Amitabh Moitro

দুর্গা পূজো
– অমিতাভ মৈত্র

ডগবান খুব মন দিয়ে বুড়ো করছেন এখন আমার বয়সীদের। আর আমরা সেটাকে পাশ কাটিয়ে বড়ো হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাথার চুলগুলো ভগবান লিজে দিয়েছিলেন, লিজ শেষ হতে ফিরিয়ে নিলেন। বাড়ির কাজের মহিলার জল-ভরা বালতি অনায়াসে তোলা নজরে এলো, বুঝলাম শক্তির অ্যাকাউন্টেও এখন ওভারড্রাফট। হিংসে হলো এখন সেটা পারি না বলে। এখন অবস্থাটা এরকম যে … ওই যে দূরে ফুলে ফুলে/ ফাল্গুন উচ্ছসিত কুলে/সেথা হতে আসে দুরন্ত হাওয়া/ লাগে আমার প্রাণে…। সেই হাওয়াটা এখনো দুরন্ত, তার নিমন্ত্রনটা এখনও আছে।

সেই দুরন্ত হাওয়ায় পেছন দিকে ভেসে চলে দুর্গা পূজোর স্মৃতি কখনো রঙ্গীন, কখনো ধূসর, কখনো বা মলিন। নানা সিল্যুয়েটের কোলাজ । শৈশবের পালা তো অভিজ্ঞতা কুড়োনোর, অবাক চোখে দেখা পূথিবীকে। ক্লাস সেভেনে, অঞ্জলি দেবার সময়ে আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে দোলা, মন্ত্র কিছুই বলছে না, ফুল হাতে নিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে শূধু। পুরুত মশাই মন্ত্র বলে চলেছেন… কালী কালী …। তৎক্ষণাৎ দোলার নিজের স্বরচিত মন্ত্র – ব্যোম কালী। এবং বাকি সকলেই না জেনে গলা মিলিয়ে – ব্যোম কালী। সেবারে দেবী এই এডিটেড অঞ্জলিই পেয়েছিলেন। আমরা এ নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম। এখনো মনে আছে সেটা।

অনেক পরে যখন নিজের অভিজ্ঞতার ঝোলাটা একটু ভারী হলো, পুরোনো অভিজ্ঞতাকে রিভিউ করতে যখন সাহসী হলাম তখন বুঝলাম যে তখনি দু বার ফেল করা, পড়াশোনা কম আর বাবার চপের দোকানে অনেক কাজ করা দোলার সেই ব্যোম কালীটা ওর অজান্তেই কতটা সাহসের কাজ ছিলো।

বাবার বদলির চাকরির সুবাদে আমরা কোনো এক জায়গায় বছর তিনেকের বেশি থাকি নি, তারপর সেখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে আবার অন্য জায়গায় তাঁবু গাড়া। আবার নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু। কৈশোরের এই চরৈবেতি কোন বিশেষ জায়গার বা কোন বিশেষ বন্ধুর মোহপাশ তৈরী হতে দেয় নি। জীবনটাকে দেখা ছিল একটা আর্মস লেংথ দূরত্ব থেকে। নির্মোহ নির্লিপ্ততায়। তখন বুঝি নি, কিন্তু এখন টের পাই যে আজকের আমির নির্মাণ সুরু হয়েছিলো সেই তখন থেকেই। সে সময়কার পূজোর স্মৃতিগুলো আজ হারিয়ে গেছে কফি হাউসের সেই আড্ডাটার মতো। তবে মনে আছে কিছু সামান্য ঘটনা। সে সময় অনেকে বাড়ির দরজায় দরজায় ভিক্ষে করতে আসতেন। মহালয়ার কাছাকাছি সময়ে, যখন আকাশে বাতাসে পূজো পূজো ভাবের শিহরণটাকে আমাদের বয়সীদের মনটা ধরতে পারছে, সেই রকম এক সকালে বাড়ির সামনে দিয়ে আমারই বয়সী এক কিশোর বাঁশী বাজিয়ে যাচ্ছে। তাকে বাড়ির ভেতরে ডাকা হলে সে নিজের আত্মমগ্নতায় ভেতরের বারান্দার সিঁড়িতে বসে নিজের মনেই বাজাতে থাকলো। কি সেই সুর তা বোঝার জ্ঞানগম্যি নেই। কিন্তু মনটা যেন সেই বাঁশী শুনে শিহরিত হয়েছিলো। সেই বাঁশী যেন ছিল নরম আলোয় শিউলি ঝরা শিশির ভেজা শরতের সকাল হওয়ারই অঙ্গ। যেমন অনেক পরে গুণীজনেরা বলতেন যে বিসমিল্লা খানের সানাই না বাজলে বেনারসে ভোরই হবে না। এখনও যেন চোখ বন্ধ করলে সেই সকালটা দেখতে পাই, বাঁশীর আওয়াজটা শুনতে পাই।

এটা কি পূজোর গল্প? নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। আমাদের মা দুগ্গা তো আশীর্বাদের অ্যামাজন, সব রকম আশীর্বাদ তার স্টকে। তিনি লক্ষী সরস্বতীর মতো মম অ্যান্ড পপ স্টোর চালান না যে শুধু ধন বা বিদ্যাই পাওয়া যাবে। তাই লোকেরা তার কাছে জেনারেল ওয়েল-বিইং চায়। এক দফা ইচ্ছে পূরণের জন্য হত্যে দেয়া এখানে চলবে না। তার জন্য কালী, শনি এরা তো আছেন। তা জেনারেল ওয়েল বিইং দিতে দুগ্গা একটা উৎসব-উল্লাসের আবহ নিয়ে আসেন। নতুন জামা, খাওয়া দাওয়া। নতুন ভালো লাগা। প্যান্ডালে কৈশোর বা তারুন্যের সদ্য সভ্য পদ পাওয়াদের চার চোখের যে কত সফল এবং বিফল মিলন হয়। সবই উল্লাসের অঙ্গ। সেই হিসেবে ওপরে বলা গল্পটাও উল্লাসের অঙ্গ। তাই সেটা পূজোর গল্প। হরি হে, এ হচ্ছে নদীর রচনা থেকে গরুর রচনায় পৌঁছে যাওয়া।কারণ গরু ছাড়া অন্য রচনা পড়া হয় নি যে !

যৌবনের চৌকাঠে পা দিয়েই জীবিকার প্রয়োজনে সুদূর প্রবাস। রাত নটায় ঘুমিয়ে পড়া এক আধা শহর থেকে রাতে কখনো না ঘুমোনো সেই মহানগরে এসে পড়া। নিজের চোখের চেয়েও বড়ো চোখ মেলে সেই বিশাল উত্তরণের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা। ভাষাও অন্য। তখন পূজো ছিল একটা উইন্ডো শপিংএর মতো।আনন্দ ফুর্তি গুলো আছে, কিন্তু যেন কাচের শোকেসের ওপারে। দেখা যাচ্ছে কিন্তু ধরতে পারা যাচ্ছে না। নিজের আনন্দের জগত নিজেকেই তৈরী করে নিতে হচ্ছে নিজের মনের ভেতর, বাইরের প্রবাহের সাথে তার যোগ থেকেছে সামান্যই। পূজো প্যান্ডালে সুবেশা তরুণ-তরুণীদের ভীড়। ৭০এর দশকে সেখানেই দেখি প্রথম ব্যাকলেস ব্লাউজ বাস্তবে, অতি সুখ্যাত এক বঙ্গ মডেলের গায়ে যিনি তখন গার্ডেন শাড়ির অ্যাড করে প্রায় কিংবদন্তী। সেই সময়েই টাইমসের মিডল পড়ার নেশা জন্মায় যাতে মিতা বশিষ্ঠের একটা লেখা আমাকে নাড়া দেয় অনেকদিন ধরে। পূজোর দিনে তিনি ট্রেনে ফিরছিলেন, এক লম্বা সফর নাগাল্যান্ড (ডিমাপুর) থেকে, কোনো নাটক সেরে। সে লেখাটায় পূজোর উৎসবে সামিল না হতে পারার আক্ষেপকে ছাড়িয়ে বেজেছিলো এগিয়ে চলার সুর – একটা পূজো মিস হয়েছে তো আগামী বছরের পূজো তো আছে।

আরো পরে কোনো ছোটো শহরে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে দুর্গা পূজো শুরু করে সেও এক নতুন রুপে পূজোকে দেখা। এক বয়স্কা মহিলার দুর্গার সামনে অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, তার চোখের জলের নীরব বর্ষণ অত ভীড়ের মধ্যে – এও এক নতুন করে দেখা জীবনকে। উল্লাস উৎসবের পাত্র একদিন ভরে যাবে, মনে মনে চলা শুরু হবে নিস্প্রভ নেপথ্যের দিকে, সঙ্গী থাকবে মন-খারাপের বিষন্নতা। এ সফরটাও শেষ করতে হবে সবাইকেই। সেটাই যেন জানিয়েছিল সেই দৃশ্যপট।

আবার চরৈবতি। আবার জায়গা বদল। নতুন জায়গায় হয়তো যোগাযোগ হতে পারে নি। তাই পূজো এসে চলে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরিয়ে।

ইনিংস এখন টি-র পরের সেশানে। প্যান্ডালে বাবার কোলে কোন বাচ্চাকে দেখে মনে হয় সেই বৃত্তটা আবার অভিনীত হতে চলেছে। চলতে থাকুক উৎসব উল্লাসের ধারা। ধরিত্রী সিঞ্চিত হোক নতুন মাদকতায়।

জয় দেবী।

Amitabh Moitro

17 thoughts on “Amitabh Moitro

  • September 30, 2021 at 8:31 pm
    Permalink

    এই লেখাটি একদম খাঁটি টাটকা শব্দফসল। খাদ্যফসলের গুণাগুণ সব মাথায় নিয়ে নিলাম। এই একই রাস্তায় সবাইকেই হাঁটতে হবে, আগে পরে। তাই মজুত রাখলাম।

    Reply
    • October 26, 2021 at 11:11 am
      Permalink

      ধন্যবাদ।
      পাঠ প্রতিক্রিয়া অবয়বহীন হলেও কলমের ধারা কিন্তু অবয়বকে চিনিয়ে দিচ্ছে !

      Reply
  • October 1, 2021 at 8:00 pm
    Permalink

    খুব ভালো লেখা। অমিতাভবাবু’র লেখায় বারবার বহমান জীবনধারার একটা দার্শনিক ছোঁয়া থাকে। ব্যক্তিগত বিশেষ অভিজ্ঞতাগুলি আর্মস লেংথ থেকে দেখেন বলেই বোধ হয় নির্বিশেষ হয়ে ওঠে। পড়তে পড়তে পুজোমন্ডপে, জীবনের রাস্তায় পাঠক লেখকের পাশে পৌঁছে যায়।

    Reply
    • October 26, 2021 at 11:03 am
      Permalink

      ধন্যবাদ।
      পাঠ-প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত মনোগ্রাহী।

      Reply
  • October 1, 2021 at 11:39 pm
    Permalink

    EXCELLANT AMITABH BABU.

    Reply
  • October 26, 2021 at 3:58 pm
    Permalink

    লেখাটায় সাহিত্যিক ছোঁয়া আছে…. ছোট থেকে বড় হয়ে উঠার সময়ের ভালো লাগাগুলোকে ছবির মত করে লেখায় ফুটে উঠেছে…. ভালো লাগলো.. ভালো থেকো বন্ধু অমিতাভ….

    Reply
    • October 26, 2021 at 5:59 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ।

      Reply
    • October 26, 2021 at 11:11 pm
      Permalink

      খুব ভাল লাগল। অমিতাভ বাবুকে স্মৃতির সাগরে ডুবুড়ি হয়ে ইতিউতি ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে ভাবলাম, একটা ডুবকি আমিও দিয়ে দেখি না। যত গভীরে যাই, মণিমাণিক্যের অধিক্য বেড়েই যায়। যে হীরক খণ্ডটি অমিতাভ বাবু উঠিয়ে এনেছেন, একটু কেটেকুটে নিলেই দিব্যি নিজের বলে চালিয়ে নেওয়া যায়। কতজনের স্মৃতির সলতেটি যে আপনি উস্কে দিলেন, কে জানে! পরের লেখাটির অপেক্ষায় রইলাম।

      Reply
  • October 26, 2021 at 10:58 pm
    Permalink

    মনে হলো যেন পেড়িয়ে এলেম অন্ত বিহীন পথ, লেখকের সাথে সাথে শৈশব কৈশোর যৌবন শেষে প্রৌঢ় হাতছানি দিচ্ছে বার্ধক্য কে এ হেন সময়ে লেখাটি আমাকেও স্মৃতি রোমন্থন করতে বাধ্য করলো। অতি পরিচ্ছন্ন স প্রতিভ লেখার ধরনটি।

    Reply
    • October 26, 2021 at 11:06 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ।

      Reply
  • October 27, 2021 at 4:37 pm
    Permalink

    চমৎকার আগমণীর মণি বিচ্ছুরণ ও বিতরণ। জীবনের রঙ্গমঞ্চে নানান সাজএ আভূষিত হয়ে, নানান পারিপাট্যে ভরপুর মিছিল করে যে সব হৃদয়হরক বা হৃদয়বিদারক চলচ্ছবিগুলি পরপর সরে সরে যায় অথচ প্রায়শই ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে অপারগ হয়, সেই ছবিগুলিই যেন আঁকা হয়ে গেল এই প্রতিবেদনে।
    ‘আঙ্গুলের’ পরিচিত ও অত্যন্ত স্বাভাবিক কিছু বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও মনটা ছু্ঁয়ে যেতে এর কোনো কষ্টই হয়নি।
    জয় মা!

    Reply
    • October 27, 2021 at 11:23 pm
      Permalink

      ধন্যবাদ।

      Reply
  • October 27, 2021 at 7:43 pm
    Permalink

    চমৎকার আগমনীর মণি বিচ্ছুরণ ও বিতরণ। জীবনের রঙ্গমঞ্চে নানান সাজএ আভূষিত হয়ে, নানান পারিপাট্যে ভরপুর মিছিল করে যে সব হৃদয়হরক বা হৃদয়বিদারক চলচ্ছবিগুলি পরপর সরে সরে যায় অথচ প্রায়শই ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে অপারগ হয়, সেই ছবিগুলিই যেন আঁকা হয়ে গেল এই প্রতিবেদনে।
    ‘আঙ্গুলের’ পরিচিত ও অত্যন্ত স্বাভাবিক কিছু বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও মনটা ছু্ঁয়ে যেতে এর কোনো কষ্টই হয়নি।
    জয় মা!

    Reply
  • October 17, 2022 at 5:49 am
    Permalink

    Oshombhob valo lekha,

    Ekta durgapujo..but upnar obhigyota o jatrapoth shoishob thekey prouro.. baro sundor lekhoni upnar..choto bishader choyay kotuk o anondo

    Reply
    • October 17, 2022 at 8:12 am
      Permalink

      ধন‍্যবাদ।
      গুণীজনের থেকে কদর পেয়ে লেখক উল্লসিথ।

      Reply
  • April 18, 2024 at 10:00 am
    Permalink

    এ তো আত্মকথন !
    ভালো লেখা।

    – সোমনাথ সরকার

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *