Love Notes : Einstein by Basudev Gupta

আইনস্টাইন ও রিলেটিভ প্রেম

 

– বাসুদেব গুপ্ত

 

আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তি – ঈশ্বর বিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না। 

আর তাঁর বিখ্যাত ঐশ্বরিক ফর্মূলাঃ E=mc2। 

সাধারণ মানুষের কাছে এই দুটি কথারই মর্ম বোঝা দুঃসাধ্য। তাই আমরা এগুলোকে ঈশ্বরের উক্তির মত মান্যতা দিই ও দরকার মত আউড়ে যাই। আ-ই-ন-স্টা-ই-ন ইংরাজীতে যার মানে “একটি রত্ন”। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সুপারস্টারের নাম। সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানবের নাম। যে কোন শিশুর ভিতর প্রতিভার স্ফুরণ দেখা গেলে অভিভাবকেরা একবার অন্ততঃ বলেন, কি বুদ্ধি! বড় হলে নিশ্চয় আইনস্টাইন হবে। আমরা তাঁকে মহামানব বলে জানি। যাবতীয় গুণের আধার, বিশ্বের কল্যাণকামী উন্মুক্তমনা এক বিজ্ঞানী। আমরা তাঁকে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক ফ্রেমে। আমরা শুনেছি গান্ধীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তাঁর যুদ্ধ বিরোধী বাণী। আমরা শুনেছি কি করে একজন মানুষ এত প্রতিভাবান হতে পারে বোঝার জন্য তাঁর ব্রেন নিয়েও বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। 

সেই মানুষ বা ব্যক্তির প্রেম, তাও এক মহাকাব্যিক কাহিনীর মতই হবে, তাই তো স্বাভাবিক। আমার মত অল্পবুদ্ধি ও অশিক্ষিত মানুষের কাছে তাঁর মত বিশাল মানুষকে এই ছোট রচনার ফ্রেমে ধরাও দুঃসাধ্য। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক প্রবন্ধ জীবনী, তৈরী হয়েছে অনেক ফিল্ম। সেই অজস্র লেখা থেকে সাধ্যমত তথ্য আহরণ করে আমার এই লেখা। মহান বিজ্ঞানীকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার এই লেখা শুরু করছি। 

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মান সাম্রাজ্যের দানিউব, ব্লাউ আর ইল্লার নদীর সঙ্গমস্থলে উল্ম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উল্ম শহরকে বলা হত ঘটনাবহুল শহর। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্রোতের অজস্র ধারার মিলনস্থান এই শহর। আর সেখানেই ঘটে শতাব্দীর এই বিশেষতম ঘটনা। আইনস্টাইনের জন্ম। তাঁর পিতা হারমান আইনস্টাইন ও মাতা পলিন কোখ। জন্মের এক বছর পরে, তাঁর পরিবার 

চলে যায় মিউনিখে, জার্মানির বৃহত্তম শহরগুলির মধ্যে একটি, যেখানে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বাবা এবং কাকা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী একটি সংস্থায় কাজ 

করতেন। 

ছোট থেকেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। শোনা যায় যে তিনি একটিমাত্র গ্রীষ্মের মরসুমে সম্পূর্ণ বীজগণিত এবং ইউক্লিডীয় জ্যামিতি শিখে ফেলেছিলেন। যদিও এটা ভক্তদের অতিভক্তি থেকে সৃষ্ট গুজবও হতে পারে। এরপর, মাত্র ১৪ বছর বয়সে, তিনি ডিফারেনশিয়াল এবং ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাসের উপর সম্পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ১৬ বছর বয়সে সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হবার পরীক্ষায় বসেন কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে বিশ্রীভাবে ব্যর্থ হন। পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল তাঁকে পরামর্শ দেন আরো ভালোভাবে তৈরী হয়ে আসতে এর পর তিনি Argovian cantonal schoolএ দুবছর মন দিয়ে পড়ে ১৮৯৬ সালে মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করেন। এই সময় তিনি থাকতেন জসট উইন্টেলারের বাড়ীতে লজিং করে। উইন্টেলার ছিলেন সুইজারল্যানডের গ্রীক ভাষা ও ইতিহাসের নামকরা অধ্যাপক, কবি, ভাষাবিদ, সাংবাদিক ও আরো অনেক বিষয়ে পারদর্শী। তিনি অনেকটাই আইনস্টাইনের গডফাদারের মত ভূমিকা নিয়েছিলেন। অ্যালবার্টের মেন্টরিং অনেকটাই তাঁর হাতে। আর এর ফাঁকে ফাঁকেই অ্যালবার্টের রোমান্সের প্রথম পুষ্প হয়ে ফুটে ওঠে জস্টের মেয়ে, মেরি। প্রথম প্ৰেম ৷ 

মেরীর বয়স তখন ১৮। আর অ্যালবার্ট ১৬। প্রেমের প্রথম মুকুল ফোটার এই তো সময়। রোমান্সকুসুম ফুটে উঠতে দেরী হয় নিতাঁর চিঠি থেকে তা বেশ বোঝা যায় ৷ ভাবলেই আমার মনে কি অসীম সুখানুভূতি হয়। আমাদের দুটি হৃদয় যেন এক হয়ে গেছে। ভালবাসা আমাদের কত বড় করে দেয় আর কত ঐশ্বর্য এনে দেয়। কোন ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই তা আমাদের থেকে কেড়ে নিতে পারে“ 

কিন্তু ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শেষ পর্যন্ত এই প্রেম পরিণতিতে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে যায়। আইনস্টাইনের বোন পরে বিয়ে করেন জস্টের ছেলে পলকে। সামাজিক সম্পর্ক 

থেকেই যায়দুই প্রেমিকের মানসিক সম্পর্ক শেষ হয়েও শেষ হয় না। পরিণতিতে না পৌঁছলেও অ্যালবার্ট ও মেরির হৃদ্যতায় যে কখনও ভাঁটা পড়ে নি তা জানা যায় তাঁর প্রকাশিত চিঠিপত্র থেকে। ১৯০৯ সালে তখন মেরীর বয়স ৩২, অ্যালবার্টের বয়স ৩০। তিনি তখন বার্নেতাঁর যুগান্তকারী সব আবিষ্কার সবে প্রকাশ পেয়েছেসারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা নড়ে চড়ে বসেছেন এইসব বিস্ফোরক পেপার পড়েকিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। প্রণয়ের স্রোতে যেন ভাঁটা পড়ে আসছেঠিক তখন সেই ভুলে যাওয়া প্রথম প্রেমের আগুন জ্বলে ওঠে আবার একবার । কিন্তু সে আগুন আবার নিভেও যায়। 

অ্যালবার্ট লিখছেন ১৯১০ সালের মার্চ মাসে- 

“আজ সকালে আমি তোমায় গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি আর পারছি না। তোমার কথা ভাবলেই আমার মন সারাক্ষণ কি গভীর ভালবাসায় ভরে যায়শুধু যে মানুষ প্রেম থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেই বুঝতে পারবে আমার থেকে অসুখী আর কেউ নেই“ 

কিন্তু মেরী এসব কোথায় ভোলেন নি আরতিনি অনেক দেখেছেন অ্যালবার্টের ওপর ভরসা করে থাকা কতটা ভুল, তিনি কত অস্থির ও চঞ্চলমতি। মেরী (মেরি?) নিষ্ঠুর প্রেমিকার মত দূরে চলে গেলে আইনস্টাইন তাঁকে এক চিঠি লেখেনআইনস্টাইন অনেক চিঠি লিখেছেন তাঁর বন্ধু ও প্রেমিকাদের। তবে এরকম চিঠি হয়ত আরো কাউকে লেখেননি । 

“আমি যখন তোমার চিঠি পড়লাম, মনে হল যেন আমি দেখছি আমার নিজের কবর খোঁড়া হচ্ছে। জীবনে আমার ভাগ্য আমাকে যা কিছু দিয়েছিল, সব যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলজীবনে শুধু পড়ে রইল বিস্বাদ কর্তব্য পালনের দিনগুলি।” 

অ্যালবার্ট শুধু এক ঈশ্বরসদৃশ বিজ্ঞানীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভীষণ রকম রক্তমাংসের একজন মানুষ। একজন ভয়ংকর চঞ্চল মানুষ যাঁর মন সব সময় ছুটে বেড়াত নতুন তথ্য নতুন জ্ঞান নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন সম্পর্কের দিকে। তাই 

বৈজ্ঞানিক পরিচয়ের আড়ালে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল অসংখ্য কাহিনীতে সম্পৃক্ত। তাঁর ভাষায়- 

“সবাই যদি আমার মতো জীবন কাটাতে পারতো, তাহলে উপন্যাসের আর দরকারই 

হতো না।” 

কথাটা খুব সত্যি। 

আর এই উপন্যাসটি ছিল আগাগোড়া এক প্রেমের উপন্যাস। সেই উপন্যাসের নায়কের জীবন অনেক সময়ই পাশা খেলার মত ভাগ্য ওলোট পালোট হয়ে যায় অনায়াসে। আর সেই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্রের নাম মিলেভা মারিচ। 

আইনস্টাইনের জীবনে আবার নতুন প্রেম আসে মিলেভার হাত ধরে। ইতিহাসে মিলেভার পরিচয় পাই কুশলী গণিতবিদ এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী হিসেবে। ১৮৭৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রাক্তন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের সার্বিয়ান অংশে ছোট্ট টিটেল(এখন জনসংখ্যা ১২০০০) শহরে মিলেভা মারিচ জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান স্যুরিখ সুইজারল্যান্ডে, ৪ আগস্ট, ১৯৪৮ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনীর একজন বেসামরিক কর্মচারী। মা ছিলেন ধনী পরিবারের মেয়ে। 

খুব কম বয়সেই তাঁর ব্যতিক্রমী প্রতিভা বাবা-মার নজরে আসে। মিলেভা বেশ কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে জাগ্রেবের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে বেসরকারী শিক্ষার্থী হিসাবে ভর্তি হন। বিদ্যালয়টি ছিল কেবল পুরুষদের জন্য, কিন্তু তাঁর উজ্জ্বল প্রতিভার জোরে তিনি এখানে পড়তে অনুমতি পেয়ে যান। তাঁর গাণিতিক দক্ষতা অবশেষে তাকে টেনে নিয়ে যায় পদার্থবিজ্ঞানের দিকে এবং ১৯ বছর বয়সে তিনি আরো পড়াশোনা করার জন্য স্যুরিখ সুইজারল্যান্ডে যান। এই দেশ তখন হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যেখানে মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স করার অনুমতি দেওয়া হত। এখানে একটা টার্ম মেডিসিন অধ্যয়নের পরে, গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের আকর্ষণে তিনি এই দুটি বিষয়েই মনোনিবেশ করেছিলেন। আর তখনি ভাগ্যের 

সমাপতনে তাঁর সামনে ধূমকেতুর মত আবির্ভাব হল অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের। সেটা 

১৮৯৬ সাল। 

পলিটেকনিক স্কুলে পড়তে পড়তে অ্যালবার্টের দেখা হয় হবু স্ত্রী, মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী মিলেভা মারিচের সঙ্গে। অ্যালবার্ট তাঁকে পছন্দ করে ফেলেন অল্প সময়েই। মিলেভাও তাঁর প্রেমে পড়ে যান সারা জীবনের মত। তাকে অ্যালবার্টের বিশেষ পছন্দের প্রধান কারণ বিজ্ঞানে দুজনের অদ্ভুত সিনারজি। মিলেভার সঙ্গে তিনি গাণিতিক সমীকরণ এবং পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে প্রাণ খুলে আলোচনা করতে পারতেন। খুব দ্রুত এই পরিচয় গড়ায় গভীর প্রেমে। অ্যালবার্ট তখন ১৭ আর মিলেভা ২০। যৌবনের জোয়ারে ভাসছে তাঁদের শরীর মন। দুজনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়েন কিছু দিনের মধ্যেইঅ্যালবার্ট ভায়োলিন বাজান, মিলেভা তার সঙ্গে গেয়ে যান গান, সময় হলেই দুজনে চলে যান পাহাড়ের উন্মুক্ত দিগন্তে ঘুরে বেড়াতে। আবার ঘরে বসে দুজনে সারাক্ষণ ব্যস্ত হয়ে যান পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতের তত্ত্ব নিয়ে তুমুল আলোচনায়। পৃথিবীকে নতুন চোখ দিয়ে দেখা শুধু নয়, তার গভীর সূত্রগুলো আবিষ্কার ও ব্যাখ্যার জন্য চলতে থাকে দুজনের অবিরাম কাজ । 

আইনস্টাইন এবং মিলেভা প্রাথমিকভাবে একে অপরকে পাগলের মত ভালোবেসে ফেললেন। তার ওপর পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি গভীর আবেগ দুজনে ভাগ করে নিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁদের দুজনের বন্ধন ছিল যেন অবিচ্ছেদ্য। অন্তত মিলেভা তাই ভেবেছিলেন। 

তাঁদের প্রেমের ফসল আসতেও দেরী হয় না। ১৯০১ সালে, মিলেভা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন ও পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। অ্যালবার্টের পরিবার ব্যাপারটা মোটেই মানতে পারলেন না। এমনিতেই তাঁর মা মিলেভাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না । মিলেভা তেমন সুন্দরী ছিলেন না। তাঁর হাঁটাতেও একটু সমস্যা ছিল। আইনস্টাইনের 

মা সোজা বলে ছিলেন, “তুই যখন ৩০ হবি তখন তোর বউ তো একটা বুড়ী থুখুড়ি হয়ে যাবে।মিলেভা অবশ্যই আইনস্টাইনের থেকে ৩ বছরের বড় ছিলেন। 

বিয়ের এক বছর আগে, ১৯০২ সালে মিলেভা একটি মেয়ের জন্ম দেন। যার নাম নাকি ছিল লিজারল। আশ্চর্যের কথা, কেউই ঠিক জানে না যে মেয়েটির শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল। আইনস্টাইন এবং মিলেভার সম্পর্কের প্রথম দিনগুলি এই রহস্যময় এবং মর্মান্তিক ঘটনা দ্বারা চিহ্নিত। আইনস্টাইনের মৃত্যুর ৩০ বছর পর পর্যন্ত লিসারলের জন্ম জনসাধারণের কাছে অজানা ছিল১৯৮৭ সালে তাঁর সংগৃহীত নোট এবং কাগজপত্রের একটি ভলিউম প্রকাশ হয়, যা থেকে জানা যায় এই অবৈধ সন্তানের 

কথা। 

কারো মতে শিশুটি জন্মায় নানা দোষ নিয়ে। আবার কারো মতে সে অল্প বয়সেই স্কারলেট জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ বলেন, আইনস্টাইনের মা শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে দিতে বাধ্য করেছিলেন, আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে সার্বিয়ায় মিলেভার মা বাবার কাছে বেড়ে ওঠার পরে শিশুটি অল্প বয়সে মারা গিয়েছিল। এই রহস্যের উদ্ধার আজও হয় নি। আইনস্টাইনের জীবনের অনেক তথ্যই কিন্তু অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে । 

পরিবারের এত বাধা থাকলেও তাঁকে অগ্রাহ্য করে আইনস্টাইন ১৯০২ সালে মিলেভাকে বিয়ে করেন। কিন্তু শিশুটিকে তাঁরা ফেলে যান ভাগ্যের হাতে। মিলেভার পরিবারই সম্ভবত তার মৃত্যু পর্যন্ত দেখা শোনা করত। কারো কারো মতে আইনস্টাইন তাঁর কেরিয়ারের স্বার্থেই মেয়েকে একপ্রকার বিসর্জন দেন। কারণ বিয়ে না করে পিতা হলে তাঁর পেটেন্ট অফিসে চাকরিটা হয়ত থাকত না। 

১৯০০ সালে তাদের ডিগ্রি প্রোগ্রাম শেষে, মিলেভা মারিচ কিন্তু অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের চেয়ে উচ্চতর গ্রেড পেয়েছিলেন। আইনস্টাইন ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে ১ পেয়েছিলেন, 

মিলেভা পেয়েছিলেন পাঁচ নম্বর, যা সর্বোচ্চ সম্ভাব্য গ্রেড। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার সময় তিনি পিছিয়ে পড়েন। যখন পুরুষ অধ্যাপক মিলেভার ক্লাসের চার জন পুরুষের প্রত্যেককে ১২ জনের মধ্যে ১১ দিয়েছিলেন, তখন তিনি পেলেন মাত্র ৫। আইনস্টাইন স্নাতক হয়ে গেলেন। মিলেভা হয়ত নারীবিদ্বেষের শিকার হয়ে আর তা পারলেন না। 

ডিগ্রি পেলেও আইনস্টাইনের চাকরি ছিল না। এই দম্পতি একসঙ্গে গবেষণা করেছিলেন, আশা করেছিলেন যে এটি মিলেভার জন্য একটি ডিগ্রি এবং আইনস্টাইনের জন্য একটি চাকরি পাইয়ে দেবে। আইনস্টাইন মিলেভাকে লিখেছিলেন, “আমার স্ত্রী ডক্টর হলে আমি কতটা গর্বিত হব ভাবতে পারিনা”। তবে আশ্চর্য কথা হল তাঁদের প্রথম নিবন্ধে কেবল আইনস্টাইনের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। কোথাও মিলেভার নাম নেই । 

এদিকে মিলেভাকে বিয়ে করলেও আইনস্টাইন তাঁর প্রথম বান্ধবী মেরি উইন্টেলারকে কিন্তু ভুলে যাননি। যার সঙ্গে তাঁর ব্রেক আপ হয় সেই ১৮৯৭ সালে। ১৯১০ সালে, মিলেভা যখন তাদের দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভবতী ছিলেন, তখনও আইনস্টাইন মেরিকে লিখে যান প্রেমপত্র । 

১৯০৩ (১৯০২?) সালের ৬ জানুয়ারি মিলেভা মারিচ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে বিয়ে করেন। তাঁদের সন্তান সংখ্যা তিন। লিসারেলকে বাদ দুই পুত্র, হান্স অ্যালবার্ট (জন্ম ১৪ মে, ১৯০৪) এবং এডুয়ার্ড (জন্ম ২৮ জুলাই, ১৯১০)। কাজ করতে করতে অ্যালবার্ট গবেষণা চালিয়ে যান ও অবশেষে ১৯০৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এই ১৯০৫ সালে প্রকাশ হয় তাঁর দুনিয়া কাঁপানো তিনটি পেপার। The theory of Brownian motion, The photon theory of light The theory of relativity. এই পেপারগুলো থেকে শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তের উন্মেষ । 

এরপর আইনস্টাইনকে আর ঘুরে তাকাতে হয় নি। আমাদের বিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা, অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাদের চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে এই পেপার থেকে। 

এর অনেক পরে ১৯১৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। ১৯১৭ সালে বেরোয় অভিকর্ষ নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব। 

এদিকে সময় কাটতে থাকে। মালিভা সংসার ও দুটি ছেলেকে বড় করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর নিজের বৈজ্ঞানিক কেরিয়ার থেকে যায় ঘরের এক কোণে। অ্যালবার্টকে বড় হতে হবে, তাঁর জন্য সব দিয়ে দেওয়া তাঁর কাছে কিছুই না। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে আইনস্টাইন ধীরে ধীরে সরতে থাকেন মিলেভা থেকে দূরে, আরো দূরে। শেষকালে তাঁর সদা নূতনের প্রয়াসী মন তাঁকে বলে অনেক হয়েছে, আর না। মন যেতে চায় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। অ্যালবার্ট ১৯১৪ সালে মিলেভাকে বিবাহবিচ্ছেদের অনুরোধ করেন। তা শুনে মিলেভার মনে কি অনুভূতি হয়েছিল তার কোন খবর ইতিহাস রাখে না। তবে মিলেভা বিবাহ বিচ্ছেদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি আইনস্টাইনকে ছাড়বেন না। দুটি সন্তানের কথা তিনি অ্যালবার্টকে ভাবতে বলেন। বিরক্ত ও বিব্রত হলেও আইনস্টাইন শেষে রাজী হন একসাথে থাকতে। কিন্তু তাঁর বদলে মিলেভাকে দিয়ে এক বিখ্যাত চুক্তিতে সই করালেন। সেটা ভারী মজার। আসছি সে কথায়। 

বড় মানুষেরা অনেক জটিলতা ধারণ করেন তাঁদের অস্তিত্বে। তাঁদের প্রেম ভালবাসাও একটু জটিল হয়। বিবাহিত থাকার সময় মিলেভার এই মন্তব্যটি আগামী জটিলতার সম্ভাবনাকে আন্ডারলাইন করে দেয়। 

“তিনি শুধু বিজ্ঞানের জন্য বেঁচে আছেন। আমরা তাঁর কাছে গুরুত্বহীন এবং দ্বিতীয় স্থান দখল করেছি। “ 

আইনস্টাইনের প্রেমের নাটকীয় চিত্রনাট্যে সবচেয়ে বড় রোল এই মিলেভার। কিন্তু তাঁর জীবনে প্রেম ও বিড়ম্বনা, আশা ও অপমান দুইই ঝুলি ভরে ভাগ্য তাঁকে দিয়ে গেছে। আইনস্টাইন তাঁকে নোটিস দিলেন বিচ্ছেদের। মিলেভা তাতে অরাজী। তিনি 

চান না অ্যালবার্টকে ছেড়ে দিতে। তাঁকে শিক্ষা দেবার জন্য আইনস্টাইন যত পেরেছেন মানসিক অত্যাচার করেছেন। তাঁকে ব্যবহার করেছেন ঘর পরিষ্কার করার কাজের লোক হিসেবে, দিনে তিনবার খাবার দিয়ে যাবার রাঁধুনী হিসেবে। কোনও শারীরিক অন্তরঙ্গতা স্ত্রী হিসেবে মিলেভা আশা করতে পারবেন না। কথা বলার পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয় নি। মিলেভা এই সমস্ত শর্ত পূরণ করেও বিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন প্রাণপণে, তবু বিয়েটি স্থায়ী হয়নি। ১৯১৯ সালে এই দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ 

হয়। 

আইনস্টাইন মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে জগত সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন, এবং প্রায়শই পড়াশোনায় এতটাই ডুবে যেতেন যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যকেও অবহেলা করেছিলেন। মিলেভা এমন এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন যিনি যেন বিবাহিত ছিলেন তাঁর কাজের সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনীরা আসলে নর্ম সঙ্গিনী। আর কিছু নয়। পিকাসোর 

কথা মনে এসে যায়। 

এবারে আসি সেই অদ্ভুত চুক্তিপত্রে। 

১৯১৪ সালে অস্থায়ী বিচ্ছেদের পরে, বিয়ের ১১ বছর পরে, আইনস্টাইন ফিরে আসার শর্ত হিসাবে তাঁর স্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত দাবিগুলির একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন। দু’জনেই তাদের দুই সন্তানের স্বার্থে সম্পর্ক বজায় রাখতে উন্মুখ ছিলেন। তবে আইনস্টাইন মিলেভা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে আপস করতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলেন না। মিলেভার সম্বন্ধে কোনও দায়িত্ব ছিল না বরং স্ত্রীকে এই সুযোগ দেবার জন্য তাঁর ছিল প্রচুর দাবি। 

সুশৃঙ্খল প্রায় উকিলের ভাষায় লেখা, বিবাহ বজায় রাখার চুক্তি ছিল এরকম। মিলেভা নিশ্চিত করবেন: 

১. আমার জামাকাপড় এবং লন্ড্রি নিয়মিত উপযুক্ত ভাবে করা হবে, 

২. আমার ঘরে নিয়মিত আমার তিন বেলা খাবার পাঠানো হবে, 

৩. আমার শয়নকক্ষ এবং পড়াশোনার জায়গা পরিষ্কার রাখা হবে, এবং আমার ডেস্কটি 

কেবল আমার ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। 

এছাড়া চুক্তিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, মিলেভা এলবার্টের সঙ্গে কোনভাবেই কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক করার চেষ্টাও করবেন না। 

আরো ছিল। বিজ্ঞানী মানুষ, খুঁটিনাটি সমস্যাও যাতে তাঁর না হয় তাই লেখা ছিল- মিলেভা অবশ্যই এড়িয়ে যাবেন: 

৪. বাড়িতে আমার সঙ্গে বসে থাকা; 

৫. আমার সঙ্গে বাইরে ভ্রমণ করা। 

আইনস্টাইন মিলেভার কাছে এটি পুরোপুরি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে যদি তারা তাদের বিবাহ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তাঁর কাছ থেকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে শূন্য অন্তরঙ্গতা আশা করা উচিত। তাই দাবির তালিকার তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে যে মিলেভা “তাঁর কাছ থেকে কোনও অন্তরঙ্গতা আশা করবেন না।“ 

আরো আছে। 

৬. আমি অনুরোধ করলে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করবেন; 

৭. আমি অনুরোধ করলে আপনি আমার বেডরুম বা পড়ার ঘর বিনা প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ ছেড়ে চলে যাবেন

৮। আচরণের মাধ্যমে বাচ্চাদের সামনে বাবাকে ছোট না করার অঙ্গীকার করতে হবে। 

এসব দানবীয় ও অপমানজনক শর্ত শুধুমাত্র দুই সন্তানের স্বার্থে, মিলেভা মেনে নিয়েছিলেন। এর পরে আরও পাঁচ বছর পরে তাঁরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বিবাহবিচ্ছেদের সময় আইনস্টাইন তাঁর স্ত্রী মিলেভাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি যদি কোনদিন নোবেল পুরষ্কার জিততে পারেন তবে তিনি তাকে পুরো টাকাটাই দিয়ে দেবেন। ১৯২১ সালে তিনি সত্যিই নোবেল পেলেন ও $৩২০০০ (আজকের মূল্যে প্রায় $৪৮৫,০০০) এর মত মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়েছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন কিনা তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কারো মতে মিলেভা এবং তাদের দুই ছেলের সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সমস্ত অর্থের মাত্র এক চতুর্থাংশ 

জমা দিয়েছিলেন। বাকিটা তিনি আমেরিকান বন্ডে বিনিয়োগ করেন এবং ১৯২৯ সালের ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশে সব টাকাই গচ্চা হয়ে যায়। আবার আইনস্টাইনের প্রতি অনুকূল ঐতিহাসিকদের মতে টাকাটা মিলেভাই বোকার মত রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ করেন। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মিলেভা এই টাকার কোন সুফল পান নি, তাঁর জীবন কাটে খুবই দুরবস্থায়। 

বিবাহবিচ্ছেদের পর মিলেভার জীবন সহজ ছিল না। তিনি তাঁর ছেলেদের সঙ্গে স্যুরিখে ফিরে আসেন। একটি বোর্ডিং হাউস চালিয়ে ও টিউশানি করে কোনমতে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। তিনি হতাশা এবং একাকীত্বেও ভুগছিলেন। তাঁর ছেলে এডুয়ার্ড ১৯৩০ সালে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে এবং সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়। তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে একটি মানসিক হাসপাতালে। ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মিলেভা নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। মিলেভা আর বিয়ে করেননি বা তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মজীবনও পুনরায় শুরু করেননি। আইনস্টাইনের জীবনে তাঁর কাজ বা তাঁর ভূমিকার জন্য কোনও স্বীকৃতি না পেয়ে তিনি মারা যান। আইনস্টাইনের প্রেমিক জীবন খুব রঙ্গীন কিন্তু তাঁর প্রথম স্ত্রী ও বিজ্ঞানসঙ্গিনীর জীবনের কাহিনী ততটাই ট্রাজিক। 

আইনস্টাইনের নতুন অধ্যায়ের নায়িকা তাঁর নিজের কাজিন এলসা। ১৯১২ সালে, আইনস্টাইন তাঁর কাজিন এলসা লোভেন্থালের (এলসা বিবাহিত এবং তাঁর স্বামী পোষাক ব্যবসায়ী ম্যাক্স লোভেন্থাল) সঙ্গে সম্পর্ক শুরু করেছিলেন এবং এরই পরিণতিতে আসে মিলেভার সঙ্গে বিচ্ছেদ। অ্যালবার্ট এবং এলসা ছিলেন আপন মামাতো ভাই বোন আবার দূর সম্পর্কের খুড়তুত ভাই বোন। অনেক জল গড়ানোর পরে অবশেষে তিনি মিলেভাকে বিচ্ছেদ দিয়েই দেন এবং মিলেভাকে ডিভোর্স দেওয়ার সাড়ে তিন মাস পর ১৯১৯ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে এই বিয়েটাও ছিল অদ্ভুত ও জটিল। 

এলসার মেয়ে ইলস আইনস্টাইন এবং মেডিসিনের একজন অধ্যাপক জর্জ নিকোলাই এর মধ্যে চিঠিতে জানা গেছে আইনস্টাইনের মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সঙ্গে একই সময়ে ইলসের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল। তিনি নিকোলাইকে লিখেছিলেন। “সে আমাকে অথবা মাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। আমি জানি যে A. আমাকে খুব ভালবাসে, সম্ভবত অন্য যে কোনও পুরুষের চেয়ে বেশি, তিনি গতকাল নিজেই আমাকে তাই বলেছিলেন।“ 

আইনস্টাইন ১৯৩৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এলসার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, তবে এই বিয়েও খুব সুখের হয় নি। এলসা তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় আইনস্টাইনের সহকারী হিসাবে কাজ করে কাটিয়েছিলেন, তাকে তাঁর কেরিয়ার, আর্থিক হিসাবপত্র রাখা এবং দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে সহায়তা করতেন। আইনস্টাইন কিন্তু ক্রমাগত তাকে ঠকিয়ে যেতেন। এলসা তাও জানতেন খুব ভাল করে। এলসার সঙ্গে বিবাহিত থাকাকালীন আইনস্টাইনের একাধিক সম্পর্ক অব্যাহত ছিল। 

দুই স্ত্রী ছাড়াও আইনস্টাইনের বান্ধবীর সংখ্যা কম ছিল না। তিনি যেমন মুক্ত মনে বিজ্ঞানের রহস্য উদ্ধার করায় ব্যাকুল হতেন, তেমনি ভাল বান্ধবী জুটলে, উদাস সন্ন্যাসী হয়ে থাকতেন না একেবারেই। ১৯২৩ সালে আইনস্টাইন তাঁর সেক্রেটারি বেটি নিউম্যানের প্রেমে পড়েন। উপরন্তু, মার্গারেট লেবাচ (স্বর্ণকেশী অস্ট্রিয়ান), এস্টেলা কাটজেনেলেনবোজেন (একজন ধনী ব্যবসায়ী মহিলা), টনি মেন্ডেল (একজন ধনী ইহুদি বিধবা), এবং এথেল মিচানোভস্কি (বার্লিনের সমাজকর্মী) সহ তাঁর আরও অনেক বিশেষ বান্ধবী ছিল। 

আইনস্টাইনের সাধারণত একই সময়ে একাধিক নর্মসঙ্গিনী থাকতেন। তাঁর পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাঁর দুই থেকে তিন জন মহিলার এই হারেম চালিয়ে যাবার কথা জানতেন। তিনি এই সঙ্গিনীদের সঙ্গে ছুটি কাটাতেন, কনসার্ট শুনতে যেতেন। আইনস্টাইনের সঙ্গীত প্রীতির কথা আমরা শুনেছি। রমণীপ্রীতি ব্যাপারটা অত প্রচারিত নয়। এর জন্য ঝুঁকি নিতেও তাঁর ভয় করত না। ১৯৩৬ সালে তাঁর স্ত্রী এলসার মৃত্যুর 

পরে, আইনস্টাইনের সম্পর্ক হয় অনেক কম বয়সী মার্গারিটা কোনেনকোভার সঙ্গে। পরে জানা যায় মার্গারিটা জোসেফ স্ট্যালিনের আদেশে রাশিয়ার গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল পারমাণবিক বোমার আমেরিকান টেকনোলজির গোপন তথ্য সংগ্রহ। মার্গারিটা অবশ্য আইনস্টাইনের কাছ থেকে পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে কোনও মূল্যবান তথ্য পাননি কারণ আইনস্টাইন এর গবেষণার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন 

না। 

যাই হোক, মার্গারিটাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি থেকে কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, আইনস্টাইন তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। তিনি চিঠিতে তাদের আদরের নাম “আলমার” উল্লেখ করেছিলেন, যা তাদের দুজনের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে তৈরী। মার্গারিটা ছিল আইনস্টাইনের শেষ প্ৰেম ৷ 

১৯০৪ এবং ১৯১০ এর মধ্যে, অ্যালবার্ট মিলেভা সংসার করেছেন স্বাভাবিক ভাবে। মিলেভা দুটি পুত্র, হান্স অ্যালবার্ট এবং এডুয়ার্ডের জন্ম দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর স্বামীর পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁর গবেষণার কাজ করেছিলেন। এবং আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে পাঁচটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, এই বছরকে বলা হয় তাঁর “অলৌকিক বছর। 

বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 যেখানে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন দেখিয়েছেন যে ভর এবং শক্তি সমতুল্য, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, এবং এটি থেকে তিনি যে আপেক্ষিকতাতত্ত্বটি উদ্ভূত করেছিলেন তা আইনস্টাইন নামটিকে একটি ঘরোয়া শব্দ করে তুলেছিল। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীর প্রথম স্ত্রী, গণিতবিদ মিলেভা আইনস্টাইন-মিলেভার এই মহান কাজগুলিতে যে কতখানি অবদান ছিল তা খুব কম লোকই জানেন। 

বাইরে যখন আইনস্টাইনের খ্যাতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে, পর্দার আড়ালে, মিলেভা মারিচ পরিসংখ্যান গণনা করছেন, তত্ত্বগুলি নিয়ে জোর তর্ক করছেন এবং তাঁর স্বামীর 

জন্য বক্তৃতা তৈরি করছেন। যখন তিনি জুরিখে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন, মিলেভা তাঁর লেকচার নোটগুলি লিখেছিলেন। পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যখন আইনস্টাইনের কাছে একটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছিলেন, তখন মিলেভা তাঁর জবাব দিয়ে দেন। 

মিলেভার অবদান এভাবে মুছে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এই দম্পতির সম্পর্ককে তাদের সমসাময়িক পিয়েরে এবং মেরি কুরির সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্য খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওঁরা দুজন ছিলেন বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব, স্বামী স্ত্রী একটা যৌথ ইউনিট হিসাবে তাঁরা কাজ করতেন। ১৯০৫ সালে, ক্যুরি দম্পতি রসায়নে পাওয়া নোবেল পুরষ্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন। পিয়েরে সব জায়গায় তাঁর স্ত্রীর প্রতিভার উচ্চ প্রশংসা করতেন। তাঁর মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুর পরে, মেরি ক্যুরির নতুন গবেষণা দেখে মেরি ক্যুরির নিজস্ব প্রতিভা ও শক্তি সম্পর্কে কোনও সন্দেহ রাখা যায় না। 

মিলেভা আইনস্টাইন-মারিচের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিন্তু গোলমেলে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে কোনও কৃতিত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য তাঁর প্রথম বছরগুলির পরে কোনও ঝোঁক দেখাননি। মিলেভার গণনা যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রণয়নে গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল তার অনেক ইঙ্গিত রয়েছে। বিশেষত, গণিত আইনস্টাইনের শক্তির জায়গা হিসাবে পরিচিত ছিল না । 

তাঁর স্বামী আরও বিখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, মিলেভা তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, “আমি কেবল আশা করি এবং কামনা করি যে খ্যাতি তাঁর মানবতার উপর ক্ষতিকারক 

প্রভাব ফেলবে না । “ 

মনে হয় তাঁর এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ ছিল। অ্যালবার্টের পেপারের বেশীর ভাগ গাণিতিক গণনাই মিলেভের করা। আইনস্টাইনের প্রথম দিকের পেপারে সহ-লেখক হিসাবে তাঁর নাম কিন্তু ছিল, যে পেপারের জন্য তাঁর স্বামী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার জিতবেন ১৯২১-২২ সালে। 

যদিও যে কেউ দেখতে পাবেন, বিবাহিত থাকার সময় আইনস্টাইনের গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অবদান যে উচ্চস্তরে পৌঁছেছিল, বিচ্ছেদের পরে কখনো আর সেই স্তরে পৌঁছতে পারে নি। 

আইনস্টাইনের জীবন মহামানবদের গোপন জীবন দর্শনের একটা ইঙ্গিত দেয়। মনে হয় তাঁদের কাছে নিজের কাজ ও নিজের ইগো ও পৃথিবীতে নিজের স্থান সম্বন্ধে এত বড় ধারণা থাকে, যে অন্য সব মানুষ আসলে তাঁদের কাছে উপরে ওঠার এক একটা সিঁড়ি মাত্র প্রতিপন্ন হয়। মহামানবরা বোধহয় সাধারণ মানুষকে কখনই তাঁদের সমগোত্রীয় মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে ধরেন না। 

বিজ্ঞানের মতই আইনস্টাইনের জীবনে প্রেমের এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে৷ তাঁর নিজের কথায়- 

“কর্তব্যপালন নয়, প্রেম আমাদের সবচেয়ে ভাল শিক্ষক।” 

না। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি দিয়ে আপনি প্রথম প্রেমের মত একটা দারুণ ব্যাপারকে বোঝাতে পারবেন না। ওসব বিজ্ঞানের কৌশল এখানে খাটবে না।“ 

অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের প্রতিভার চোখ ঝলসানো দীপ্তি কিন্তু তাঁর নিজের প্রেমের জীবনে ছাপ ফেলেনি। তাঁর লাভ লাইফ অগোছালো সম্পর্ক, ঝামেলাপূর্ণ বিবাহ এবং তিক্ত সমাপ্তিতে পূর্ণ ছিল। 

তিনি একবার বলেছিলেন যে তিনি নিজেকে, শরীর এবং আত্মাকে বিজ্ঞানের কাছে বিক্রি করেছেন। ডক্টর ফাউস্টাস জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধির বদলে তাঁর আত্মা বিক্রি করেছিলেন মেফিস্টোফিলিসের কাছে। আইনস্টাইনের সঙ্গে এটম বোমার সম্পর্ক যদিও একটু ঘোলাটে, তিনি জীবনে শয়তানি করে বা অন্যায় করে ঐশ্বর্য ভোগ করেছেন এমন বলার কোন জায়গা নেই। 

বিজ্ঞান তো ঈশ্বরও নয়, শয়তানও নয়। সে কি করে আইনস্টাইনকে করে তুললো প্রায় নিষ্ঠুর, সহানুভূতি হীন এক তেজস্ক্রিয় মানুষে, করে তুললো এক উদাস প্রেমিক যে শুধু নারীকে এক্সপ্লয়েট করে নির্দ্বিধায় । যার বুদ্ধি আছে, শরীর আছে, মন নেই? মনে হয় প্রেমের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এখনো লেখা বাকী রয়ে গেছে। 

তথ্যপঞ্জী 

https://arxiv.org/ftp/arxiv/papers/1204/1204.3551.pdf 

https://www.livescience.com/46061-einstein-chaotic-love-life.html 

https://www.quotewishesmsg.com/albert-einstein-quotes.html 

https://medium.com/lessons-from-history/love-life-of-albert-einstein-90ffcc42a1ba 

https://www.encyclopedia.com/women/encyclopedias-almanacs- transcripts-and-maps/einstein-maricmileva1875-1948 

https://www.ranker.com/list/einsteins-list-of-demands-for-his-wife/stephanroget 

https://allthatsinteresting.com/mileva-maric 

https://www.grunge.com/641587/the-untold-truth-of-albert-einsteins-first-wife/ 

https://metro.co.uk/2018/04/02/einsteins-misogynist-manifesto-harsh-list-rules-scientist-gave-long-suffering-wife-7420388/ 

https://www.openculture.com/2013/12/albert-einstein-imposes-on-his-first-wife-a-cruel-list-of-marital-demands.html 

https://sarahnaimi.com/2018/06/women-in-science/mileva-maric- the-women-who-took-einsteins-nobel-prize-money-struggle-of-mothers-in-science/ 

https://allthatsinteresting.com/lieserl-einstein

 

About the Author :

Basudev Gupta, age about 70 years old, is an entrepreneur in software designing and export. He lives in Kolkata.

 

 

 

Love Notes : Einstein by Basudev Gupta

6 thoughts on “Love Notes : Einstein by Basudev Gupta

  • April 9, 2024 at 2:49 pm
    Permalink

    “যিনি যেন বিবাহিত ছিলেন তাঁর কাজের সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনীরা আসলে নর্ম সঙ্গিনী। আর কিছু নয়।”
    এটি একটি বেদনাদায়ক সত্য। সঙ্গী বা সঙ্গিনী বহু প্রতিভাধরের কাছে একটি মনোরঞ্জক সিনেমা বা থিয়েটার-এর বেশি কিছু নয়।
    বিজ্ঞান-বিষয়ে বা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা বলতে যে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, প্রেমের আঙিনায় সেই কন্ঠেই অসত্যের সপ্তসুর।
    কেউ অর্থের কাছে অসহায়, কেউ যৌনতার কাছে।

    Reply
  • April 9, 2024 at 10:52 pm
    Permalink

    Excellent article. A towering DANOBIO scientist failed to cope up with the demand of love and submission. He was restless in science, so also in social life.
    It also proves that he was no god, just a man of flesh.
    Thanks to the Author.

    Reply
  • April 11, 2024 at 8:37 pm
    Permalink

    অতি চমৎকার পরিশ্রমী লেখা।
    স্বাভাবিক ভাবেই একটু বড় হয়ে গেছে – না হলে অবশ্য তথ্য ঘাটতি হতে পারতো !
    ভালো লাগলো।

    টুকরো টুকরো করে কিছুটা জানা ছিল – একসঙ্গে সবটা দেখে মনে হয়, শুধু জটিল এবং অদ্ভুত-ই নয়, মেধার এই খনির গভীরে একট বিমূর্ত ছায়া যেন তার জীবনজোড়া – যাতে, এই দানবিক প্রতিভাকে balance করতেই হয়তো পদে পদে ব্যক্তিগত জীবনের এই ‘অস্বাভাবিকতা’-গন ব্যাটিং করতে করতে চলেছে। (শুধু ‘অস্বাভাবিক’ই নয়, সদা পাপবোধে আক্রান্ত পরিচিত এই ‘সু-শীতল’ সমাজের চোখে কিছুটা হয়তো ঘৃন্যও বটে!)

    মেধা ও প্রতিভা আলো দেয়।

    প্রেম ও শরীরের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা অশেষ – স্থানকালপাত্র বিশেষে কত কত কথাই যে রচিত হয়েছে, হচ্ছে,হবে !

    মানুষ দোষেগুণে মানুষই রয়ে যায়।

    আর,সর্বাঙ্গসুন্দর শুধু ঈশ্বর নামক ইউটোপিয়া!

    আবার বলি, বড় ভালো লিখেছেন বাসুদেব গুপ্ত মশাই!

    Reply
  • April 12, 2024 at 3:20 pm
    Permalink

    অতি চমৎকার পরিশ্রমী লেখা।
    স্বাভাবিক ভাবেই একটু বড় হয়ে গেছে – না হলে অবশ্য তথ্য ঘাটতি হতে পারতো !
    ভালো লাগলো।

    টুকরো টুকরো করে কিছুটা জানা ছিল – একসঙ্গে সবটা দেখে মনে হয়, শুধু জটিল এবং অদ্ভুত-ই নয়, মেধার এই খনির গভীরে একট বিমূর্ত ছায়া যেন তার জীবনজোড়া – যাতে, এই দানবিক প্রতিভাকে balance করতেই হয়তো পদে পদে ব্যক্তিগত জীবনের এই ‘অস্বাভাবিকতা’-গন ব্যাটিং করতে করতে চলেছে। (শুধু ‘অস্বাভাবিক’ই নয়, সদা পাপবোধে আক্রান্ত পরিচিত এই ‘সু-শীতল’ সমাজের চোখে কিছুটা হয়তো ঘৃন্যও বটে!)

    মেধা ও প্রতিভা আলো দেয়।

    প্রেম ও শরীরের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা অশেষ – স্থানকালপাত্র বিশেষে কত কত কথাই যে রচিত হয়েছে, হচ্ছে,হবে !

    মানুষ দোষেগুণে মানুষই রয়ে যায়।

    আর,সর্বাঙ্গসুন্দর শুধু ঈশ্বর নামক ইউটোপিয়া!

    আবার বলি, বড় ভালো লিখেছেন বাসুদেব গুপ্ত মশাই! 👌👌

    Reply
  • April 12, 2024 at 3:22 pm
    Permalink

    “যিনি (আইনস্টাইন) যেন বিবাহিত ছিলেন তাঁর কাজের সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনীরা আসলে নর্ম সঙ্গিনী। আর কিছু নয়।”
    এটি একটি বেদনাদায়ক সত্য। সঙ্গী বা সঙ্গিনী বহু প্রতিভাধরের কাছে একটি মনোরঞ্জক সিনেমা বা থিয়েটার-এর বেশি কিছু নয়।
    বিজ্ঞান-বিষয়ে বা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা বলতে যে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, প্রেমের আঙিনায় সেই কন্ঠেই অসত্যের সপ্তসুর।
    কেউ অর্থের কাছে অসহায়, কেউ যৌনতার কাছে।

    Reply
  • April 12, 2024 at 5:08 pm
    Permalink

    “যিনি (আইনস্টাইন) যেন বিবাহিত ছিলেন তাঁর কাজের সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনীরা আসলে নর্ম সঙ্গিনী। আর কিছু নয়।”
    এটি একটি বেদনাদায়ক সত্য। সঙ্গী বা সঙ্গিনী বহু প্রতিভাধরের কাছে একটি মনোরঞ্জক সিনেমা বা থিয়েটার-এর বেশি কিছু নয়।
    বিজ্ঞান-বিষয়ে বা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা বলতে যে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, প্রেমের আঙিনায় সেই কন্ঠেই অসত্যের সপ্তসুর।
    কেউ অর্থের কাছে অসহায়, কেউ যৌনতার কাছে।
    – অরিজিৎ চৌধুরী

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *