*(A regular column in Bangla)*

ইতিহাসে পাতিহাঁস

আজকাল ভারতে ইতিহাস­­­­­-চর্চার বান ডেকেছে। ঐ লোকটা এই কথাটা বলছিলেন- তা দিয়ে তাঁর সমগ্র ব্যক্তিত্ব স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে- এসব কথা যখন শুনি তখন মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বলেছিলেন ‘নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা’। আর ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি, যখন সামনে দেখা লোকজন এমন কি নিজের মতিগতি-ই ঘোলাটে ভাবেও বুঝে উঠতে পারি না, তখন এঁরা ত্রেতাযুগের হনুমান আর মধ্যযুগের বাবরের আগাপাশতলা এত স্পষ্টভাবে বোঝেন কি করে? ভাব দেখে ছোটবেলার দুষ্টুমির ছড়া  ‘ইতিহাসে পাতিহাঁস, ভূগোলেতে গোল..” মনে উজিয়ে আসে।

শশী থারুর কিছুদিন আগে কানাডা গিয়ে বলেন, যে দেশের ইতিহাস নেই, সে দেশ ভাগ্যবান।  আমাদের মত ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশে বসে কথাটা হজম করা মুশকিল। আমার মত একজন যে স্কুলে বিষয়টা সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল, তারও যে একটু ধাক্কা লাগে নি তা নয়। কিন্তু, একটু তলিয়ে দেখলে কথাটা একেবারে ফেলে দেবার মত মনে হয় কি?

যারা এখানে বাঁচছে কিন্তু আতীতে বাস করছে তাদের কথা আলাদা, কিন্তু ইতিহাসের প্রতি পুরনো বিরাগবশতঃ ‘ন হন্যতে’র মৈত্রেয়ী দেবী সরব হন। ওই বইয়ে সাধ্বী মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করছেন, যে জ্ঞান দিয়ে আমি অমর হব না তাতে আমার কাজ কি? আমারও প্রশ্ন, যদি দূরেবর্তী অতীতচর্চা আমাদের জীবনকে আরও ভাল করতে না পারে তাহলে হাতের কাছে থাকা ক্ষণিকের বর্তমান ছেড়ে সেখানে ঘুরে বেড়াবো কেন? বিশেষতঃ যখন আমাদের পক্ষে তাকে পাল্টানো অসম্ভব? অতীত আমাদের আয়ত্তাতীত, হাতে আছে শুধু বর্তমান আর তার ফলশ্রুতি হিসেবে কাছাকাছি ভবিষ্যৎ।

পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশগুলো- যেমন মিশর, গ্রীস অথবা মক্কা-মদিনার আরবদেশের এখনকার অবস্থা দেখলে থারুর সাহেব ঠিক বলেছেন মনে হয়। কিন্তু, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের উন্নতি দেখলে মনে হয় ইতিহাস সচেতনতা আর ইতিহাসমুগ্ধতা (ইতিহাসমূঢ়তাও বলা যায়) এক জিনিস নয়। এ দুটোর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল সচেতনতা দুচোখ খুলে রাখে, ভালো মন্দ দুই-ই দেখতে পায় আর মুগ্ধতা ভাল ছাড়া কিছু দেখতে পায় না (তার যমজ ভাই, যে শুধু মন্দ-ই দেখে তাকে কথঞ্চিৎ-এর বাইরে রাখি আজ)।

মানুষের একটা স্বভাব হ’ল অতীতকে বেশী ভাল আর নদীর অন্য পাড়কে বেশী সুন্দর মনে করা। অতীতমুগ্ধ বলেন, ‘আগেকার দিন কত ভাল ছিল, খাবার কত স্বাদু ছিল।‘ সেটা সত্যি, কিন্তু এটাও হয়তো সত্যি যে তখন লোকের গড় আয়ু ছিল এখনকার প্রায় অর্ধেক, আর সামাজিক প্রথা অনুযায়ী বিধবাদের সতী করা বা মাথা মুড়িয়ে কাশী বা মথুরাতে পাঠিয়ে দেওয়া রেওয়াজ ছিল। বহুবিবাহ অতি সাধারণ বিষয় ছিল।

জাপানে গিয়ে দেখি, বাইরে লোকে প্যান্ট-শার্ট পরে অফিস যাচ্ছে আর বাড়িতে জুতো খু’লে ঢুকে মাদুরে বসে চা খাচ্ছে। বেড়াতে গিয়ে দেখি দুটো ধর্ম শিন্টো (আশি লক্ষ ঠাকুর) আর বৌদ্ধ (একমাত্র বুদ্ধ পূজিত) পাশাপাশি ঝগড়া ছাড়াই চলছে। আমাদের এখানে সুশ্রুত হাসপাতাল এলোপ্যাথি’র জোরে চলে, চীনের সরকার তাদের দেশীয় ওষুধের ব্যবহার পাশাপাশি বেশ জোরদার করে তুলেছে। অর্থাৎ, এই দুটো দেশ-ই অতীতকে দেখে বর্তমানের মত-ই তার সত্যিকার চেহারা-ভালোমন্দয় মেশা হিসেবে।

আমার ধারণা, নিটোল খুঁতবিহীন না হলে অতীতকে মানব না এই ধারণার জন্য-ই ভারতের অতি কার্যকর প্রাচীন চিকিৎসা এযুগে উঠে আসতে পারছে না। উদাহরণ, আমরা যেখানে মুঘলদের হাতে দেশীয় রাজাদের পরাজয় মেনে নিতে নারাজ, সেখানে জাপানিরা হিরোশিমা মেমোরিয়ালে লিখে রেখেছে, ‘এত বড় দুর্ঘটনার জন্য নিজেদের দায়িত্ব আমরা অস্বীকার করতে পারি না।‘ এই দোষস্বীকারের প্রতিবাদ হলেও সরকার মেনে নেয় নি।

ইতিহাস নিয়ে আমাদের, সাধারণের প্রশ্ন হওয়া উচিৎ, তাতে কি আছে, যাতে বর্তমানের শান্তি- সমৃদ্ধি বাড়তে পারে? পণ্ডিতরা আরও গভীরে গিয়ে আলোচনা করুন, ভাবুন, বই লিখুন আপত্তি নেই- আগ্রহও নেই বেশী রকম। কোনো আধুনিক বাস্তব বোধসম্পন্ন জাত ইতিহাস পড়ে তার খুঁটিনাটি নিয়ে অন্তহীন লড়াই-এ মাতে না। ট্রাম্প-এর মত লোক খুব অসুবিধায় পড়লেও ডেমোক্র্যাটরা যে দেড়শো বছর আগে দাসপ্রথা সমর্থন করেছিল, তাই নিয়ে খোঁচা দেন না, এঙ্গেলা মেরকেল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে যে, বিশ্বযুদ্ধের ’হেরো’ বলে টিটকিরি দেন না, তার কারণ ‘ওসব করে এখন কোন লাভ হবে না’ এই বাস্তববুদ্ধি। একটা কথা আছে, “A  man grows up the day he has the first laugh at himself.’ নিখুঁত অতীতের কথা যারা বলে তাদের ক্ষমা করতে হবে। এখনো তারা গুরুত্ব পাওয়ার মত বয়সে পৌঁছয় নি ।

রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের কাছে ভারতকে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’- এর স্বর্গলোকে উত্থিত করার প্রার্থনা  করেছিলেন। যুগের প্রয়োজনে আমরা বরং তাকে অতীতের আলোআঁধারির নেশামুক্ত উজ্জ্বল বাস্তবে ফিরে নিয়ে আসার প্রার্থনা করি।।

                                                                                              -অরিজিৎ চৌধুরী

 

About the Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession.

Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves. Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

*(A regular column in Bangla)*

2 thoughts on “*(A regular column in Bangla)*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *