Arijit Kathanchit – by Arijit Choudhuri

কানু বিনা গীত নাই, যীশু বিনা কেক নাই


কৃষ্ণ (কানু) সারা ভারতের সংস্কৃতিতে এমন ভাবে ছেয়ে আছেন যে দুটি বিষয় নিয়ে বেশীর ভাগ গানের সৃষ্টি – প্রেম ও ভক্তি, তাতে তাঁর প্রসঙ্গ এসেই যায়। গীতিকারদের তৃতীয় প্রিয় বিষয় প্রকৃতি, তাতেও ‘শ্যামলে শ্যামল’ আর ‘নীলিমায় নীল’ হয়ে গোপীবল্লভ ওতপ্রোত। তাই লোককথায় বলে কানু বিনা গীত নাই।  ব্যাপারটা আমাকে প্রথম জবরদস্ত ধাক্কা মারে যখন দেখি, অতি আধুনিক মুক্তমনা মুজতবা আলী’র উপন্যাসে মুসলিম নায়িকার প্রিয় গান, ‘মেরা তো সির্‌ফ গিরিধর গোপাল অউর না হি কোঈ’। প্রশ্ন হ’ল এই পৌরাণিক, ঐশ্বরিক চরিত্রগুলি কি শুধু আধুনিক ভারতকেই প্রভাবিত করছে না দেশে দেশে সেখানকার কানুরাও একই রকম ছায়া ফেলছেন (যীশু বিনা কেক নাই)?     

অথচ দেখুন, পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে এখন নাস্তিকের ভিড়। আমেরিকায় ৪৫%, ইজরায়েলে ৬৫%, চীন তো বটেই জাপান, আজারবাইজান এমন কি ব্রিটেন-কানাডা-আয়ারল্যান্ড বা চেক রিপাবলিকে বেশীরভাগ লোক নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেওয়া পছন্দ করছেন। ইউরোপের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি যেখানে ক্যাথলিক চার্চ না থাকায় এক বিখ্যাত অধ্যাপক আসতে চান নি, তাঁর জন্য চার্চ বানাতে হয়েছিল। সে সব জায়গাতেও এখন রবিবারের প্রার্থনায় লোক জোটানো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ধর্মের প্রভাব কমে এলেও উৎসব বলতে খ্রিষ্টমাস, দিওয়ালি, ঈদ বা ইস্টারের প্রভাব কমে নি। এমন কি উগ্রতার প্রভাব যেখানে কম, সেখানে বিবিধ মতের প্রাচীন ধর্মস্থানগুলোও অতি যত্নে সংরক্ষণ করা (চাঁদা তেমন পাওয়া না গেলে সরকারী পয়সায়) হয়। কেউ আপত্তি করলেও তাতে জোর থাকে না কারণ নাস্তিক-ধার্মিক নির্বিশেষে পর্যটকরা এসব জায়গা দেখতে এসে যা খরচ করেন তাতে দেশের পুষিয়ে গিয়েও কিছু বাড়তি থাকে। বেড়াতে গেলে ট্যুর অপারেটর থেকে স্থানীয় বন্ধু চার্চ, সিনাগগ, মন্দির, মসজিদ তো দেখাবেই, আর বলবে একবার খ্রিষ্টমাসে এসে দেখে যেয়ো। ব্রাজিলে বলবে লেন্ট-এর আগে কার্নিভালে এসো, পাকিস্তানে বলবে ঈদ আর ভারতে বলবে এসো দশেরা/দূর্গাপূজো/দিওয়ালি/গণেশ উৎসব/ঈদ/বড়দিন বা ওনম-এর সময়। ধর্ম যদি শুধু পুজোই হয় তাতে অপূজকদের ভিড় কেন? ব্যাপারটা বিশেষ কোন ধর্মের তোয়াক্কা না করে যে সর্বত্র ঘটে যাচ্ছে- তাও নজর না করে পারা যাচ্ছে না। গণতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মে দিবস পালন হয় ঠিকই, কিন্তু দীপাবলির আলোকসজ্জা আর দোলের স্বতঃস্ফূর্ততা একেবারে আলাদা জিনিষ।

মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, পণ্ডিতি করতে গিয়ে আমরা কিছু দেখতে ভুলে যাচ্ছি না তো? যা মনে করছি তা ছাড়া আরও কারও মায়াবী মুখ কি ধর্মের, ধর্মীয় উৎসবের পিছনে জড়িয়ে আছে যার টান মূল ধর্মের ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে নাস্তিক তো বটেই গোঁড়া বিধর্মীকেও টেনে আনে? ‘কার সে মুখ, কার?’ চোখ খুলে তথাকথিত ধর্মীয় উৎসবগুলোর দিকে দেখলে একটি নয়, অজস্র মুখ দেখা যায়। উপাসনাও একটি মুখ বটে, কিন্তু অনেক সময় সেটিই প্রধান, না অজুহাত- তা নিয়ে সন্দেহ কাটতে চায় না, যেমন কোনটি প্রধান – বড় মুক্তোটি, না যে অতিক্ষুদ্র কণাটিকে ঘিরে সে গড়ে উঠেছে সেটি? এ প্রশ্ন অমর হয়ে থাকলেও ৯৯% মানুষ মুক্তো নিতে ছুটবে, ভেতরের বিশুদ্ধ কণাটি বার করে রাখলেও ছুঁয়ে দেখবে না।

নিষ্ঠাবান উপাসক লজ্জা পাবেন, কিন্তু সত্যি কথা হল অদৃশ্য ভগবানকে খুশী করার, পরলোকে সুখপ্রাপ্তির জন্য আয়োজিত ধর্মীয় পালপার্বণে দৃশ্যমান সুখপ্রাপ্তি ঘটে ব্যবসায়ীদের। ফ্ল্যাটের প্রমোটার, কাপড়ব্যবসায়ী থেকে রাস্তায় নুড্‌লবিক্রেতা থেকে ফুচকাওয়ালা সকলেই  উৎসবের সময় বিক্রি-সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। ভারতের মত বহু ধর্মাবলম্বীর দেশে কোন ব্যবসায়ী যদি অন্য ধর্মের পার্বণে কিছু বেচবো না ঠিক করে তাহলে যে তার ব্যবসার গণেশ উল্টোতে দেরী হবে না- এ কথা নিশ্চিৎ। 

ধার্মিকরা প্রায়ই বড়দিনের, ঈদে বা দূর্গাপুজোর ভিড় দেখে ভাবেন, ‘আহা! এই বুঝি সকলে ধর্মপথে নেমে পড়লো।‘ আর নাস্তিকেরা ভাবেন, এতদিনের যুক্তিচর্চা বুঝি মাঠে মারা গেল। দুটিই ভয়ানক ভুল। উৎসবের ছুটিতে বেরিয়ে পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার যে মজা, তার সাথে পুজোর কি সম্পর্ক? আর বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পাওয়া ছোট্ট মেয়েটির খুশী আর বাথরুম সিঙ্গার দাদা-বউদির বিজয়া সম্মিলনীতে ভুল কথা ও সুরে গান গাওয়া অথবা কার্নিভালে মনের কথা বলতে চাওয়া ছেলেটির সাথে সাম্বা নাচের যে আনন্দ তাতে যদি ঈশ্বর থেকেও থাকেন…তিনি থাকেন তাঁর করুণাঘন স্নেহদৃষ্টি নিয়ে, উপাসনা পাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নয়। 

আস্তিকদের বোঝা দরকার উৎসব থেকে একে ওকে বিধর্মী বলে তাড়ালে ঈশ্বরের অপমান কারণ তিনি শুধু বাছাই করা ক’জনের নন, জগতের পিতা (যাদের তাড়ানো হ’ল তাদেরও)। উর্দু কবি কাঁওয়ার মহিন্দার সিং বেদি যখন বলেন, “মহম্মদ পে ইজারা কিসি মুসলিম কা নহিঁ…”- একটি গভীর সত্য উচ্চারিত হয়। আর ধর্ম বলে ঈশ্বরের পথে আরও মানুষকে টানো। মুক্তোর পরতগুলি তুলে ফেলে শুধু কণা দিয়ে- উৎসব বাদ দিয়ে নতুন মানুষকে আকর্ষণ করা যাবে কি? এরকম করা কি ভগবানের উপাসনাকে পবিত্র করার ছলে মানুষকে দূরে ঠেলা নয় ……ঈশ্বরেচ্ছার বিরোধিতা নয়? যে ফুল, ফল, মোমবাতি বা চাদর দিয়ে উপাসনা তার অনেক জায়গায়ই বিধর্মী চাষী, মজুর, তাঁতির স্পর্শের ব্যবস্থা হয়তো ঈশ্বরই করে রাখেন, তাকে আটকানো যাবে কী করে?       

নাস্তিকদের ভাবতে হবে যে গোটা মানবপ্রকৃতি…তাঁদের নিজেদের প্রকৃতিও শুধু যুক্তি দিয়ে, বাস্তব নিয়ে ধরা যায় না। যদি তা যেত, তাহলে স্পাইডারম্যান বা গুপি-বাঘার ছবি দেখতে যুক্তিবাদীরাও ভীড় করত না, সন্তানজন্মের প্রাকৃতিক তাগিদ পূরণ করতে গিয়ে, একটি মানুষকে না পেলে “শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী, শূন ভেল দশ দিশ  শূন ভেল সগরি” ধরণের অনুভূতিতেও ভুগতো না। ধর্মের সাথে জড়িত প্রাচীন মিথোলজির যে সব অদ্ভুত ঘটনা আছে- যীশু বা কর্ণের জন্মকথা, কাঠবিড়ালীর রাম-সেতু নির্মাণে যোগদান, রাধাকৃষ্ণের প্রেম, চীনের ড্রাগনের নাচ বা সমুদ্র ভাগ হয়ে যাওয়ার উৎসব উদযাপন করতে করতে তার সাথে একান্ত মানবিক নতুন কাপড় পরা, নাচ-গান-নাটক আর মেলামেশার যে অতি স্থায়ী ঐতিহ্য স্তরায়িত হয়েছে…… মুক্তো হয়ে বিকশিত হয়েছে, তার আনন্দময় (ফুর্তিময়ও বলা যায়) বাস্তবতা অস্বীকার করলেও জীবন থেকে যাবার নয়। তাছাড়া, এগুলো গড়ে ওঠার  পেছনে অবিশ্বাসীদের অবদান যথেষ্ট। যেমন ধরুন, সত্যজিৎ রায় অ্যানাইহিলিন বন্দুক বা জে কে রাউলিং ইনভিসিবিলিটি ক্লোক-এর অস্ত্বিত্ব বিশ্বাস করেন নি, কিন্তু তাদের নিয়ে নিটোল কাহিনী সাজাতে ত্রুটি রাখেন নি। বড়দিনের ভাল কেকটি যে বানাচ্ছে তার যীশুতে বিশ্বাস আছে কি নেই, তাতে কি এসে যায়? 

আসল কথা হ’ল, দেশকালনির্বিশেষে মানুষ গল্প ভালোবাসে। বাস্তবে থাকে…থাকতে বাধ্য হয়, কিন্তু কল্পনার প্রতি তার টান কখনো কমে না। মোটরগাড়ি আবিষ্কারের বহু যুগ আগে ভারতে পুষ্পক রথ আর ইটালিতে এরোপ্লেনের নকশা তৈরি হয়, রাম শব্দভেদী বাণ ছোঁড়েন আর মোজেস সমুদ্রকে ভাগ করে শুকনো মাটিতে হেঁটে যান। অর্থাৎ, বাস্তব নয়, কল্পনাকে অসম্ভবে ঠেলে দাও, আর তা যদি না হয় অন্ততঃ আপাত অসম্ভবের দোরগোড়ায় পৌঁছে না দিলে লোকের মন ভরে না। তাই ফাস্ট ইন্টারনেটের যুগে এসে, চাঁদ আর মঙ্গলগ্রহের ছবি দেখে তৃপ্তি হয় না, স্টার ওয়ার, জুরাসিক পার্ক, জুমানজি আর ভূতের রাজার দেওয়া ম্যাজিক জুতো পরে যেখানে সেখানে উড়ে যাওয়া গুপি-বাঘা- যাদের গান-বাজনা শুনে রয়্যাল বেঙ্গল বাঘাদা-ও স্ট্যাচু হয়ে যান-সে সব ফিল্ম দেখতে ভিড় ভেঙ্গে পড়ে। পুজো-আচ্চার তোয়াক্কা না করা  বেঙ্গালুরুর বাঙ্গালী মা দুর্গামণ্ডপে লাল পাড় শাড়ি পরে গিয়ে বাচ্চার জন্য ঠকুরমা’র ঝুলি’র খোঁজ করে, আর মুম্বই-এর মুসলিম মেয়ের বাবা-মা বিয়ের সময় গায়ে হলুদ-এর সাথে ‘সঙ্গীত’ এর আয়োজন করেন, দীপাবলিতে হোয়াইট হাউস সাজানো হয় সংস্কৃতির…আনন্দের মুক্তোটির টানে, ধর্ম-কণার টানে নয়। 

তবু, ‘মানতে তো বাধা নেই’ ধর্ম যে রকম গল্পদাদুর আসর জমিয়ে বসেছে, বাস্তব আর যুক্তির তার ধারে-কাছে আসার সম্ভাবনা আপাততঃ নেই বললেই চলে সুতরাং, কানু বিনে গীত আর যীশু বিনে কেক হবার আশা ছেড়ে দিয়ে, আসুন, সবাই মিলে শুকনো শুচিবায়ু ত্যাগ করে যে কোন অজুহাতে ‘মধু-গন্ধে ভরা’ জীবনের উৎসবে মাতি। 

                                                                                               -অরিজিৎ চৌধুরী

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Travelling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

 

Arijit Kathanchit – by Arijit Choudhuri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *