আমাদের স্বাধীনতা। -বাসুদেব গুপ্ত।

আমাদের স্বাধীনতা।

-বাসুদেব গুপ্ত।

আমরা যারা জন্মেছি স্বাধীন হয়ে স্বাধীন দেশে, আমাদের আবার স্বাধীনতা দিবস কি? কোন পন্গু যদি পা ফিরে পায়, আবার চলতে পারে, তার কাছে সেই পাবার দিনটা একটা উদযাপনের যোগ্য। হা-গরীব বেকার যখন হঠাৎ একটা চাকরী পেয়ে যায় , সে বেলা বোসকে দৌড়ে গিয়ে ফোন করে। আর চিরদিন এই তারিখটি তার মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে। আমেরিকায় বলা হয় ৯/১১ এর দিন যখন দুটি বিমান আমেরিকার মর্মে গিয়ে আঘাত করে, সেই মুহূর্তে কে কোথায় ছিল প্রত্যেকের মনে থাকে। ডিমেনশিয়া হলেও।

আমরা তো স্বাধীন হইনি। আমরা স্বাধীন হয়েই জন্ম নিয়েছি। আমাদের কোন স্মৃতিতে নেই ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭এর মধ্যরাত। যখন পৃথিবীর সব চেয়ে বড় পরাধীন দেশ হঠাৎ স্বাধীন হয়ে গেল তখন তিন মহাসাগর থেকে বয়ে আসা উত্তাল হাওয়া 36 কোটি ঘুমন্ত মানুষের কানে কানে কি মন্ত্র বলেছিল আমরা জানি না। হয়ত সেই রাতে কেউ ঘুমোয় নি। বা সেই রাতে সবাই অবশেষে স্বাধীন দেশের মাটিতে শুয়ে প্রথম শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিল। আমরা জানি না। আমরা জানি না যে শহীদ প্রাণের পরোয়া না করে, শুধু ভবিষ্যতের দেশবাসী ভাই বোনের কথা ভেবে লাঠি গুলি ফাঁসীকে থোড়াই পরোয়া করে এগিয়ে গেছিল আত্মবলিদানের বেদীর দিকে, তাদের মা বোন ভাইরা সেদিন যে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছিলেন, সে অশ্রু সুখের না শোকের। আমরা জানি না ৩৬ কোটি মানুষের বেওসা শেষ পর্যন্ত হাতের নাগালে পেয়ে দেশপ্রেমী বণিক, চটকলমালিক, আড়তদারদের জিভে জল উলসিয়ে পড়েছিল কিনা।

আমরা কিছু জানি না। তাই স্বাধীনতা দিবস আমাদের কোন দিবস নয়। আমাদের কাছে, এই দিন আধুনিক বাংলা ভাষায় বললে, কোন মাইনা রাখে না। ছোটবেলায় দেখা পাড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকু বা দাদুর পতাকা উত্তোলন এখন বিস্মৃতির গহ্বরে। রেডিওতে বাজত দেশপ্রেমের গান, ধন ধান্য পুষ্পে ভরার জাতিশ্রেষ্ঠতার আহ্বান থেকে শুরু করে, মুক্তির মন্দির সোপান তলের স্বর্গগত শহীদর স্বর্গে গিয়েও এই অপূর্ব দেশ মিস করছে তার জন্য অনুশোচনা। সেদিন মাংস ভাত হতো। ছুটির দিন। সকাল বেলাটা দেশভক্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে কাটিয়ে, বাকী দিনটা হৈ হৈ, হয়ত বিকেলে ফুটবল ম্যাচ। স্বাধীনতা ছিল আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া এক ঐশ্বর্য। যা তখনও আফ্রিকা এশিয়ার অনেক দেশ পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে আমরা সেটা দিব্যি বাবার সম্পত্তির মত পেলে কার না ভালো লাগে। ১৫ই আগস্ট ছিল তেমনি দেখাবার দিন। প্রতিবেশীর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না আর আমাদের রোজ বিরিয়ানি। গর্ব না হয়ে যায়।

দিন যায়। দেখতে দেখতে ৭৫ বছর। কবেকার কথা ১৯৪৭। এর পরে কত দেশ নেতা নেত্রীরা দেশ ও সরকারী প্রচারে আলো করে থাকলেন। চাচা, জয় কিসান, গরীবী হঠাও, নয়া অর্থনীতি, মারুতি গাড়ী চড়ে অবশেষে স্বাধীনতাও এখন একটু বুড়ো। পলেস্তারা খসে গেছে এখানে ওখানে, দেশের চলার পথে এখানে ওখানে পট হোল, মানুষের চোখে ঝুলতে থাকা একটু একটু সন্দেহ, অবিশ্বাস। যেটা পেরেছিলাম সেটা পড়ন্ত কম্পানির শেয়ারের মত রংচটা। ঠিক কি পেয়েছিলাম ৭৫ বছর আগে? সেটাই তেমন দামী কিছু হীরের টুকরো নয়, নাকি আমরা তার মর্যাদা দিতে পারিনি, আমরা তার যোগ্য হতে পারি নি? এই প্রশ্ন না এসে উপায় নেই। আজকের প্রজন্মের কাউকে স্বাধীনতার গুণগান শোনাতে গেলে তারা এই প্রশ্ন করবেই।

স্বাধীনতা তো একটা একক সুর নয়। তা একটা সিম্ফনি। তার হাজার দিক। সহস্র প্রকাশ। মননের স্বাধীনতা, চিত্তকে মুক্ত করার স্বাধীনতা, শির উচ্চ করার স্বাধীনতা। আবার ভালোবাসবার স্বাধীনতা, সুর তোলবার গান গাইবার স্বাধীনতা। মেলার স্বাধীনতা, আবার একা সমুদ্রের মহিমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার স্বাধীনতা। ১৯৪৭ দিয়েছিল শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা। আপাতদৃষ্টিতে তার মূল্য ছোট মনে হতে পারে কিন্তু বাস্তবে এই স্বাধীনতা সেই মূল ধারা যা থেকে তৈরী হয় অজস্র বিভিন্ন স্বাধীনতার শাখা নদী, হ্রদ, ও ঝর্ণা ধারার। এই স্বাধীনতা আমাদের হাতে ক্ষমতা দেয় যাতে আমরা ঠিক করতে পারি আর কোন স্বাধীনতা আমাদের চাই। কি করে আমরা সত্যিকারের মানুষ হবার দিকে শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে পারি। আর শেষে সারা বিশ্বের স্বাধীন মনুষ্যত্বের সিম্ফনিতে আমাদের এই পরম ভালবাসার দেশের সুরটি মেলাতে পারি।

৭৫ বছর চলে গেছে। আমাদের এখন সেই স্বাধীনতা গুলো বেছে নেওয়ার ও প্রতিষ্ঠিত করার সময়। আমরা কি সেই কাজে হাত মেলাতে প্রস্তুত? তবেই বুঝব স্বাধীনতা দিবস আমাদের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান দিন। বুঝব ভগৎ সিং সুভাষ আজাদের বলিদান মিথ্যে ছিল না। স্বাধীনতার জয় হোক।

* * *

About the Author :

Basudev Gupta, age about 70 years, is an entrepreneur in software designing and export. He lives at Konkata.

আমাদের স্বাধীনতা। -বাসুদেব গুপ্ত।

One thought on “আমাদের স্বাধীনতা। -বাসুদেব গুপ্ত।

  • September 14, 2022 at 6:48 pm
    Permalink

    খুব ভালো, মন জাগানো কথা।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *