেন? কী করছে এতক্ষণ? কপট রাগ দেখাচ্ছে অভিভাবক। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বুড়িমাকে আসতে দেখে রাগ উবে গেল সবার। ভোরের আলো সবে ফুটছে। আলোয় উদ্ভাসিত দেবী। সর্বালঙ্কারভূষিতা। অলঙ্কারের ছটায় আলোকপর্ণা। বাহকদের কাঁধে ধিমিধিমি এগিয়ে আসছেন। ভক্তযাত্রীরা ব্যারিটোন গলায় ‘বুড়িমা-বুড়িমা-বুড়িমা-বুড়িমা’ তালে চাপা হুংকারে ছুটে আসছে। ধা ধা/ দেন্ তা/ কৎ তাগে/ দেন্ তা/ তেটে কতা/ গদি ঘেনে- সমপদী চৌতালমাত্রাই কান শুনতে পাচ্ছে। রাজার বাড়ি যাচ্ছেন জগতের ধারণকারী জগদ্ধাত্রী। প্রজাহিতৈষী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে তুষ্ট করতে বা রাজ অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রজারা ঈশ্বরীকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে রাজদরবারে। কে বড়?
‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা’ – ইন্দ্রের সভায় গণ্যমান্য দেবতারা জমায়েত হয়েছেন। অসুরনিধনের পর যশপ্রার্থী দেবতা একে অপরকে তোষামোদ করছেন। অন্যের পরাক্রম প্রশংসা করলে তার-ও প্রশংসা যদি কপালে জোটে তাই একেক দেবতা অন্য দেবতার গুণগান করছেন। এমন সময়, অদ্ভুত দেখতে এক জীব মাথা উঁচু করে ইন্দ্রের সভায় এল। দেবরাজকে একটা প্রণাম পর্যন্ত ঠুকলো না দেখে ইন্দ্রের মানসম্মান যায় যায়। তার ওপর সেই কিম্ভুতকিমাকার বলে কিনা কোনো দেবতাই পুজো পাওয়ার যোগ্য নয়। ইন্দ্র তো খচে বোম। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। মুচকি হেসে সেই জীব একটুখানি ঘাস দিয়ে বললেন,যে দেবতার যা শক্তি আছে,তাই দিয়ে এই তৃণখন্ডের হেরফের করুন দেখি! অগ্নিদেব প্রথম এলেন পোড়াতে। বনবাদাড় পুড়ে খাক হয়ে গেল কিন্তু ঐ একটি ঘাস যেমন কে তেমন। বরুণদেব,পবনদেব এসেও ভিজিয়ে দিতে পারলেন না, উড়িয়ে দিতে পারলেন না। ডাহা ফেল। তখন টনক নড়েছে ইন্দ্রদেবের। ‘ এ তো মেয়ে মেয়ে নয়’। গন্ডগোল বুঝে ইন্দ্রদেব নত হলেন। অদ্ভুত রহস্যময়জীব বললেন: আমি আদ্যাশক্তি। আমার শক্তিতেই তোমরা বলবান। তোমাদের অহংকার, ঔদ্ধত্য দেখে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি এলাম। শিশু সাহিত্য সংসদের বইয়ের এই গল্প মনে হল আমাদের সবাইকে টার্গেট করুক। পুরাকালে দেবতাদের পৌরুষ তেজস্বীতা ধসিয়ে দিয়েছেন দেবী। এই যুগে নারীদের নিজেদের মধ্যে আকচাআকচি ঘুচিয়ে দিতে দেবী যেন আসেন। এতো বাঁকা কথা, অকারণে অপদস্থ করা, অন্য মহিলার নিন্দামন্দ করে সতীসাধ্বী থাকতে চাওয়া আমরা মেয়েরা যেন জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি। জগতকে ধরে রাখার শক্তিপ্রদার প্রসাদ করপুটে তুলে নিলাম। আমাদের ছোটখাট জগতকে ধরে রাখার শক্তি দিও,মা।
উদারচেতা করো

লেখিকা পরিচিতি:

কুন্তলা ভট্টাচার্য। মেজাজে বাঙাল,চলনে ঘটি। পুরনো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো শখ। গান অন্ত প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ,স্বামী বিবেকানন্দের সময়কার কোলকাতা দেখার ভীষণ ইচ্ছে। উত্তর কোলকাতার বিশেষ ভক্ত। বর্তমানে শিশুকন্যার মা হিসেবে নিজেকেও তার সমবয়সী ভাবতে সাহস রাখে। পেশা: পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী স্কুলে দর্শনের শিক্ষিকা।

 

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজো (বুড়ি মা) – কুন্তলা ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *