Arijit Kathanchit – by Arijit Chaudhuri

কি হারালেম পথের বাঁকে

সীতার বনবাস উপন্যাসে বিদ্যাসাগরমশাই সীতাকে মুগ্ধস্বভাবা (অর্থাৎ, যে সহজে শঙ্কায় ভোগে না) বলেছেন। আমার প্রশ্ন শুধু সীতা কেন, পুরো মানুষ জাত, আমরা সকলেই কি মুগ্ধস্বভাব নই? খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আর্কিমিডিস ‘ইউরেকা’, ‘ইউরেকা’ বলে রাস্তায় দৌড়নোর পর মোটরগাড়ি, এরোপ্লেন, কলেরার টিকে বা স্টেরয়েড আবিষ্কারের পর যে কত বার মানবসমাজ, বাস্তবে না হ’লেও মনে মনে, সে দৌড় দৌড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। পৃথিবীর জনসংখ্যাবৃদ্ধি দেখে ১৭৯৮ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ থমাস রবার্ট ম্যালথাস খাবার ফুরিয়ে যাবে, মানুষ দুর্ভিক্ষে বা খাদ্যাভাবে মারা যাবে সেই ভয়ে দেড়শ’ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যেই নাইট্রোজেন সার এসে গেল, তার পর সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে এল উচ্চফলনশীল শস্য। মানুষের বংশবৃদ্ধিকে খাদ্য উৎপাদনবৃদ্ধির হার ছাপিয়ে গেল আমরা আবার ছুটলাম। প্রতিবারই মনে হয় এই বুঝি হিল্লে হয়ে গেল আমাদের। আর তার পরেই কিছু একটা ঘটে আর মনে পড়ে যায় বিজ্ঞানী দার্শনিক রিচার্ড ফাইনম্যানের এই কথাটি – “আমার মনে হয় প্রকৃতির কল্পনাশক্তি মানুষের তুলনায় এত বেশী যে তিনি আমাদের কখনই জিরোতে দেবেন না (I think nature’s imagination is so much greater than man’s, she’s never going to let us relax)। প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে তারই সন্তান মানুষের এক অসম, অন্তহীন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’ ধরণের লড়াই চলতেই থাকে।’

বিশ্বনাগরিকের কোট-প্যান্টুলুন চড়িয়ে অস্বীকার করতে চাইলেও, আমাদের শরীরে-মনে, ‘শিরায়-শোণিতে’ জন্মস্থানের নাড়ির টান অন্তরলীন হয়ে থাকে, যেতে চায় না… যায় না। পর্যাপ্ত খাদ্য, মোটরগাড়ি-এরোপ্লেন আবিষ্কারের পুষ্পরাজির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া…হারিয়ে যাওয়া বহু পুরনো জিনিসের স্মৃতি যখন খচ-খচ করতে থাকে, ভাবি, কিই-বা কাজে লাগতো ওগুলো? হঠাৎ কোনো দুর্বিপাক ঘটে বুঝিয়ে দেয় তাদের প্রয়োজন। এক দেশের ধন্বন্তরি ওষুধ অন্য দেশে ঠিক তেমনটি ফল দেয় না। মুগ্ধস্বভাবের জন্যই এলোপ্যাথি চিকিৎসা অপরিহার্য হয়ে ওঠার আগে যে সব ওষুধ আমাদের পূর্বজদের আরাম দিত, প্রাণও বাঁচাত, হারিয়ে গিয়েছে তাদের বেশীরভাগই। করোনা মহামারী যখন প্রকৃতির উদ্ভাবনশক্তির আরেকবার প্রমাণ দিল, আমরা সারা পৃথিবীর মানুষকে একই ভ্যাকসিন দিতে থাকলাম, হয়তো হারিয়ে যাওয়া সেই ওষুধগুলির কোনোটা স্থানীয় পর্যায়ে বেশী প্রতিরোধ ক্ষমতার যোগান দিতে পারত।  

মানুষের পক্ষে সুদূর ভবিষ্যৎকে দেখা মুশকিল বলে কাছের সময়টিকে সামলাতে সামলাতেই তার পথ চলা। আমাদের সময় সীমিত, প্রকৃতির সময় অঢেল। তাই, আজ যা করছি তার কুফল ফুটে ওঠে অনেক পরে। গত শতাব্দীর ষাট-এর দশকে সবুজ বিপ্লবের পর পৃথিবীর জনসংখ্যা যতগুণ বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন। সেই আনন্দে আমরা সমস্ত আগের শস্যকে দূরে ঠেলে শুধু কিছুটা ল্যাবরেটরিতে তৈরী উচ্চ ফলনশীল গোষ্ঠীকে লালন করেছি। এ সব গাছের জন্য বেশী কীটনাশক লাগে কারণ স্থানীয় গাছ-গাছড়া সেখানকার পোকামাকড়ের থেকে নিজেদের যতটা বাঁচাতে পারে, নতুনরা ততটা পারে না। তাছাড়া, দ্বিতীয় জাতটি সাধারণতঃ জল বেশী খায় বলে যেখানে সেটির চাষ হয় সেখানেই মাটির নীচের জলের ওপর নির্ভরতা বাড়ে, জলস্তর নেমে যেতে থাকে।

সত্য নাছোড়। ‘যতই ভাবি না কিছু নেই’, একদিন সে জেগে উঠে অতি বোদ্ধা গর্বিত মানুষের ঝূঁটি ধরে নাড়া দেবেই। জার্মানিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় গাছ অনেক বেশী। সে দেশে গ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী জমি তিনটে ভাগ করা হয়- এক ভাগে বাসস্থান, এক ভাগ চাষের জমি আর তৃতীয় ভাগ বন। অনেক আগে থেকেই তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠা গাছ নিয়ে আগ্রহ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুনর্নির্মাণের চাহিদায় অতি উৎসাহে স্থানীয় অনেক পুরনো গাছ কেটে ফেলা হয়। তারপর তাড়াতাড়ি বন তৈরির জন্য আমদানী করা হয় দ্রুত  বেড়ে ওঠা প্রজাতির গাছ। তার ফলে যে সব নতুন সমস্যার উদ্ভব হয় তাদের সামলাতে জার্মানির মানুষ ইদানীং ‘ভোকাল ফর লোকাল’ হয়ে স্থানীয় গাছ-পালা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

 

এক রকম খাবারে আসক্ত হওয়ার বিপদ ভয়ঙ্কর ভাবে ফুটে ওঠে ১৮৪৫ সালের আয়ারল্যান্ড-এ। সেখানে প্রধান খাদ্য লাম্পার  আলু (Lumper potato)-তে এক ধরণের ফাংগাস আক্রমণ করায় সমস্ত ফসল ধ্বংস হয়ে দুর্ভিক্ষে প্রচুর মানুষ মারা যায়। ২০১১ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সাবধান করে লিখেছে আমিষ- নিরামিষ সব রকম খাদ্যের ব্যাপারে কয়েকটি হাতে গোণা প্রজাতির ওপর আমাদের নির্ভরতা আশঙ্কাজনক। যখন আমরা সপ্তদশ শতাব্দীতে বিলুপ্ত ডোডোর জন্য বিলাপে মগ্ন, তখনই আমাদের সামনে ব্রয়লার আর তার আত্মীয়দের চাপে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মুর্গী প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি। আমেরিকার একটি সার্ভে দেখায় যে ১৯০৩ সালে যত রকম প্রজাতির বীজ পাওয়া যেত ১৯৮৩ সাল আসতে আসতে তাঁদের ৯৩ শতাংশ লুপ্ত হয়েছে। উদাহরণ- ঐ সময়কালে সালে ভুট্টা, টম্যাটো আর শসার রকমফের যথাক্রমে ৩০৭, ৪০৮ আর ২৮৫ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১২, ৭৯ এবং ১৬। 

প্রজাতি স্তরে যে মানুষ বাধ্য হয়েছে বৃহত্তর, আশু প্রয়োজনে খাদ্যের পরিধি সঙ্কীর্ণ করে ফেলতে, ব্যক্তিগত ভাবে তাদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছায় আরও গুটিয়ে আনছেন খাদ্যের বেড়াটি। প্রকৃতির বাগানে কোন ফুল কন্টকবিহীন হলেও কীটবিহীন নয়। শুধুমাত্র এক রকম খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে বাধ্য- ডাক্তাররা মাঝে মধ্যে এ কথা বললেও পালিশ করা রূপবান সব্জি, কখনো দূর থেকে আমদানী করা এক্সোটিক খাবারের ঝোঁকে স্থানীয় খাবার বর্জন করে সঙ্কট আরও ঘনীভূত করার ইংরাজী নাম প্রব্লেম অফ প্লেন্টি (প্রাচুর্যের বিপদ)।

আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে রাশিয়ান উদ্ভিদবিদ নিকোলাই ভাভিলভ (১৮৮৭-১৯৪৩) ব্যাপারটি বুঝে নানা জায়গা ঘুরে বিলীয়মান প্রজাতিগুলির শস্যবীজ সংগ্রহ করা শুরু করেন আর তাদের সংরক্ষণের জন্য তদানীন্তন লেনিনগ্রাদে একটি বৈশ্বিক (Global) বীজ ব্যাঙ্কের পত্তন করেন। এখন সেটি রিসার্চ ইন্সটিট্যুট অফ প্ল্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি (সেণ্ট পিটারসবারগ) নামে পরিচিত। সত্যিকার দূরদর্শী, বীজের খোঁজে বিশ্বপর্যটক ভাভিলভকে তখনকার সোভিয়েত সরকার প্রথমে সম্মান দিলেও পরে সন্দেহের চোখে দেখে (গুপ্তচর বা অন্তর্ঘাতকারী)। তাঁর জীবনের শেষ তিনটি বছর কাটে জেল-এ। ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত কোর্ট যখন তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করে, তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে, বারো বছর আগেই তিনি প্রয়াত। মানুষ মরণশীল, আইডিয়ার মৃত্যু নেই।  এখন বিশ্বময় ভাভিলভের ভাবনার হাত ধরে প্রায় দেড় হাজার বীজ ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়েছে (ভারতেও শতাধিক)। ভারতে ১৯৮৯ সালে কৃষিবিদ বিজয় জরধারি’র উদ্যোগে উত্তরাখণ্ডে বীজ বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়। তাদের সূত্রে জানা যাচ্ছে এক সময় শুধু গাড়োয়াল অঞ্চলেই পাওয়া যেত ৩০০০ রকম ধান, সেই সংখ্যাটি এখন কমে ৩০০র কাছাকাছি।

শেক্সপীয়র বহু আগে বলেছিলেন, ‘স্বর্গ-মর্ত্যে আরো অনেক কিছু আছে, হোরাশিও, যা তোমাদের দর্শনেরও স্বপ্নাতীত’ (There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy)অপ্রত্যাশিত ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে মিশ্র খাদ্য, স্থানীয় খাদ্য দেখতে যেমনই হোক না কেন আমদানী করা দৃষ্টিসুখকর শস্যরাজীর চেয়ে অনেক কার্যকর। মানুষের যাত্রাপথে কিছু ঠিক, কিছু ভুল-এর মেলা। অনেকেই এখন বলছেন সবুজ বিপ্লব ঠিক হয় নি। তা সত্যি নয়। সবুজ বিপ্লব না হ’লে তার সমালোচকদের অনেকেই হয়তো এত দিন বেঁচে থাকতেন না। 

এ লেখার উদ্দেশ্য গোঁয়ার্তুমি বাড়ানো, স্থানীয়ের নামে তীব্র আবেগ সৃষ্টি নয়। ইদানীং পুরো দেশকে জৈব সার নির্ভর করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কায় সৃষ্ট ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট আমাদের মধ্যমার্গের মূল্য বোঝায়।  হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরে আমরা বরং স্থানীয় ফুল-ফুলের প্রতি একটু অনুরক্ত হই, তাদের একবারে উৎখাত না করে বাঁচিয়ে রাখি, বিলাসী বিরিয়ানির পাশাপাশি কুন্ঠিত করলাকেও একটু জায়গা দিই। লৌকিক বুদ্ধি বলে, ‘যাকে রাখো, সেই রাখে।’

                                                                                            -অরিজিৎ চৌধুরী

 

তথ্যসূত্র  

National geographic (magazine): July 2011

Malthus, Thomas Robert (18 January 2010). An Essay on the Principle of Population. Oxfordshire, England: Oxford World’s Classics. p. 13. ISBN 978-1450535540.

Food Production and Population Growth: A Cautionary Tale (purdue.edu)

Germany’s trees are dying. A fierce debate has broken out over how to respond | Science | AAAS

Why are Germans demanding an agriculture transition? – DW – 01/15/2016

 

About the author

Arijit Choudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

Arijit Kathanchit – by Arijit Chaudhuri

One thought on “Arijit Kathanchit – by Arijit Chaudhuri

  • September 2, 2023 at 11:26 pm
    Permalink

    Wonderful article. Very passionate, very enriching. Bravo!!!
    Enjoyed reading this piece of philosophy. The moral is correctly identified by the author that people must maintain a BALANCE between old and new…..not only in agriculture but probably in every aspects of life.
    Scientific research will continue to surprise the humankind always with new ideas and unique products. And it would become very difficult to resist not been swayed by the glossy advertisements and commercial implications of such products.
    One must be strong enough from inside to tide over such challenges.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *