Scent of a Story by Basudeb Gupta

অণুসন্ধান ১১
কুরিয়ার।

নির্মলদা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওর এসিসট্যান্ট চাঁচর এসে বলে গেল –
-তোর বাপ শহীদ হয়েছিল পার্টির জন্য তাই তোকেই ডেকেছে। নৈলে এ বাজারে বুঝিস তো।
চান করে চুল আঁচড়ে হলুদ টিশার্ট গায়ে দিয়ে বেরোতে যাবে, মা এসে সামনে দাঁড়ালো। হাতটা ভালো ওঠে না, তাও কোনমতে তুলে কপালে ছুঁইয়ে দিল দুটো ফুল বেলপাতা।
-দুগ্গা দুগ্গা। তুই আবার জোরে জোরে কথা বলে ফেলিস না যেন। শান্ত হয়ে থাকবি। ডেকেছে যখন একটা কিছু হবে। আর তো চলছে না রে।
বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় । চোখের জলে অমঙ্গল।
স্বপনের বেশ হাসি পেল। যেন চাকরির ইন্টারভিঊ দিতে যাচ্ছে। প্রাইমারী টিচার, ব্যাংকের ক্লার্ক, নিদেনপক্ষ সেনা বাহিনীতে জওয়ান। একটা নিঃশ্বাস উঠে এল বাবার কথা মনে পড়ে।
-বাবা স্বপন ভালো করে পড়। না হলে এই অটো চালিয়ে, আর পার্টির হয়ে খেটে দিন কাটবে।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। মার কান্না শুরু হবার আগেই। ঘর তো নয় ফুটপাথে জবরদখল করা খুপরি। সারারাত বৃষ্টি হয়ে সামনে ড্রেনটা উপচে পড়ছে। লাইটপোস্টে ঝোলানো কেবল আর নেটের তারের জটপাকানো পিন্ডটা মাটিতে পড়ে লুটোচ্ছে। কোনমতে রাস্তায় নামতে একটা ইলেকট্রিক রিক্সা হুস করে বেরিয়ে গেল আর ফিনকি দিয়ে রাস্তার পাঁকজল দৌড়ে এল ওর দিকে। যেতে যেতে একটা খিস্তি ছুঁড়ে দিয়ে খিক খিক করে হাসতে হাসতে অমি বা অমিতাভ হুস করে চলে গেল। যতটা জোরে ই রিক্সা যেতে পারে।

-কুইকিতে কাজ আছে। করবি? নির্মলদা ওকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে, চারদিক ফাঁকা হলে জিজ্ঞেস করে। পার্টি অফিস না বলে ঝুপড়ি বলাই ভালো। তার মধ্যেও একটা টেবিল চারটে লাল প্লাস্টিকের চেয়ার আর ঝেড়ে আনা স্ট্যান্ড ফ্যান খরর খরর করে ডিউটি করে যাচ্ছে।
-যা বলবেন তাই করব। খেতে হবে তো। বলুন কবে থেকে।
-দাঁড়া অত অধৈর্য হলে কি চলে। কাজটা শোন। বাইক আছে?
-বাইক কোথায় পাবো। খাবার জোটে না।
-থাম তো। খাবার জোটে না! কজনের জোটে। সাইকেল আছে?
-বাবার একটা ভাঙ্গা পড়ে আছে জং ধরা।
-ঊফফ পার্টিকে কি হাতে ধরে খাইয়েও দিতে হবে নাকি। আচ্ছা শোন সাইকেল আমরা দেবো। ড্রেস গ্লাস টুপি এসব কুইকি থেকেই দেবে। ওরা একটা ফোনও দেবে। ফোন চালাতে পারিস? ম্যাপ দেখতে?
-একটু আধটু পারি বন্ধুদের দেখে। নিজের তো নেই।
-তোকে ২৪ ঘণ্টা রেডি থাকতে হবে। যেই ফোন বাজবে একটা মেসেজ যাবে তাতে অর্ডার লেখা থাকবে। কোন হোটেল থেকে নিবি আর কোথায় ডেলিভারী করতে হবে। তোকে সেটাতে রাজী আছির একটা বোতাম টিপতে হবে।
-যদি না পারি। খুব দূরে বা মার জন্য ওষুধ আনতে…
নিরুদা বা নির্মল ওর মাথা থেকে পা অব্দি জরীপ করে। একবার ফ্যানটার দিকে তাকায়। রুমাল বার করে মুখ মোছে। বিলিতি মিষ্টি গন্ধ। তারপর বলে,
-তুই কাজ চাস কি চাস না! মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর এলেন একেবারে। শোন। ওদের এপে নিয়ম আছে তিনবার রিফিউজ করলে চুক্তি অবৈধ হয়ে যাবে। হাজার ছেলে অপেক্ষায় রয়েছে কেউ একজন নিয়ে নেবে।
-না না নিরুদা কাজটা আমার চাই। আমি রিফিউজ করার কথা মনেই আনবো না।
-এই তো শহীদের ছেলের মত কথা। পার্টি তোকে এই কাজটার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তুই যদি বেগড়বাঁই করিস, পার্টির প্রেসটিজ কোথায় যায়। ঠিক আছে। পাকা কথা বলে আমি জানিয়ে দেবো। যা এখন।
স্বপন যাই যাই করেও উসখুস করছে। নিরুবাবু দেখে হাসলেন। একটা পানমশলা মুখে ফেলে বললেন
-তোর মাইনে হবে মাসে এখন চার হাজার টাকা। ভালো কাজ করলে বাড়বে।
স্বপন মুখটা করুণ করতে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন প্রান্জল করে
-পার্টিকে খরচ চালাতে গেলে পার্টি একটা পারসেন্টেজ না পেলে কি করে সার্ভিস দেবে বল? ফিফটি। ফিফটি। আর আমি তোকে চান্স দিলাম বলে আমার টোয়েন্টি। এর থেকে কমে হয় না। যা। খবর পাঠাব। মাসীমাকে গিয়ে পেননাম কর। শহীদের স্ত্রী। কত সম্মান। ২২শে অগাস্টের অনুষ্ঠানেও এসেছেন। নে যা।

ফোন আসে। সাইকেল ছোটে। নানা রকম খাবার। গেটেড কমিউনিটির আবাসিকরা কেবলই অর্ডার দেন। রাত ১২টা বেজে যায় শনি রবিবার। চার দিকে এখন পিজি গিজগিজ করছে। সারাদিন কম্পিউটার আর ফোন নিয়ে বসে তারা কাস্টমার সার্ভিস দেয় সারা পৃথিবীকে। তাদের আর রান্না করে খাবার শক্তি থাকে না। অর্ডার। কুইকি শুধু অর্ডার নেয় আর সাইকেল বাইক বাহিনীকে মেসেজ পাঠায়। ১০০ টাকায় ৩০ টাকা কমিশন। বিরিয়ানি পিজ্জা কাবাব চাও মিন মোমো কত রকমের যে খাবার আর তাদের কত রকম যে গন্ধ। বাহিনীর বড়দা সিনিয়র অভিষেক সিং। সে বলে গন্ধ নয় ফ্লেভার। ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজন। দেখ শুঁকেই কেমন মোটা হয়ে যাস। শুনে সবাই ব্যাপক হাসে।

গন্ধ পেলে খিদে কমে না। বেড়ে যায়। এটা সবাই মনে মনে জানে। স্বপনও। চার হাজার এক সময় কত টাকা ছিল। সংসার কোনমতে চলে। ডাল ভাত খেয়ে। কাবাবের গন্ধ শুঁকে। সারাদিন কখনও ১৪ ঘন্টাও কাজ করতে হয়। সাইকেল চালিয়ে চালিয়ে পায়ের পেশিগুলো শক্ত ইঁট। শরীরে নিঃসীম ক্লান্তি নিয়ে যখন স্বপন ঘুমোতে যায় তখন আবছা ঘুমে কুয়াশার মত ভেসে আসে এক টিয়া। সবুজ শাড়ী, টুকটুকে ঠোঁট আর মাধবীলতার মত দুটি বাহু।
-কি রে ঘুমোবি না?
মার মন সব বোঝে। হাল্কা হাতে কপালে মাখিয়ে দেয় ঘুম।

চারদিকে শোনা যাচ্ছিল অসুখের কথা। আসছে আসছে করে রেলের ইন্জিনের মত করোনা ঢুকেই পড়ল শহরে। একে একে সব বন্ধ হতে থাকলো। প্রথমে অফিস কাছারি। তারপর মল ও বড় বড় বিপণি। সিনেমা থিয়েটার। বাজার। তারপর এপাং ওপাংকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ঝপাং করে লকডাউন। দিল্লীর মসনদকে বাংলা কোনদিনই খুব রেয়াত করে নি। এবার করল। করতেই হল। কারণ হাসপাতাল ভর্তি হতে শুরু করল আর শ্মশান থেকে অনেক দূরে ধূধূ প্রান্তরে খোলা হল স্পেস স্টেশন। একে একে সাদা চুল লোল চর্ম পেনশনভোগী বুড়োর দল সেখান থেকে লঞ্চ হতে থাকল ছায়াপথে।

যত রেস্টুরেন্ট হোটেল বাজারে লোক যাওয়া বারণ হতে থাকল তত বাড়তে থাকলো কুইকির ব্যবসা। নতুন যোগ হলো মাস্ক থারমোমিটার আর স্যানিটাইজার। খাবার পিক আপ করার আগে একটা বন্দুক থার্মোমিটার দিয়ে মাপতে হবে জ্বর আছে কিনা। তারপর মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করে তবে খাবার তুলে দেওয়া হবে হাতে। যারা ডেলিভারী নেন তারা চেক করেছেন এসব। কমেন্ট দেবেন। অবশ্য তাঁরা মাস্ক নাও পরতে পারে। ৩০ বছরের নীচে যারা তারা বীরপুরুষ। কিন্তু যত ধাপার মাঠে কসমোনটদের সংখ্যা বাড়ল তত বীরপুঙ্গবদের মুখে উঠতে লাগল নানা কম্পানীর সাদা কালো নীল লাল ডিজাইন ম্যাচ করা মুখোস।

কাজের চাপ আরো বেশি। দিন নেই রাত নেই। একটা অর্ডার হতে না হতেই আরেকটা। মার হাঁফানী বাড়ছে দিন দিন। বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার সময় মা প্রাণপণে তখনকার শাসক দলের সংগে খালি হাতে লড়ে গিয়েছিল। বাঁচাতে পারে নি। বাঁ হাতটা দু টুকরো হয়ে এখনো অকেজো। আর তিন দিন শীতে হাজত্যবাস করে নিমোনিয়া সেরে গেছে কিন্তু রেখে গেছে এই হাঁপানি। ওষুধের দাম হু হু করে বাড়ছে। চার হাজার টাকায় আর হয় না। নিরুদাকে বলে লাভ হয় নি। কুইকি নাকি লস খাচ্ছে, এখন টাকা বাড়াবে না। মহামারীর সময় শোনা যায় সব কম্পানী লস খায়। মহামারী শেষ হলে দেখা যায় তাদের সম্পদ দশগুণ বেড়ে গেছে।
সেটা স্বপনরাও বোঝে। কি করবে।

হঠাৎ ঝড় এসে শহরটাকে দলে মচলে দিয়ে চলে গেল। সাতদিন সব বন্ধ। মাসের টাকাটাও পাওয়া যায় নি। অবশেষে কুইকি খুলতেই অর্ডারের পর অর্ডার। স্বপনের শরীরটা কয়েকদিন ভালো নেই। তার মধ্যেই ডেলিভারী চলছে। ভাগ্যিস জ্বর নেই গায়ে। ওর বয়সীদের সত্যিই কাবু করতে পারেনি ভাইরাস। কিন্তু ঝড় চলে যাবার সাতদিন পরে মায়ের ধুম জ্বর এলো এক রাতে। একশো এক দুই। গায়ে ব্যথা উঠতে পারছে না। দুটো ক্রোসিন দিয়ে কোনমতে জ্বরটা বাগে মানাবার চেষ্টা করল স্বপন। তিন দিনের দিন জ্বর ছেড়ে গিয়ে হঠাৎ উঠল হাঁপানির টান।

কুইকির ফোন নিজের কাজে ব্যবহার করা বারণ। তবু নিরুদাকে ফোন করল স্বপন।
-দাদা মার যে জ্বর। কাজে যাবো কি করে।
-মা করোনা বাধিয়ে বসে নি তো?
-কি করে বলি। টেস্ট করতে গেলে ১০০০ টাকা যাবে। ও ক্রোসিন আর হাঁপানির ওষুধে সেরে যাবে ঠিক। কিন্তু বেরোব কি করে? মাকে কে দেখবে?
-কেন তোর একটা বান্ধবী আছে মিষ্টি দেখতে। কি নাম যেন? বল না।
শুকনো জিভে কোনমতে স্বপ্ন বলল
-ত্বিয়া।
-ওই হল। টিয়া। ওকে বল না মাকে দেখতে?
-ওর বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। বেরোন বন্ধ। নিরুদা আজকের দিনটা-
– হয় না রে। রিফিউজ করলেই চুক্তি শেষ। আমেরিকান স্টাইল। হায়ার এন্ড ফায়ার। আর তোকে ফায়ারই যদি করে তোর মার ওষুধ কিনবি কি করে খেতে দিবি বা কি করে।
সত্যি কথা। মার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বপন বেরিয়ে যায়…
-তুই চিন্তা করিস নি। ঠাকুর আমায় দেখবে। ফিরে এসে দেখবি আমি সেরে গেছি। জ্বরজারি কি প্রথম হল নাকি আমার।

ঠাকুর সব লক্ষ্য রাখেন। স্বপন বেরিয়ে যাবার এক ঘণ্টা পরে তিনি পাঠিয়ে দেন তাঁর অনুচর সাইটোকাইনকে। সে এসে স্বপনের মার ফুসফুসে গিয়ে ঘনিয়ে তোলে এক ঝড়। অক্সিজেন ধরবার অজস্র কোষগুলো একে একে শুয়ে পড়ে সেই ঝড়ে। অক্সিজেন কমতে থাকে ৯০ ৮০ ৭০….

সারাদিন স্বপন বিলি করতে থাকে কাবাব বিরিয়ানী চাও মিন। যারা এফোর্ড করতে পারে তারা খাবে এটাই তো নিয়ম। ধাপার মাঠে আর একটা রকেট রেডি করা হয়। ছায়াপথে উড়ে যাবে স্বপনের মা। সংগে যাবে তার সন্তানের সুখী হবার স্বপ্ন।
সাইকেলটা দরজায় লাগিয়ে স্বপন ঘরে ঢোকে। মা একা শুয়ে আছে। আর ওষুধ লাগবে না।

About Author


বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং

Scent of a Story by Basudeb Gupta

One thought on “Scent of a Story by Basudeb Gupta

  • November 1, 2022 at 3:06 pm
    Permalink

    আবার, অনবদ্য। সাময়িক কাহিনী।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *