তিন বাবা – কলম’চি 3 fathers – English translation by A. Moitro (850 words)

তিন বাবা  – কলম’চি   (৮০০ শব্দ)
(English translation is at the end)
আমাদের ছোটো শহরে আমাদের স্কুল বিল্ডিংটা ছিলো এক দেখার এবং দেখানোর মতো জিনিস। বৃটিশ আমলে তৈরী, বয়সে সেটা হীরক জয়ন্তী পার করেছে। সারি সারি আর্চওয়ালা লম্বা টানা বারান্দা, চারতলা সমান উঁচু উঁচু গথিক থামের ওপর দাঁড়ানো গাড়ী-বারান্দা, বিরাট চওড়া সিঁড়ি হাজারদুয়ারির মতো, মেহগনি কাঠের দরজা গুলো দু-মানুষ সমান উঁচু। সব মিলিয়ে  এক রোমাঞ্চকর অনুভুতি, এর বিগত দিনের ফেলে আসা গৌরব মনের ভেতর ছবি এঁকে যায়। দেখে সম্ভ্রম জাগে এই প্রাসাদোপম অট্টালিকার রাজকীয় মহিমায় ও গাম্ভীর্যে ।
একবার এক ছুটিতে আমার এক মামা আর এক মেশোমশাই তাদের ফ্যামিলি নিয়ে আমাদের এখানে বেড়াতে এলেন কয়েক দিনের জন্য ছুটি কাটাতে। সে সময়ে এটাই দস্তুর ছিল। লোকেরা আত্মীয়দের বাড়ি সপরিবারে গিয়ে কয়েক দিন থেকে আসতে পারতো। সকলে মিলে আনন্দ-ফুর্তি-হুল্লোড় করা হতো কয়েকদিন। লোক এলে থাকার কষ্ট কিছুটা হতোই, রাত্তিরে মেঝেতে ঢালা বিছানা পাতা সবার জন্য, সকালে আবার তা গুটিয়ে তুলে রাখা ইত্যাদি । তবে লোকেরা অসুবিধের থেকে আনন্দটাকে মূল্য দিতো বেশি । তাই প্রথাটা চালু ছিল। সেটা ১৯৭১ সাল, আমার তখন ক্লাস XI.
আমরা দূরাগত অতিথিদের আমাদের শহরটা দেখাচ্ছিলাম। সবাই মিলে বেরিয়েছি, ছোটো বড় মিলিয়ে ১১ জন। বোধহয় ৩টে রিক্সায় যাওয়া হয়েছিল। ছোটোরা তো খুশির তুঙ্গে, বড়োরাও তাদের বড়োত্বের মুখোশ নামিয়ে নিজেদের ভালোলাগাটাকে মনের ভেতরে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। শহরের যা সব স্বাভাবিক দ্রষ্টব্য – সিনেমা হল, স্টেডিয়াম, পার্ক, কলেজ ইত্যাদি দেখা হয়ে গেলো। শেষে বাকি থাকলো আমার স্কুল।
সময় হিসেবে সূর্য্যেদেব তখন চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছেন। হাওয়া দিচ্ছে একটু, খানিক দূরেই বয়ে চলা গঙ্গা। দিনের আলোর রং গোধূলি লাল, তাতে সমীপবর্তী রাতের অন্ধকারের  আবছা মিশেল। সকলে আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে সেই বিশাল স্কুল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। সকলেই অভিভূত সেই নান্দনিক বিশালতায় । গর্বে আমিও মনে মনে ফুলছি  এরকম একটা নামজাদা স্কুলে পড়ি বলে।
সেই রকম সময়ে আমাদের দলের এক মহিলা সদস্য ব্যক্ত করলেন তার ইচ্ছে – একটু চা খেতে পারলে বেশ হতো।  তা, বেশ ভালো কথা !
কিন্তু আশেপাশে কোন চায়ের দোকান তো দেখা যাচ্ছে না। আমার চেনা যে জায়গায় গেলে চা পাওয়া যাবে তা খানিকটা দূরে। চায়ের জন্য আবার উল্টো দিকে যেতে কারোরই ইচ্ছে নেই। কি করা যায় এখন ?
তখন একজনের নজরে এলো রাস্তার ওপারেই একটা বেশ বড়ো জায়গা লোহার রেলিং দিয়ে সুন্দর করে ঘেরা, তাতে বাহারি বাগান, তার পরে তিন তলা বিল্ডিং, ওপরে টাঙ্গানো সাইনবোর্ড – ট্যুরিস্ট লজ। তিনি প্রশ্ন এবং পরোক্ষ প্রস্তাব রাখলেন, ওখানে চা পাওয়া যাবে না ? ওটা তো একটা হোটেল মনে হচ্ছে।
আসলে সেটা ছিলো সরকারের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের  একটা উঁচু দরের হোটেল। সেখানে নাকি হুইস্কিও পাওয়া যেতো। হয়তো হোমরা চোমরাদের হাজারদুয়ারী দর্শনের সুবিধের জন্য বানানো হয়েছিলো সরকারি পয়সায় – হাজারদুয়ারী ওখান থেকে কাছেই। তবে শহরের সাধারণ লোকেদের কাছে সেই ট্যুরিস্ট লজ ছিল শুধু রাজনীতিক, সরকারি আমলাতন্ত্র আর অর্থবান লোকেদের আওতা। তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার একটা ঠেক।জনশ্রুতি ছিলো সে সময়ের এক সুখ্যাত স্থানীয় রাজনিতীক অনেকদিন ধরে বহু টাকার হুইস্কি খেয়ে তার দাম মেটান নি। সে যাক,  কিন্তু শহরের সাধারণ লোক সেই ট্যুরিস্ট লজকে একটা ভয় মেশানো অবজ্ঞার চোখেই দেখে এসেছে। সেটার সুবিধেগুলো নিজে ভোগ করার কথা কখনো ভাবে নি। প্রয়োজনও বোধ করে নি, পকেটে রেস্তও ছিল না, স্বপ্নও দেখে নি। তাই কেউই জানতো না ওখানে খাবার-দাবারের কি রকম দাম হতে পারে।
চায়ের প্রস্তাবে তখন সেই রাস্তায় মুখোমুখি একজোটে দাঁড়ালেন তিন বাবা, জল্পনা সুরু হলো নীচু গলায় – ট্যুরিস্ট লজে চায়ের দাম কতো হতে পারে, আমাদের পকেটে থাকা পয়সায় কি তা কুলিয়ে যাবে ? এখন মনে হয় যে সেটা সেই তিন বাবার পক্ষেই কত লজ্জার ব্যাপার ছিলো – নিজেদের শুন্যপ্রায় পকেটের বাস্তবকে সবার সামনে মেলে ধরা !
মিনিট পাঁচেক ধরে আলোচনা চললো এ বিষয়ে। মহিলারাও যোগ দিলেন তাদের মতামত নিয়ে। ছোটরা যোগ দিলো তাদের উদ্দীপনা নিয়ে। শেষে সাব্যস্ত হলো যে নাহ্, এ ঠাঁই আমাদের নহে। পরিণতি – ক্লান্ত, পরাজয়ী পদক্ষেপে দলের বাড়ি ফেরা।
পুরো ঘটনাটা পরে আমাদের কাছে একটা হাসির গল্প হয়ে উঠেছিল। অনেক পরেও ঘরোয়া খোসগল্পের আসরে এই প্রসঙ্গ টেনে আমরা অনেকবার হাসাহাসি করেছি।
এর পর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। বেঁচে থাকার লড়াইটা লড়তে লড়তে এখন এসে পৌঁছেছি রিটায়ারমেন্টের বেড়ার ওপারে। এখন পেছনে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে আসা দিনগুলোকে কখনো কখনো দেখার পালা।
কিন্তু এতটা সময়ের এই দীর্ঘ পারাপার কৈশোরের সেই নিরপরাধ কৌতুককে এখন একটা জ্বালাময়ী তিক্ততায় বদলে দিয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই বোধটা এসেছে য়ে টাকাকড়ি এবং পরিশ্রমের প্রচলিত  ব্যবস্থা আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের থেকে নিয়েছে অনেক বেশি, দিয়েছে যৎসামান্য। সারা জীবন ধরেই এই তারতম্যের বোঝাটা বইতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। এই বেনো জলের ব্যবস্থাটা ঢুকেছে ক্ষমতাভোগীদের কলকাঠিতে। সাধারণ মানুষ সারা জীবন ধরে দুঃসহ শ্রমের নিরানন্দ বোঝা বয়ে গেছে শুধু, তার ফল ভোগ করতে পেরেছে খুব অল্প। গান হীন এ দেশেতে প্রাণ হীন যেথা চারিধার..। ফলের বেশিটাই ঢুকেছে ‘ওদের’ পকেটে। আর সেটাকেই ‘নিয়ম’ বলে চালাতে, অপরাধ-বোধ থেকে ‘ওদেরকে’ মুক্ত করতে অবতারণা করতে হয়েছে হাজারো নীতিকথার/ইজমের জঞ্জাল। উৎসমুখের চিন্তাধারা আর কার্যধারার অনীতি যদি কিছুটা কম হতো, যদি সেই মনোবৃত্তি বৃটিশ জমানার শোষনের মূলমন্ত্রের কিছুটা বাইরে আসতে পারতো তবে হয়তো সেই তিন বাবাদের পকেটে কিছু রেস্ত ঢুকতো তাদের শ্রমের ফসল হিসেবে। হয়তো তা দিয়ে তারা নির্ভাবনায়, আত্মসম্মান নিয়ে ট্যুরিস্ট লজে সপরিবারে চা খেতে পারতেন কালে ভদ্রে। জীবনের কাছে কত সহজ, সরল আর ছোটো চাওয়া এটা ! কিন্তু সেটা হয় নি।
আজ স্বাধীনতা দিবসে এই পুরোনো কথাটা আবার মনে পড়লো। সাথে মনে পড়লো, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হায়ার সেকেন্ডারিতে পড়া এস ওয়াজেদ আলির গল্প – সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলেছে।
(সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি :
কলম’চি (জন্ম ১৯৫৫) শিক্ষায় ছিলেন একজন ইন্জিনিয়ার আর পেশায় ছিলেন এক ব্যাঙ্কার।পেশাগত প্রয়োজনে দেশের নানা প্রান্তে বসবাস। চাকরি থেকে অবসরের পর এখন গোয়াতে থিতু। তিনি গঙ্গা জুয়ারির একজন সদস্য। নেয়া এই নামটা একটা আড়াল মাত্র।
 Three Fathers
          – Translation by
              Amitabh Moitro
My school building was a magnificent piece of architecture in our small town. It was built in the British era, had passed it’s diamond jubilee in vintage, had a long colonnaded verandah with gothic arches and its facade emitted a distinct English aura.
During a vacation, one of my Mamaji and one Chachaji were visiting us along with their families. They stayed with us. We were show-casing our town landmarks to the visiting families. The group of three families that set out for the sight-seeing sojourn of the town on rickshaws was 11 strong. It was 1971 and I was in class XI.
After seeing the regular town landmarks like park, cinema hall,college building, shopping area etc., now it was the turn of seeing our school building.
 The twilight hours was breezy. The group stood awestruck in front of the school building. Then one tired lady member of the group murmured the need of the hour – a cup of tea to the thirsty throats.
But not a road-side tea stall was in sight. Restaurants that can offer tea to suit these families’ pockets are some distance away. But all were too passed off to make that extra strides for having tea.
However, there was a ‘Tourist Lodge’, run by the State Tourism Deptt.  just across the street. It had a restaurant and could offer us tea.
For the town’s people, this joint was held in awe as an elitist joint, may be visited only by the rich and mighty. Common men had never felt the need or courage of pampering themselves in it. They had no idea of its price tags.
It was then a  ‘standing committee’ of 3 family heads(borrowing a current jargon in retrospect) that stood huddled on the roadside to assess the probable cost of a cup of tea in that Tourist Lodge. It must have remained a humiliating task for the 3 men to lay bare the shallowness of their pockets. After some 5 minutes of discussion, with due participation from their better halves and kids, the unspoken realisation of ‘beyond our pocket’ hung around our faces and the group traced their tired steps back to the nearest rickshaw stand to come back home and enjoy the homemade tea.
 The entire episode became a hilarious anecdote to us. We jovially referred to it at many occasions of lighter moments.
50 years has since gone by. I have swam down the great juggernaut called ‘life’ and now relishing its hindsight after retirement.
But the long chasm of time had slowly turned the innocuously humorous anecdote of teens into a bitter sense of gross under-serving to us by the system. An under-service that lasted lifelong for any burnt-out, lived-out common man. An under-service which have been meted out stealthily  by the power-grabbers of the country. In painful steps it dawns upon the common man that the fruit of his lifelong toil, his share in nation’s wealth which he worked for creating has been bleeded by the elite, crooked force of ruling masters, big business and officialdom. And they very skillfully cloaked the bleeding by a bevy of jargons to look it as a God ordained natural course. Simple pleasures of life is kept out of reach of common man. Had there been no such fountainhead loot and carnage, some of the fruits of the created wealth would have reached to the pockets of those 3 common men to pay for an occasional tea at a decent joint like Tourist Lodge in dignified way. This is such a small demand from LIFE  !
Situation remains nearly same after nearly 75 years since then. Today that anecdote had just flashed in mind.
(End)
About the author :
Kalam’chi (b. 1955) was an engineer by training but a banker by profession. Had stayed at different parts of the country in professional assignments. Now after retirement, is settled at Goa. He is a GZA member. Kalam’chi is just a shadow name.
তিন বাবা – কলম’চি 3 fathers – English translation by A. Moitro (850 words)

5 thoughts on “তিন বাবা – কলম’চি 3 fathers – English translation by A. Moitro (850 words)

  • August 15, 2021 at 4:10 pm
    Permalink

    ফেলে আসা দিনগুলি ক্রমশ ধূসর থেকে ধূসরতর। সেই স্মৃতি থেকে লেখক আরো মনি মানিক পরিবেশন করবেন — আশায় থাকলাম। ধন্যবাদ ।

    Reply
    • July 12, 2022 at 12:10 pm
      Permalink

      What a fantastic way of presentation of simple but holistic approach of seeing the Life of a common man

      Reply
  • August 15, 2021 at 5:13 pm
    Permalink

    কত কথা মনে পড়ালেন শুধু কলমের একটি খোঁচা দিয়ে।
    এই ‘চা-চাতক’ মায়েরা আর ‘পলাতক’ বাবারা আমাদের মা-বাবাদেরই প্রতিনিধি।
    তবে, আপনার লেখনীতে যেমনটা, এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে ‘পলাতক’ হতে বাধ্য হওয়া বাবা-রা তৃষ্ণার্তা মায়েদের দ্বারা গঞ্জনার শিকার হননি তাদের সেই অক্ষমতার জন্য বরং হাস্যমুখে তাদের অনুগমনে বাড়ী এসে শরীরের ক্লান্তিকে মনের প্রশান্তি দিয়ে পোষ মানিয়ে চা প্রস্তুত ও পরিবেশনের পর নিজেদেরও হয়তো বা এক কাপ করে প্রশান্তির ‘চাপান’ দিয়েছিলেন, সেই পরিস্থিতিটা বোধ হয় পাল্টাচ্ছে।
    চাহিদা আর যোগানের দৃষ্টিকটু ভাবে ভারসাম্যের অভাব বরাবরই ছিল মনে হয়। বাল্মিকীর আমলেও ছিল, বেদব্যাসের আমলেও ছিল আর এই বাবা-মায়েদের আমলেও ছিল।
    কিন্তু, এনাদের মানসিক দৃঢ়তাকে, শান্তিকে খুঁজে নেবার, এগিয়ে যাবার রাস্তা প্রস্তুত করবার প্রয়াসকে, তা’ বিঘ্নিত করতে পারতো না বলেই মনে হয়।

    না হ’লে, রামায়ণ বা মহাভারতের মত অমন সর্বদর্শী মহাকাব্যেরও সৃষ্টি হ’তো না আর আপনাদের মত এমন সর্বংসহা পুত্রকন্যার গর্ভধারিণীও হতেন না।

    এখন ‘অভাব বোধটার’ও যেন একটা জঙ্গি দৃষ্টিভঙ্গি এসে গেছে।সে কিছুই মেনে নিতে চায় না।সব সময় পাশের জনের সাথে প্রতিযোগিতায় জিততে চায় যে কোনো মূল্যে।
    তা’ সে নিয়মমাফিক হোক বা না হোক, কুছ পড়োয়া নেহি হ্যায়।
    আর, এই বোধটাকেই জাগিয়ে রেখে, উস্কে দিয়ে, রাজার খেলা চলছে তারই বানানো নতুন যুগের নিয়ম অনুযায়ী।

    দারুণ ভাল লাগলো।

    Reply
  • July 4, 2022 at 11:23 am
    Permalink

    Revisiting old memory. Such incidence, we all had in our childhood days. Infact we could never dream something beyound ambit. Now it’s different in the changed environment. Khoob bhalo laglo. Sundar likhecho. E rakam smrity ekhon o mon e padre. Got back to the days of five decades ago for a short while.

    Reply
    • July 19, 2022 at 1:26 pm
      Permalink

      Thank you.
      It’s nice that you could correlate with the content and spirit of the piece.

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *