মেহেরগড়ের নোবেল প্রাইজ – Goutam Bharaiwala

মেহেরগড়ের নোবেল প্রাইজ

কলমে : গৌতম ভরাইয়ালা

 

মানব জাতির বিজ্ঞান চর্চা

 

মানুষ আদ‍্যিকাল থেকেই বিজ্ঞানী। আবির্ভাবের শুরু থেকেই মানুষ “বিশেষ রূপে জ্ঞান” আহরণের চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। আদিম মানুষের আগুন জ্বালাতে শেখা বা কৃষির আবিষ্কার – এগুলো তো প্রকৃতির সত‍্যেরই উদঘাটন। সে কাজ যারা করেন তাদের তো আজ বিজ্ঞানীই বলা হয়। নেহাত সে সব সত‍্যের ক্রম-উন্মোচনের লিপিবদ্ধ বিবরণ পাচ্ছি না বলে আমরা আদিম যুগের লোকদের সরাসরি বিজ্ঞানী বলি না। তবে মাঝে মধ‍্যে বিখ‍্যাত লোকেদের মুখ থেকে তাদের মান‍্যতা আসে। যেমন সত‍্যজিৎ রায় আগন্তুক সিনেমাতে উৎপল দত্তের মুখ দিয়ে কৃষিকাজের উদ্ভাবনকে বিরাট সায়েন্স বলিয়েছেন। যদি সে যুগে নোবেল প্রাইজ থাকতো তবে হয়তো মেহেরগড়ের (আজকের পাকিস্তান, হরপ্পা সভ‍‍্যতা) কোনো কৃষি বিজ্ঞানী তা পেতে পারতেন। চাষ-আবাদের এক প্রাচীনতম নিদর্শন সেখানে পাওয়া গেছে কিনা!

সে যাই হোক, নোবেল প্রাইজের উদ্ভব তো এই সেদিন, 1901 সালে। অবশ‍্যি তার এক প্রায় 170 বছরের পুরোনো পূর্বসুরীও আছে – কোপলি মেডাল। সেটি চালু হয়েছে 1731 থেকে। এর আগে বিজ্ঞানীদের সেরকম কোন তকমা মিলতো না। 500 BC এর পাইথাগোরাস আজ স্কুলের পাঠ‍্য বইতে জায়গা পেয়েই খুশী। 300 BC র আর্কিমিডিস “ইউরেকা” মোমেন্টেই সীমাবদ্ধ। প্রায় সমসাময়িক দার্শনিকেরা (দার্শনিকরা, কবিরা, লেখকরাও তো এক অর্থে বিজ্ঞানী – তারাও প্রকৃতির এক সত‍্য যা হোল কিনা মানুষের মন, তার রহস‍্য উদঘাটনের চেষ্টা করেন) যেমন সক্রেটিস, প্ল‍্যাটো, অ‍্যারিস্টটল ইত‍্যাদিরাও আজ পরিচিত তাদের কাজের দৌলতে, কোন তকমার বেলায় ঢুঁ ঢুঁ। তবে এদের কারও কারও ভাগ‍্যে রাজা, মন্দির, চার্চ বা মসজিদের পৃষ্ঠপোষকতা মিলেছে। যেমন পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দিতে কালিদাস ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত‍্যের সভাকবি। তবে অনেকেই পড়েছেন রাজরোষের খপ্পরে। যেমন দান্তে (13 শতাব্দী), কোপারনিকাস (16 শতাব্দী), গ‍্যালিলিও (17 শতাব্দী)। হয়তো এরা সকলেই নোবেল লরিয়েট হতেন যদি এদের সময়ে পুরস্কারটা চালু থাকতো।

 

কোপলি মেডাল : নোবেলের পূর্বসুরী

 

নোবেল প্রইজ শুরু হয়েছে 1901 সাল থেকে। আর কোপলি মেডালের (Copley Medal) শুরু এর প্রায় 170 বছর আগে, 1731 থেকে।

ইউরোপে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জোয়ার এসেছিল মূলতঃ রেনেশাঁর সময় থেকে। সেটা একটা টিপিং পয়েন্ট যখন কন্সন্ট‍্যান্টিনোপলের পতন হয় (1453)। নতুন সময়ে মানুষের ভানা-চিন্তার অভিমুখটা ঈশ্বর-চিন্তা থেকে সরে গিয়ে মানুষ-কেন্দ্রিক হতে শুরু করে। প্রকৃতির নানা রহস‍্য উন্মোচনের খেলায় মানুষ মেতে ওঠে। এই খেলার বা অনুসন্ধানের সূত্র ধরে নানান যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে থাকে। 1527 এ কোপার্নিকাসের (পোল‍্যান্ড) হেলিওসেন্ট্রিক থিয়োরি, 1600 সাল নাগাদ গ‍্যালিলিওর (ইটালি) তাতে সমর্থন, 1680 র দশকে নিউটনের (ইংল‍্যান্ড) মাধ‍্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার – এরা সবই মানব সভ‍্যতার ইতিহাসে এক এক যুগান্তকারী আবিষ্কার – game changer.

এই রকম প্রেক্ষাপটে 1660 সালে তখনকার সময়ের ইংল‍্যান্ডের বিজ্ঞানিরা (প্রকৃতির সত‍্য অনুসন্ধানে লেগে থাকা লোকেরা) নিজেদের মধ‍্যে এক গ্রুপের স্থাপনা করেন, মানুষের Natural Knowledge কে বাড়ানোর জন‍্য। শুরুর সেই বিজ্ঞানী দলের মধ‍্যে ছিলেন ক্রিষ্টোফার রেন (লন্ডনের সেন্ট পলস ক‍্যাথিড্রালের পুর্নগঠনের রূপকার), রবার্ট বয়েল (রসায়ন বিদ‍্যার জনক, বয়েল’স ল অব গ‍্যাসের আবিস্কর্তা), জন উইলকিন্স (অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজের অধ‍্যক্ষ) প্রভৃতি। সেই গ্রুপের নাম ছিলো রয়‍্যাল সোসাইটি। লন্ডনে সেটা গঠন করা হয়েছিলো as an invisible college of Natural Philosophers. তার বীজমন্ত্র (motto) ছিলো Nullius in verba. মানে take nobody’s word for it.

এই সোসাইটি ক্রমে বিজ্ঞান নিয়ে ক্রমাগত কাজ করতে থাকে। নিউটনের Principia সমেত অনেক গবেষনা-প্রবন্ধ এখানে প্রথম প্রকাশিত হয় । এই সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হতে পারা সারা বিশ্বে এক বিশেষ কৃতিত্ব বলে মানা হতে থাকে। 2015 তে এই রয়‍‍্যাল সোসাইটি তার 350 বছরপুর্তি উদযাপন করে। কোপলি পুরস্কার বিশ্বের প্রাচীনতম, এখনও চলতে থাকা পুরস্কার।

1709 সালে স‍্যার গডফ্রে কোপলি এক অনুদান দেন লন্ডনের রয়েল সোসাইটিকে, তা থেকে এক বাৎসরিক পুরস্কার দেয়ার জন‍্য। পুরস্কার তাকে দেয়া হবে যে বিজ্ঞানের কোন শাখাতে বিশেষ অবদান রাখতে পারবে। সেই ব‍্যবস্থায় প্রথম কোপলি পুরস্কার দেয়া হয় স্টিফেন গ্রে’কে, 1731 সালে, তার ইলেকট্রিসিটির ওপর নতুন পরীক্ষার জন‍্য। (দ্রষ্টব‍্য – ইলেকট্রিসিটির আবিস্কার, পর্ব 4)। ধীরে ধীরে এটা ইংলদান্ডের সবচেয়ে খ‍্যাতিমান পুরস্কার হয়ে ওঠে। নানা দেশের নানা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এ পুরস্কার পেয়েছেন যেমন আলেজান্দ্রো ভোল্টা, ওরস্টেড, আন্দ্রে মেরী অ‍্যামপিয়ার ইত‍্যাদি। কোপলি পুরস্কারের 170 বছর পরে 1901 সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের প্রচলন হয়।

 

নোবেল প্রাইজের ইতিবৃত্ত

 

স‍্যার আলফ্রেড নোবেল (1832 – 1896) ছিলেন এক সুইডিশ বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ এবং এক অতি সফল আবিষ্কারক। তিনি 1867 সালে ডিনামাইট আবিস্কার করেন ও তার পেটেন্ট নেন। তার নামে 355 টা বিভিন্ন বিষয়ের পেটেন্ট নথিভুক্ত আছে। এত সব আবিষ্কারের পর তিনি এক অতি সফল উদ‍্যোগপতি বনে যান। তার স্থাপিত অনেক উদ‍্যোগের মধ‍্যে একটি, Bofors ভারতে একটি চর্চিত নাম।

1896 সালে তার মৃত্যুর আগে তিনি তার দেশের সুইডিশ অ‍্যাকাডেমিকে এক বিশাল অঙ্কের অনুদান দেন উইল করে। উইলে তার স্মরণে একটা নোবেল পুরস্কার দেবার প্রস্তাব থাকে যা প্রতি বছর দেয়া হবে। দেয়া হবে তাদের যারা সেই বছর মানবজাতির উচ্চতম কল‍্যান সাধন করবেন। নোবেল সাহেব মানব কল‍্যানর 5টা শাখা নির্দেশ করেন – পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত‍্য এবং শান্তি। এই হিসেব মতো 1901 সাল থেকে সুইডিশ অ‍্যাকাডেমি এই 5 টি শাখায় প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার দিয়ে আসছে। এশিয়া ভূখন্ডে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকূর, 1913 সালে সাহিত‍্য শাখায়।

1968 সালে সুইডেনের সেন্ট্রাল ব‍্যাঙ্কের 300 বছর পূর্ণ হয়। সেই উপলক্ষ‍্যে সেন্ট্রাল ব‍্যাঙ্ক সূইডিশ অ‍্যাকাডেমিকে একটা মোটা অঙ্কের অনুদান দেন। ব‍্যাঙ্কের ইচ্ছেয় সেই অনুদান থেকে সুইডিশ অ‍্যাকাডেমি প্রতি বছরে একটা পুরস্কার দিয়ে আসছে অর্থনীতি শাখায়। এর বিজেতাদেরও সুইডিশ অ‍্যকাডেভিই করে থাকে। এর চয়ন পদ্ধতিও পুরনো- প্রচলিত নোবেল পুরস্কারেরই মতো।

সুইডিশ অ‍্যাকাডেমির দেয়া অর্থনীতির এই পুরস্কারকেই সাধারণভাবে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার বলা হয়ে থাকে।

পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, সাহিত‍্য এবং অর্থনীতিতে প্রতি বছর বিজেতাদের চয়ন করে সুইডিশ অ‍্যাকাডেমি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিজয়ী নির্ধারণ করে স্টকহোল্মের Karolinshka Institute.
আর নোবেল শান্তি পুরস্কার নির্ধারণ করে নরওয়ের পার্লামেন্ট।

Insignia of The Royal Society of London

 

They decide the yearly Nobel Prize for Physics, Chemistry and Economics.

 

They decide yearly Nobel Prize in Literature

 

About the Author :
Goutam Bharaiwala is a GZA Member in pseudonym.

মেহেরগড়ের নোবেল প্রাইজ – Goutam Bharaiwala

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *