স্বাধীনতা, আমার চোখে – মনোজিৎ মজুমদার

যে সময়টায় বড় হচ্ছি, সকালে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাই, বিকেলে পাড়ার মাঠে শীতে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ক্যাম্বিস বল আর বর্ষায় শত সীবনে জর্জরিত ফুটবল পেটাই, সে সময়টায় দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাটি ইতিহাস বইয়ের সাল তারিখে মাখামাখি ভয় ধরানো ঘুম জড়ানো পাঠক্রমে রূপান্তরিত হয়েছে। পনেরো আগস্ট আর ছাব্বিশ জানুয়ারি স্কুলে যাওয়া কেবলই বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করে একটি পড়াশোনাহীন দিন কাটানো। দেশপ্রেম সেখানে পাড়ার দোকানের মাছের চপে মাছ খুঁজে পাওয়ার মতো ঘটনা। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোরটায় মাছ ছিল? সে বললে, গন্ধ একটা পাচ্ছিলাম বটে।

তবে অভিভাবকরা আমাদের চঞ্চল চিত্তে দেশপ্রেমের ভাবনা জাগরিত করার চেষ্টায় অচঞ্চল ছিলেন। তখন জন্মদিনের উপহার মানেই বই। রংচঙে মোড়কটি খুলতেই ঠিক পূর্বমুহূর্তের আনন্দটি নির্বাপিত হতো। মহাপুরুষদের জীবনীতে বইএর তাক ভরে উঠত। বন্ধুদের গালি দিলে হাত উল্টে বলত, কি করব, বাবা ঐ বইটাই কিনে দিল যে! সে বইগুলো অসূর্যমস্পর্শা হয়ে আলমারিতেই বাকি জীবন অতিবাহিত করত। গুরুজনদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চপে মাছের গন্ধটা অনুপস্থিত থাকত।

ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি তখন। বাবা মার সঙ্গে ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’ দেখে বিক্ষুব্ধ মনের উর্বর মাটিতে কল্পনার ফুল ফোটাতে ফোটাতে বাড়ি ফিরলাম। ইশ্, ক্ষুদিরাম ধরা না পড়লে আরও কতগুলো ইংরেজকে মারতে পারতো! ফাঁসির দড়ি পড়ানোর আগে যদি বিপ্লবীরা দল বেঁধে হামলা করত!

সুনীল গাভাস্কারের পর ক্ষুদিরাম বসু আমার দ্বিতীয় হিরো হয়ে গেলেন। ইতিহাস বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনপঞ্জি যা তৈরি করতে পারে নি, একটি সিনেমা সুচারুভাবে তাই সম্পন্ন করল। ইংরেজ জাতটার প্রতি বিদ্বেষ। সেই বয়সে দেশের প্রতি ভালোবাসার বাসাটি একটি বিদেশী জাতের প্রতি বিদ্বেষের ইঁটে ইঁট গেঁথে তৈরি হল। আজ পরিণত বয়সে এসে মনে হয়, দেশপ্রেম প্রকাশের এইটিই সরকারি নিয়ম বুঝি। ইংরেজরা তো সেই কবেই দেশ ছেড়ে গেছে। এখন স্বদেশেরই এ জাত, সে ধর্ম, অন্য দলকে বিদ্বেষের বিষে নিষিক্ত করতে পারলেই দেশভক্তের তকমা পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পদ্মফুলখানি এখন পূতিগন্ধময় দলদলমাঝে দিব্যি শোভা পাচ্ছে। সে শোভার আনন্দ দূর থেকে নিলেই হয়। কাছে গিয়ে পাঁক ঘাঁটাঘাটি করার দরকার কি! কিছু লোকের যেন সব ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি।

* * *

About the author :

Manojit Majumder, age about 55 years, is a data expert and works with a PSU bank at a senior position. He now lives in Delhi.

স্বাধীনতা, আমার চোখে – মনোজিৎ মজুমদার

4 thoughts on “স্বাধীনতা, আমার চোখে – মনোজিৎ মজুমদার

  • August 14, 2022 at 4:57 pm
    Permalink

    Bodoi sotti kathagulo likhechen. Aaro lekhar apekhye roilam

    Reply
    • August 14, 2022 at 10:42 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ

      Reply
  • August 15, 2022 at 1:09 pm
    Permalink

    খাঁটি কথা। একদম আমার অভিজ্ঞতার সংগে মিলছে।

    Reply
    • August 19, 2022 at 9:42 am
      Permalink

      ধন্যবাদ। আমাদের বড় হয়ে উঠবার সময়কাল নিশ্চয়ই কাছাকাছি।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *