পুরোনো by Monojit Majumdar

পুরোনো
মনোজিৎ মজুমদার

পুরোনো গাড়িখানা নিয়ে সুধাংশু ভারী মুশকিলে পড়ে গেল। গাড়িটা তার ছেলের বয়সি। পনেরো বছর আগে কয়েক মাসের ব্যবধানে সুধাংশুর পুত্রলাভ ও গাড়ি কেনা। নিজের গাড়ি নিজেই চালাবে, এই বাসনায় দিনকয়েক কসরত করে গাড়ি চালানো রপ্ত করে ফেলেছিল। তারপর সাতকোশিয়ার জঙ্গল, মন্দারমণির সমুদ্রসৈকত কিংবা কলকাতার জলমগ্ন রাজপথ – সর্বত্রই গাড়ি তার আর তার পরিবারের বিশ্বস্ত সঙ্গী। পরিবার বলতে স্ত্রী কলাবতী আর তাদের একমাত্র সন্তান ধৈবত। গাড়িটাকে সে সন্তানের মতোই যত্ন করে এসেছে।

গত কয়েক বছরে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। বছর চারেক হল, সুধাংশুর পদোন্নতি হয়েছে। কর্তাব্যক্তিরা বিস্তর শলাপরামর্শ করে তাকে দিল্লি পাঠিয়েছেন। অফিস থেকে সে সর্বসময়ে ব্যবহার্য একটি বড় গাড়ি পেয়েছে, সঙ্গে সারথি। সে নতুন গাড়িতেই যাওয়া আসা করে। তার নিজের গাড়িটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে নতুনটির দাপাদাপি দেখে। ছুটির দিনে সুধাংশু তার পুরোনো গাড়িখানির যত্নআত্তি করে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যায়ও বটে। তবে সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে নতুনটিই তার সঙ্গী। তার ও পরিবারের মর্যাদার প্রতীক।

বছরখানেক হল, পিতৃবিয়োগের পর সুধাংশু মা সুচিত্রাকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। সুচিত্রার ভারী চেহারা। হাঁটু দুখানা আজকাল আর সাথ দেয় না। ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলে দুলে হাঁটেন বেশ কষ্টে। আজকাল তাই আর কোথাও যেতে চান না। নাতির সান্নিধ্য আর গল্পের বই নিয়ে তাঁর দিব্যি সময় কেটে যায়। সুধাংশুরা আগে একটু লম্বা ছুটি পেলেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ত। দিল্লির আশেপাশে দু-তিন দিনের জন্য বেড়ানোর জায়গার তো অভাব নেই। সুচিত্রা দিল্লি আসার পরে সে ভ্রমণবিলাসিতায় ব্যাঘাত ঘটেছে। সুধাংশুর তা নিয়ে কোনও হোলদোল না থাকলেও, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা বেড়িয়ে এসে গল্প করলে বা ছবি দেখালে কলাবতী কিঞ্চিত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। তবে মুখে কিছু প্রকাশ করে না। অফিসের পার্টিতে যাওয়ায় অবশ্য কোনও বাধা নেই। নাতি আর ঠাকুমা সে কয়েক ঘন্টা দিব্যি কাটিয়ে দেয়। কলাবতী অবশ্য সুধাংশুর অফিসের সব পার্টিতে যেতে চায় না। অপছন্দ হলে, বাড়িতে অসুস্থ শাশুড়ির অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যায়।

এক শীতের দুপুরে সুচিত্রার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। রবিবার বলে সকলেই বাড়িতে। সুধাংশু তার অফিসের গাড়িখানি সার্ভিস সেন্টারে পাঠিয়েছিল। তার পুরোনো গাড়িটিতেই সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কলাবতী সুচিত্রাকে নিয়ে পিছনে বসল। রাস্তায় পুলিশ গাড়ি আটকাল। গাড়ির বয়স পনেরোর বেশি। তাই গাড়িখানি এখনই জমা করতে হবে। সুধাংশু অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা জানাল। তাতে বিশেষ লাভ হল না। কলাবতী গাড়ি থেকে নেমে চেঁচামেচি করাতে একটি উর্দিধারী গাড়িতে উঁকিঝুঁকি মেরে তার ঊর্দ্ধতনটিকে কিছু বলল। পুলিশ গাড়ি ছেড়ে দিল। সুচিত্রা হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

হাসপাতাল থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেল। কলাবতী আগেই ফিরেছিল। মেট্রো রেলে যাতায়াতের ব্যাপারে সে দিব্যি সড়গড় হয়ে গেছে। একা গাড়ি চালিয়ে ফেরার পথে সুধাংশুর বুক দুরু দুরু। পুলিশে আবার না ধরে। দুই পরিত্রাতার কেউই পাশে নেই। তেমন কিছুই অবশ্য ঘটল না। রাতের দিকটায় পুলিশের লোকজন বড় বড় লড়ি যাতে মালপত্র বোঝাই করে শহরের রাস্তায় অক্লেশে চলাচল করতে পারে, তার তদারকিতে ব্যস্ত থাকেন। ছোট গাড়িঘোড়া নিয়ন্ত্রণের তুচ্ছ কাজগুলি তাই তাঁরা সকালেই সেরে রাখেন। সুধাংশু নিরুপদ্রবে গাড়িসমেত বাড়ি ফিরল। পরদিন সকালে তার বাড়িওয়ালাকে কথায় কথায় গাড়িকাহিনী ব্যক্ত করল। সুধাংশুর বাড়িওয়ালা ব্যবসায়ী মানুষ। জন্মকর্ম সবই দিল্লিতে। তার ব্যাঙ্কে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ আর উদরখানি একইরকম স্ফীত। সে তার পাঞ্জাবী মেশানো হিন্দিতে সুধাংশুকে বলল, ‘দাদা, আমি তো কবে থেকেই বলছি এই খাটারা গাড়ি বিদেয় কর।’ তারপর কিঞ্চিত থেমে বরাভয়ের ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি আন্টির দেখাশোনা কর। আমি এদিকে তোমার গাড়ির ব্যবস্থা করি।’ সুধাংশু অনিশ্চিত ভাবে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি চলল। দর্শকাসন থেকে সুধাংশু তার মাকে ধীরে ধীরে হেরে যেতে দেখল। অবশেষে কাঁচে ঢাকা গাড়িতে চেপে সুচিত্রা তাঁর স্বামীর কাছে রওনা দিলেন। দিল্লিতে সুধাংশুর আত্মীয় পরিজন কেউই নেই। অন্তিম সংস্কারে অফিসের সহকর্মীরাই তার সাথী। যমুনাপাড়ের নিগমবোধ ঘাটে দুপুরের দিকটায় লম্বা লাইন। মহাভারতকালে এই ঘাটে চান করে ব্রহ্মা তাঁর স্মৃতি আর জ্ঞান ফিরে পান। তারপর পথ চিনে তড়িঘড়ি স্বর্গে তাঁর বাসাবাড়ির দিকে রওনা দেন। এখান থেকে নাকি স্বর্গের শর্টকাট রাস্তা। সুচিত্রা স্বর্গে যাবার লাইনে সামিল হয়ে গেলেন।

গাছের ছায়ায় শানবাঁধানো চত্বরে সুধাংশু তার দুই সহকর্মীর সঙ্গে চুপচাপ বসেছিল। বাড়িওয়ালা ফোন করে সহানুভূতি মাখানো গলায় খোঁজ খবর নিল। তারপর বলল, ‘দাদা, তোমার গাড়িটা দেখতে এসেছে। তিরিশ দেবে বলছে। পুরোটাই ক্যাশে। পুরোনো জিনিষ আর না রাখাই ভাল। হ্যাঁ বলে দিই?’ আজ যেন সব পুরাতনকেই বিদায় জানানোর দিন। নবীন রাজার ভাঙা বাঁশিতে মোহন গান আর বাজে না কিনা। সুধাংশু অন্যমনস্ক ভাবে হুঁ বলে ফোন কেটে দিল।

(সমাপ্ত)

About the author


Monojit Majumdar, age about 55 years, works with a nationalised bank. He now lives at Delhi.

পুরোনো by Monojit Majumdar

One thought on “পুরোনো by Monojit Majumdar

  • September 6, 2022 at 3:55 pm
    Permalink

    Purono ke haranor byatha satti kasto deye.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *