Arijit Kathanchit : A regular column by Arijit Chaudhuri

অরিজিৎ কথঞ্চিৎ/ অরিজিতের কলম

কবিতা দেখে পালায় লোকে

কবিরা জানেন, ‘একটা কবিতা শুনবি’ বললে প্রিয় বন্ধুরও চোখেমুখে প্রায়ই ‘এই খেয়েছে’ ধরণের একটা ভাব খেলে যায়। ‘শেষের কবিতা’ রবীন্দ্রনাথের শেষ দিকে লেখা উপন্যাস। উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ গদ্য ও কবিতা মিলিয়ে এই প্রেমের উপন্যাসটিতে এমন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন যে ধরলে ছাড়া মুশকিল। আমার ভাল লাগায় স্কুলের এক বন্ধুকে বইটি পড়তে দিয়েছিলাম।  কবিতা’র বই সন্দেহ হওয়ায় ও প্রথমে নিতে চায় নি। গদ্য বলায় বইটা নিয়েছিল। পরে ফেরৎ দিয়ে বললো, কবিতাগুলো বাদ দিয়ে পড়েছি’। এরকম ভণিতাহীন কথা ভাবায়। আমার একটু দুঃখ হয়েছিল কারণ, লেখাটির অচ্ছেদ্য অঙ্গ কবিতাগুলো বাদ দিলে অনেকটাই উপভোগ করা যায় না। আবার, কথাটা সরলভাবে বলায় তাকে উড়িয়ে দেওয়াও সহজ ছিল না।

কেন লোকে (অতি বুদ্ধিমান লোকেও) কবিতা দেখলে পালায়? সেই প্রশ্নের উত্তর পাই নি। ক’দিন আগে পেলাম, নোম চমস্কির কথায়। বললেন, কবিতা হ’ল গাঢ়  (compressed) উচ্চারণ। অনেক ইশারা থাকে যা মনের ক্ষমতা ও কল্পনাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। কথাটা হ’ল, যে শিলং পাহাড়ের প্রকৃতি আর শীলিত মানবপ্রেম  দেখে সময় কাটাতে চাইছে, সে ঐ চ্যালেঞ্জ নেবে কেন? এই জন্যই বহু অন্য ক্ষেত্রে বিদগ্ধ মানুষ কবিতা পড়তে চান না।

মজাটা হ’ল, বেশীর ভাগ কবিতাই ছন্দ মিলিয়ে (অন্ত্যমিল) লেখা।  ছন্দ মানুষকে টানে আর মনে রাখারও সুবিধে। সে জন্যই আদিকালে সব সাহিত্যই ছন্দে গাঁথার চেষ্টা হোত। নিজের দিকে তাকালে সবাই বোঝে গদ্যের এক লাইন মনে রাখার চেয়ে পদ্যের পংক্তি মনে রাখা সহজ। আবার গদ্য কবিতা তো বটেই, ছন্দময় কবিতা’র চেয়ে ছড়া (ছন্দ বাধ্যতামূলক) সবসময় সহজ লাগে। বৃষ্টি নিয়ে দু’টি উদাহরণ,

বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর নদেয় এলো বান,                                                                         শিবঠাকুরের

বিয়ে হ’ল তিন কন্যে দান।                                                                        এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন

এক কন্যে খান,

এক কন্যে রাগ করে বাপের বাড়ি যান। (প্রাচীন ছড়া)

তোমার পাড়ায় শ্রাবণ মানে আজও তেমন বর্ষাযাপন?

কুর্চি ফুলের গন্ধ মাখে সদ্যজাত বুকের কাঁপন?

আজও তেমন সবুজ মাঠে রূপকথারা অবাধ ভেজে?

সদ্যস্নাত কিশোরীরা বৃষ্টিফোঁটায় স্বপ্ন খোঁজে? (তোমার উঠোন- শ্রীজাত)

প্রথমটায় কোন ঝামেলা নেই- যা লেখা, তা-ই বোঝা। দ্বিতীয়টা পড়ে ফেললাম, ভালো লাগলো বটে, কিন্তু বার বার পড়েও, বুঝলুম কি? এই অস্বস্তি যেতে চায় না। তাই এ সব ঝামেলাদার লেখা এড়িয়ে চলতে ইচ্ছে হয়।

তবু দেখছি, যাঁরা কবিতা পড়তে নারাজ, তাঁরাই  ফটাফট ছড়া আউড়ে যান। কারণটি হ’ল ভার। কবিতা সাধারণতঃ গুরুভার। যা লেখে, বলতে চায় তার চেয়ে বেশী। খাদ্য নিয়ে দেখুন-

“খাঁদুবাবুর এঁদো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে,

পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।” (রবীন্দ্রনাথ)

এতে রগরগে রান্নার স্বাদ যেন জিভে উঠে আসে। তার পরে কি হ’ল জানতেও ইচ্ছে করে।

কিন্তু, যখন কৃষ্ণা বসু লেখেন, “গরম ভাতের গন্ধে চমৎকার দুপুর ঘনালো আজ…” তখন আবার পলায়নপরতা গ্রাস করে আমাদের।

কবি-সাহিত্যিকরাও তো বোকা নন। তাঁদের পাঠক না হ’লে চলে না আর বহুবার নানা স্বরে ও সুরে “ভয় পেও না, ভয় পেও না” বলে যে কোন কাজ হয় না তা তাঁদের নজর এড়িয়ে যায় নি।  সব রকম লোক ধরে রাখা আর গভীর চিন্তার রসদ যোগানোর জন্য শুরু হয়েছে স্তরায়িত (লেয়ার্ড) সাহিত্য। এগুলো দীঘির মত, ভেসে চলে যাও বা গভীরে ডুব দাও। সুকুমার রায়ের অবুঝ কবিতার শুরুটি দেখুন।

“চুপ করে থাক্, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভাল না,

এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা।

দেখ্ ত দেখি আজও আমার মনের তেজটি নেভেনি

-এইবার শোন বলছি এখন-কি বলছিলাম ভেবে নি!”

এই ক’টি পঙক্তিতে ওপর ওপর মজাদার কথার আড়ালে ফাঁকা পণ্ডিতি-র অন্তঃসারশূন্যতা যেন তীক্ষ্ণ ছুরিতে ফালাফালা হয়ে যায়।

স্তরায়িত সিনেমা’র আশ্চর্য উদাহরণ হ’ল চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলি। সেগুলি দেখে আবালবৃদ্ধ হাসতে থাকলেও যাঁরা ভাবনাকে ছুটি দিতে পারেন না তাঁদের অন্তরে প্রায়ই অশ্রুধারা বইতে থাকে।

কবিতা তার সরু কাঁধে যে অনেক বড় ভাবনার ভার বইতে পারে, তার কারণ আমার মতে কাব্যগুণ। সেটি কিছুটা কিশোরীর কচি মুখে লাবণ্যের মত, যা মায়ার মত লেগে থাকে, শিশিরে সাগরের আভাস আনে। দেখুন না…

অনেক যেন দূরে কালো চোখ কার আজকে এলো অশ্রুজলে ভরে- এই কথাটি শুনতে মন্দ লাগলো না বটে, কিন্তু সাধারণত্ব ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারল না যেন।  রবীন্দ্রনাথ যখন সেই কথাটিই এভাবে বলেন, “দিগন্তে কার কালো আঁখি আঁখির জলে যায় ভাসি…’ তখন এক বিধুর-মধুর বেদনা যেন তার দিগন্তবিসারী ডানা ছড়িয়ে আমাদের মনের আকাশ আপ্লুত করে ফেলে। আর একটা-

বন্ধু থাকো যে দূরে, জানো কি আমার মনে কত কষ্ট রয়েছে ভ’রে?

“মোর কি বেদনা সে কি তুমি জানো, ওগো মিতা, আমার অনেক দুরের মিতা…” (রবীন্দ্রনাথ)

আজ এ পর্যন্ত। পরের কিস্তিতে বিখ্যাত কিছু কবিতার কাব্যগুণের জামা খুলে ছড়া বানিয়ে ঐ দুটো কেন এক জিনিস নয় তা নিয়ে মজাদার কিছু করার ইচ্ছে রইলো।।

 

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

 

Arijit Kathanchit : A regular column by Arijit Chaudhuri

6 thoughts on “Arijit Kathanchit : A regular column by Arijit Chaudhuri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *