Arijit Kathanchit – by Arijit Chaudhuri

আত্মত্যাগ – হাওয়ায় ভরা ব্যাগ

জন্মিলে ত্যজিতে হবে- প্রথমে মাতৃগর্ভের নিশ্চিন্ত কোমল আশ্রয় ছেড়ে কঠিন পৃথিবী, কৈশোরে খেলার মাঠ ছেড়ে স্কুল আর পাঠ্য বই, বড় হয়ে শখের সিনেমা বা গান বাজনা ছেড়ে কর্মক্ষেত্র। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কিছু ত্যাগ বাধ্যতামূলক- তাদের মধ্যে গর্ভত্যাগ (জন্ম),  অসুস্থতার কারণে প্রাণত্যাগ (মৃত্যু) প্রধান (বিয়ে-কে এই লিস্ট-এ রাখা যাবে কি না তা বিবাদিত)। আলো-আঁধারি অঞ্চলও আছে। যেমন, অভিভাবক ও মাস্টারমশাইদের চাপে জীবনের বাকি আনন্দ বাধ্যতামূলক ত্যাগ করতে হয়েছিল বললে, তুই বাড়ি ছেড়ে পালালি না কেন?’ প্রশ্ন তোলার আপসহীন স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ এখনও বিরল নন।

আত্মত্যাগের কাহিনী বিশ্বময় – কিছুদিন আগে বিরাট কোহলি বললেন তাঁর স্ত্রী অনুষ্‌কা শর্মা মা হিসেবে ভীষণ ‘আত্মত্যাগ’ করেছেন। অফিসে এক দিন শুনি, ফোনে এক বাবা মেয়েকে তার জন্য তাঁর নিজের স্বার্থত্যাগের কথা বলছেন। আর এক বন্ধুর স্ত্রী হাঁফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চাদের জন্য আর কত দিন স্যাক্রিফাইস করবো বলুন তো? আত্মত্যাগ করে আর কে কে বঞ্চিত হয়েছেন খোঁজার ঝোঁকে আমরা নিজেদের  উঠোন পেরিয়ে ভগৎ সিং, বিবেকানন্দ, নেতাজী আর বহু প্রয়াত বড় মানুষের জীবনে পৌঁছে তাঁদের জন্যও কাঁদতে বসি। বেয়াড়া কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, যদি ভগৎ সিং বা সুভাষ বোস দেশের মুক্তির জন্য কাজ না করতেন, তাঁরা করতেন কি- সিনেমা দেখতেন না পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা মারতেন? অথবা, যে মা তাঁর মেয়েকে সন্ধ্যেবেলায় পড়ায় সাহায্য করে ‘আত্মত্যাগ’ করছেন, তাঁর সেটি করা ছাড়া করবার যা ছিল, তা করলে তিনি স্বস্তি পেতেন কি? যুৎসই উত্তর পাই না। আমাদের মত যাঁরা কাজের ফাঁকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করেন, স্কুলে বা আঁকার ক্লাসে নিয়ে যান, তাদের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমান, আর সে সব কর্মকে ‘আত্মত্যাগ আখ্যা দেন।’ তাঁদের যদি বলা হয়, ‘ওসব আর করতে হবে না। যে সব নিজের কাজ ছেড়ে পরের জন্য আত্মত্যাগের গভীর দুঃখ বরণ করছ, সে সব সুখের কাজে মন দাও।’ তখন নব্বই শতাংশ মানুষ কাজ খুঁজে পাবেন না। উদাহরণ, একজন কর্মনিষ্ঠ, শনি-রবিবারেও অফিসে আসতেন এক সহকর্মী বলতেন, ‘অফিসের চাপে ফ্যামিলির জন্য সময় পাওয়া যায় না।‘ একদিন বোমা রাখা আছে, এই গুজবে সকালেই অফিস ছুটি হবার পর আমাদের মত অধিকাংশ ‘বাধ্য-হয়ে-কর্মবীর’ দ্রুত গৃহে প্রস্থান করি। পরদিন সহকর্মী বললেন, উনি বাড়ি যান নি, আর কিছু করার না থাকায় একলা দুপুরবেলা চিড়িয়াখানা দেখে এসেছেন। তবু, আত্মত্যাগ নিয়ে ভরা তাঁর এবং আমাদের জীবন। সময় পেলেই ভাবি কখন কি আত্মত্যাগ করেছি আর প্রতিদান পাই নি। ভাবতে ভাবতে মনমরা হয়ে কিছু করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলি, দু’ কাপ চা, দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট বেশি খেয়ে স্বাস্থ্যের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাই। 

সাধারণভাবে বলতে গেলে, সভ্যতার ও বিজ্ঞানের উন্নতির একটি অপরিহার্য (কু)ফল হ’ল ‘কি করব?’- প্রতিদিন এই প্রশ্নের বহু গ্রহণযোগ্য উত্তর তৈরি হওয়া। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত -প্রাণায়াম করব, না জগিং; ভাত খাব, না আলুর পরোটা; বই পড়ব না ইউ টিউব দেখব ইত্যাদি ‘এটা করব, না ওটা’- এ সব সমস্যার উদয়, আর তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকা যুগের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা উদাহরণ দিই, আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার বলতে থাকতেন একজনমাত্র। তাঁর কাছে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছুর চিকিৎসা চলতো। খুব দরকার হলে তিনি দাঁতের আর চোখের দু’রকম মাত্র স্পেশ্যালিস্টের কাছে পাঠাতেন। এখন আমাদের শরীর-মনের দেখভাল করার জন্য অন্ততঃ চল্লিশ রকম বিশেষজ্ঞের মধ্যে কার কাছে যাব তা নিয়ে মাথা খারাপ হবার যোগাড় হয়। 

সভ্যতার নানা সুবিধের গোলাপগুচ্ছে কাঁটা হল অগুন্তির মধ্যে একটি বা দুটি ‘ভালো’কে বেছে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা। ইংরাজিতে বলতে গেলে All individuals are condemned to choose. আর বেছে নিলেই মন বা অনাহুত শুভানুধ্যায়ীরাও বলেন, ‘সত্তরটা আরও ভালো ত্যাগ করলি?’  কিন্তু, পেছনোর উপায় নেই বলে ভুল করার আত্মগ্লানি ভুলতে আত্মত্যাগের হুক্কা পারলারে ঢুকে জম্পেশ কিছু টান মেরে রোঁয়া ফুলিয়ে আবেগে জবজবে হয়ে ঘরে-বাইরে ঘুরতে থাকি। প্রায় কেউ প্রতিবাদ করে না, সবাই আত্মত্যাগে একমত হয়, কারণ তারাও এক-ই নেশা করে ঘুরছে। যেখানে সবাই মাতাল, সেখানে কে কাকে মাতাল বলবে? সামান্য কিছু লোক যাঁরা ব্যাপারটা বোঝেন তাঁরাও ইংরাজিতে ‘হার্টলেস’ বা শক্ত বাংলায় ‘সংবেদনহীন’ ধরণের গালি শোনার ভয়ে চুপ করে থাকেন। 

‘ভালো’ আর ‘আরও ভালো’-র চাপে মাঝে মাঝে ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’-র আকুতি মনের এফ এম-এ বাজতে থাকে। রামরাজ্যের চেয়েও আগে গুহাবাসী আদিম মানুষরা কি সুখে ছিল- যা হাতে আসত তাই খেতো। মাথা থাকত সদ্য কেনা কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কের মত পরিষ্কার – এসব চিন্তা ঘুনঘুন করতে থাকলে আমাদের দেশে কেউ কেউ কৌপীন মাত্র সম্বল করে পাহাড়ে প্রস্থান করেন আর পশ্চিমের দেশগুলোতে নতুন চালু হওয়া মিনিম্যালিস্ট মুভমেন্ট-এর শরিক হ’ন। তবে তাঁরা মুষ্টিমেয়। আমরা বেশীরভাগ মানুষ যারা তেমনটি করতে পারি না তারা যে সব সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছায় নেন রবীন্দ্রনাথ বারণ করা সত্ত্বেও তাদের মহৎ নাম ও বৃহৎ মুল্যের আত্মত্যাগী গাউন পরিয়ে শোভাযাত্রায় না নামিয়ে পারি না; নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তের দায়িত্বটি চাপানোর মত কাউকে পেয়ে গেলে ‘যার পর নাই’ খুশি হই। তারই মধ্যে মিতভাষী কেউ কেউ নিশ্চুপে ভাবেন- ‘আমি মহান, তাই আত্মত্যাগ করতে হবে।’ আর কেউ কেউ সরবে আত্মীয়-বন্ধু-সন্তানের ওপর বোঝা চাপান-‘যাদের জন্য এত ত্যাগ করেছি, তাদের এই প্রতিদান?’ ইত্যাদি।

মহত্ত্বের ঘোর কেটে গেলে মাঝে মাঝে আবার আত্মত্যাগের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ হয়। ভূরি ভূরি উদাহরণের মধ্যে দুটি দেখুন।

প্রথম

অফিসের জন্য আমি বাড়ির মানুষকে সময় দিতে পারি না।

তাহ’লে গত সপ্তাহে তিনদিনের ছুটিতে ফ্যামিলি ছেড়ে বন্ধুদের সাথে গোপালপুর গেলি কেন?

         (ইনি স্বেচ্ছায় অফিসে বা গোপালপুরে পালান, আর বলেন আত্মত্যাগ)

দ্বিতীয়

  • ছেলেমেয়েকে পড়াতে পড়াতে আমার জীবন শেষ হয়ে গেল। তোরা কত সিনেমা-থিয়েটার দেখতি, আমার কিছুই হ’ল না।
  • তোর বাচ্চারা তো এখন বড় চাকরি করছে। পাড়ার লোকে ভাল বলে; তাদের নিয়ে চাপা গর্বও আছে তোর। ওদের না পড়িয়ে থিয়েটার দেখে বেড়ালে তারা গোল্লায় যেত। সেটা ভাল হত কি?

        (ইনি নিজের গর্ব ভূমি বিস্তারের জন্য সন্তানের পিছনে পড়ে থাকেন, কখনও তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে রাখেন, আর বলেন আত্মত্যাগ)

ভাল করে দেখলে আত্মত্যাগ বলে কিছু নেই। ভগৎ সিং বা নেতাজীর পক্ষে পরাধীন দেশে চা পান করে জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব ছিল না বলেই তাঁরা সংগ্রামের জীবন বেছে নিয়েছেন। আত্মাহুতির মুখে দাঁড়িয়েও আত্মত্যাগের অশ্রুপাত করেন নি। একটি মূল প্রশ্ন স্বার্থ কথাটির মানে নিয়ে। কেউ মনে করেন, নিজের আরাম-ই আমার স্বার্থ, কেউ ভাবেন আমার স্বার্থ পরিবারের সাথে ওতপ্রোত, আর অনেকে ভাবেন দেশের  আর  আমার স্বার্থ অভিন্ন। তলিয়ে ভাবলে আত্মত্যাগ শব্দটি অর্থহীন মনে হয়। আবাল্য সংস্কারে ধাক্কা লাগে, শুনতে খারাপ লাগে, তবু সত্যি কথাটা হ’ল আমরা প্রত্যেকে নিজস্ব রুচিমাফিক কাজ করি। কেউ আত্মত্যাগ করি না।

তাহলে, বড় মানুষদের সাথে আমাদের, সাধারণের তফাৎ কোথায়? তফাৎ রুচিভেদে। রুচিভেদ-ই স্বার্থ শব্দটির মানে নিজের সাথে, পরিবারের সাথে, দেশের সাথে বা বিশ্বমানবের সাথে মিলিয়ে ক্রমান্বয়ে উচ্চস্তরে – ব্যক্তিগত সুখ থেকে সমষ্টির কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়। যখন আমরা একজনকে ‘স্বার্থপর’ আর অন্যকে আত্মত্যাগী বলি তখন যে গণ্ডগোলটি ঘটে সেটি শুধু শব্দার্থের সীমায় আটকে থাকে না, প্রত্যাশার গ্যালারিতে আমাদের দাঁড় করিয়ে সে ‘কি পেলাম’, ‘কি পেলাম’ এই বহির্মুখী কৈফিয়ত দাবী করতে করতে মনে হতাশার আর অন্ত্রে অ্যাসিডিটির প্রকোপ বাড়িয়ে তোলে।

আত্মত্যাগ শব্দটির ভার বর্জন করলে বাস্তব নিজের লাভ এই যে, সুদূর ভবিষ্যতে প্রতিদানের আশা থাকে না আর। যার বা যাদের ‘জন্য’ কাজ তাদের মনও ব্যক্তিগত ঋণশোধের ভারমুক্ত হয়ে হয়তো আর একটু সৃষ্টিশীল হয়। নিজের বর্তমান কাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তৃপ্তি ফুটে ওঠে, হৃদয়ে ফূর্তি, শরীরে প্রাণশক্তি বাড়ে। কঠিন পাঠ্যটি বাবা-মা বুঝিয়ে দিলে বাচ্চাটির চোখে-মুখে যে ‘ক্ষণিক সুখের চকিত হাসি’ ফুটে ওঠে তার চেয়ে দামী পুরষ্কার কিছু হয় নাকি?

পয়লা এপ্রিল, ২০২৩                                                                                      -অরিজিৎ চৌধুরী

 

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

Arijit Kathanchit – by Arijit Chaudhuri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *