আমার কথা – by Nilanjana Mitra

আমার কথা
(মধ‍্য দিনের বিজন বাতায়নে)
-নীলাঞ্জনা মিত্র

তখন আহমেদাবাদে আমার সকালগুলো কাটতো জেঠুর সাথে আড্ডা মেরে I সকালে সৌম্য অফিস চলে যেত। আর আমি জেঠুর সঙ্গে গল্প করতে করতে রান্নার সবজির তরকারি সব কেটে রান্নার যোগাড় করে ফেলতাম ।একদিন আমি আর জেঠু বসে এরকম আড্ডা মারছি। হঠাৎ দেখি একটা হনুমান জানালা দিয়ে হঠাৎ করে ঢুকে আসলো। সেই প্রথম এত সামনে থেকে একটা হনুমান দেখা। আমি চিৎকার করে নিজের বেড রুমের দিকে ছুটলাম। জেঠু একখানা লাঠি নিয়ে তাড়া করতে গেল, সে don’t care , সঙ্গে সঙ্গে জানলা দিয়ে পালিয়ে গেল ।আরেকবার জেঠুর সাথে বসে আড্ডা মারছি। দেখি একটা কি সুন্দর ময়ূর আমাদের জানালায় এসে বসলো। ময়ূর যে উড়ে এসে জানালায় বসে আমি কখনো জানতাম না ।সেই প্রথম কাছ থেকে ময়ূর দেখা, কি যে অপূর্ব তাকে দেখতে্। ‌পরে শুনলাম ময়ুর নাকি প্রচন্ড ঠোকরায় ,আর খুব ব্যথা পাওয়া যায় ।

আহমেদাবাদ এর এরকম অনেক গল্প আছে। মনে আছে সৌম্য অফিসে বেরিয়ে গেলে আমি ঘরে একা, অনেক দিনই জেঠু থাকতেন না, চলে যেতেন নিজের কাজে। আমি বসে বসে কখনো লেখালেখির কাজ করতাম কখনো প্রশ্নপত্র চেক করতা্‌ম। ওহো বলাই হয়নি আমি শিক্ষকতা করতাম। এরকম একবার প্রশ্নপত্র তৈরি করছি জানালার ধারে বসে। দেখি কুটুর কুটুর করে আমার পাশে কে একটা এসে বসলো একটা মিষ্টি সুন্দর কাঠবিড়ালি। তাকে দেখে সে কি আনন্দ ! কি করি, সে এত কাছে এসে বসেছে যে একটু নড়লেই পালিয়ে যাবে। তাই চুপ করে বসে রইলাম। দেখি আমি খসখস করে লিখছি বলে সে আমার হাতের উপরে উঠে বসে আমার কলমটা ধরার চেষ্টা করছে। ওই যে একটা ছোট্ট স্পর্শ, দুটো হাতে একটা এইটুকুনি প্রাণীর কি ভরসা, কি বিশ্বাস তা্‌ খুব ভালো লেগেছিল।

আমদাবাদের এরকম অনেক ঘটনা আছে। আমার বিয়ের ঠিক পরে , বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই আমরা আমদাবাদ বদলি হয়ে গেছিলাম। সেখানে অনেক রকমের নতুন নতুন জিনিস শিখেছিলাম । প্রথমতো জানলাম যে আমি বড় হয়ে গেছি, আমি এখন মহিলাদের দলে । তার আগে তো মেয়েদের দলে ছিলা্ম। পাড়ার মহিলারা এসে বললেন যে আমরা একটা বিবাহিত মহিলাদের ক্লাব চালাই তুমিও জয়েন কর। নিজেকে বেশ লাগছিল, সব সময় মায়ের কথা শুনছি শাশুরি মায়ের কথা মেনে চলতে হচ্ছে ,এ যেন আমার নিজের রাজত্ব যা খুশি করতে পারি, কেউ কিচ্ছু বলার নেই ।ও নামটাই তো বলিনি আমার, আমি নীলাঞ্জনা আর আমার সেই বিশেষ একজনের নাম হচ্ছে সৌম্য, আমাদের বিয়েটা চটজলদি হয়ে গেছিল চাকরি , করতে করতে সৌম্যর সাথে আলাপ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ে করবো বলে মনস্থির করি সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মারা রাজি হয়ে গেলেন বিয়েটা হয়ে গেল বিয়ের প্রথম বছরটা কলকাতাতেই ছিলাম তারপর ওই যে বললাম বছর ঘুরতে না ঘুরতে সৌম‍্য আমেদাবাদে একটা নতুন চাকরি নিয়ে চলে এল। আমেদাবাদের অনেক সুখের স্মৃতি আছে । হনুমান, ময়ূর কাঠবিড়ালি। একদিন ছোট ছোট অনেকগুলো বাচ্চা আমার বাড়িতে বেল বাজিয়ে চলে এলো । আমি তো তাদেরকে দেখে অবাক। তাদেরকে চিনি না জানি না,আমিও তখন নতুন কিন্তু শিক্ষকতা করতাম বলে ্বাচ্ছাদের সাথে বেশ মিশতে পারতাম। একটি ছোট্ট ছেলে দেখি একদিন আমার বাড়িতে এসে বলছে” বিস্কিট “আমি একটা বিস্কিট বার করে তার এক হাতে দিলাম সে অন্য হাত বাড়িয়ে দিল এবং তারপর প্রতিদিন একই সময় সে আমার বাড়িতে বেল বাজাতো দুটি কথা” বিস্কিট” আরেকবার” বিস্কিট”; বিস্কিট নিতো সোজা সটান বেরিয়ে যেত।একদিন আমি ভাবলাম যে দেখি বাচ্চাটা একা কোথায় যায় ? দেখলাম সে একা কোথাও যায় নি, nanny ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন ,”কি জানি কেন তোমার বাড়ি এসে বেলটা বাজায় রোজ আমি দাঁড়িয়ে থাকি তারপরে তার বিস্কিট খাওয়া হয়ে গেলে তাকে নিয়ে চলে যাই”। কিরম মনে হলো এই বাচ্চাটার সম্পর্কে আর একটু জানা দরকার।তারপর একদিন বাচ্চাটার পিছু পিছু গেলাম। ন্যানিকে বললাম কই দেখি তোমাদের বিল্ডিংটা কোথায়?আমাদের বিল্ডিংয়ের চার-পাঁচটা বিল্ডিং পড়ে তাদের বিল্ডিং। গিয়ে দেখি একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন,ভদ্রমহিলা ঠিক নয় আমার সমবয়সী। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত, বললেন, আপনার বাড়িতে বুঝি আমার ছেলে রোজ বিস্কিট নিতে যায়? আমি মাথা নেড়ে মুচকি হাসলাম। এরপর ওর সাথে বেশ ভাব হয়ে গেল আমার। জানলাম ওর নাম জয়উর। তারপর থেকে যতদিন আমেদাবাদে ছিলাম, জয়া আর আমি দুজনে খুব কাছের হয়ে উঠলাম। আমার জীবনের অনেক কিছুই জয়ার কাছ থেকে শেখা । একবার বরের জন্মদিন করব বলে বিশাল আয়োজন করেছি আনেককে নেমন্তন্ন করেছি, হোটেল থেকে খাবার order করেছি , নামটা আজও মনে আছে কাবি্‌র, ভাবলাম যে সবাইকে নেমন্তন্ন করি জয়া সঙ্গে সঙ্গে এসে আমাকে বলল ,”আমার জন্য আলাদা প্লেট করবি না ,এই যে ক্যাটরিং সার্ভিস ওরা প্লেট হিসেবে দাম নেয়। কি করবি জানিস, তোর প্লেট জল দিয়ে ধুয়ে আমায় দিয়ে দিবি আমি আর তুই ,বেশ এক প্লেটে খেয়ে নেব আর ছেলেকেও খাইয়ে নেব,” আমি তো শুনেই অবাক। কিছুই জানিস না সংসার করতে, এসেছিস।

সত্যি তাই, কিছুই তো জানতাম না, এসে গেছিলাম সংসার করতে। এরকমই একদিন আমার মনে আছে তখন আমি গানের ক্লাসে যাই একজন স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পীর কাছে গান শিখতে। হঠাৎ সিড়ি দিয়ে উঠছি, মাথাটা কেমন ঘুরে গেল । গুরুমাকে বললাম মাথা ঘুরছে , বমি পাচ্ছে খুব অ্যাসিডিটি হয়েছে। তিনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার দেখে বললেন আপনার এসিডিটি নয় এক নতুন একটা অনুভূতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগ হচ্ছে, আপনি মা হতে চলেছেন। কি ভয় পেয়েছিলাম কথাটা শুনে, পারবো মা হতে ?এখনো তো সংসারের কিছুই যেনে উঠতে পারলাম না ,এরপরে মাও হয়ে যেতে পারবো ? শেষকালে যদি কিছু ভুল করে ফেলি ?বাচ্চার যদি কোন ক্ষতি করে ফেলি। চট করে ফোন করলাম প্রথমে সৌম‍্যকে,’ ডাক্তার বলেছে আমি নাকি মা হতে চলেছি ‘ সৌম্য শুনেই আরো ঘাবড়ে গেল বলল সেকি রে পারব আমরা ?তারপরেই হঠাৎ মনে হলো ছোট মিষ্টি বেবি আসবে আমাদের বাড়িতে কি মজাই না হবে, নানান রকম কম্প্লিকেশন এর মধ্যে পড়ে গেলাম জানেন ,কি যেন বলল সেকি নেই টুবে এ আছে পা ও উপরে করে প্রায় ঝুলিয়ে রেখে দিল তিন মাস কেটে গেল, তিন মাস পর ডাক্তার বললেন না আপনার বেবির sack এ ঢুকে গেছে, সে কি মজা । সবাই খুব বকাবকি করতে লাগলো ওখানে বাচ্চা হলে হবে? কলকাতায় চলে এসো। তবে আর কি, একটা মস্ত ট্রেন জার্নি করলাম আড়াই দিন লাগতো। সৌম‍্যকে আহমেদাবাদ এ ছেড়ে কলকাতা পৌঁছে গেলাম, আমাদের বাড়ি । আমাদের বাড়িটা আর আমাদের বাড়ি নেই এখন সেটা মায়ের বাড়ি। মায়ের বাড়িতে এসে যখন ডাক্তার দেখালাম তখন ডাক্তার বললেন আরো অনেক ঝামেলা আছে অনেক কেয়ার করতে হবে। দোতলার ঘরটাতে একাই থাকতাম। বাবা অফিসে বেরিয়ে যেতেন, মা ও চাকরি করতেন। আমার ছোট বোন দাদু ঠাকুমা সবাই একতলায়,আমি একাই ছাদের ঘরে, চারিদিকে আকাশ পাখি ,কিন্তু সৌম্যকে খুব মিস করতাম। খালি মনে হতো সঙ্গে থাকলে না জানি কত মজা হতো। আমরা গল্প করতাম নাম ঠিক করতাম ফোনে ফোনে কথা হতো ঠিকই, কিন্তু এটা আমার আজও মনে হয় এতে প্রাণের পরশখানি থাকেনা। এরই মধ্য সে নড়াচড়া করতে লাগলো ,ডাক্তারকে বললাম ‘আচ্ছা বলুন তো এবার কি সে আমায় শুনতে পায়? ডাক্তার বললেন ,’অফকোর্স যখন ইচ্ছে আপনি ওর সাথে কথা বলতে পারেন গল্প করতে পারেন’। আমিও তার সাথে কত গল্প,কত গান করতাম, গল্প পড়ে শুনাতাম সন্ধ্যেবেলা। আমি আর আমার ছোট্ট সোনা কত কথাই বলেছি জানেন, গান করলে দিব্বি নড়েচড়ে বসতো। এভাবেই পুজো এসে গেল। হঠাৎ পঞ্চমী দিন একটু শরীর খারাপ লাগছিল মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবার চলেই যাবে প্রাণটা। , প্রচন্ড কষ্ট হছিল মাকে বললাম ,গেলাম হাসপাতালে সেখানে তারা তড়িঘড়ি সনোগ্রাফি করে জানতে পারলো সে চলে গেছে।

তারপর কয়েকটা দিন কি করে কাটালাম বলতে পারছিনা তবে মনে আছে আবার যখন নিজের দিকে তাকাতে পারলাম তখন আমি আমেদাবাদ পৌঁছে গেছি। আবার সেই একা বাড়িতে থাকা, ,আমি আর আমার একাকীত্ব। আমাদের পাশের বাড়িতে একজন মহিলা থাকতেন, হঠাৎ একদিন ঢুকে এলেন বললেন,’ সে কি তুমি এমন কান্নাকাটি করছ দুঃখ পাচ্ছো কেন ,এর তো কোনো কারণ নেই। আমার এক বান্ধবী ছিল তার বছর বছর একটা করে বাচ্চা হতো আর মরে যেত। ও তোমারও এরকম দু-একটা মারা গেলে কিছু হবে না। কেন জানিনা আমি অবাক হয়ে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম এটাই বোধহয় উনার মনে হয়েছে সবচেয়ে স্বাভাবিক উপায় সান্তনা দেয়ার। বলাই বাহুল্য সান্তনা তো হলোই না, আরো যেন বুকটা মোচড় দিয়ে আমার সমস্ত অস্তিত্বকে শেষ করে দিয়ে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম।
আজ এত বছর পরেও কষ্ট কিন্তু কমেনি কিন্তু হ্যাঁ কষ্টটাকে সহ্য করতে শিখে গেছি। শুনেছিলাম আমি একটি স্টিল বর্ণ পুত্র সন্তান প্রসব করেছিলাম। তার মুখটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসে।
যাক সে কথা। আজ অনেক বছর হয়ে গেছে। এখন আমি এক কন্যা সন্তানের জননী ,এখন আর আমি আমেদাবাদে থাকি না আমেদাবাদ থেকে আমরা নাগপুরে এসেছিলাম, এখন থাকি গোয়াতে।

পরের বারের লেখায় নাগপুরের কিছু গল্প বলবো আজ এই অবদি।

About the author :

Nilanjana Mitra, born and raised in Kolkata. An Educationalist by profession, a chronicler of mundane by nature.

আমার কথা – by Nilanjana Mitra

One thought on “আমার কথা – by Nilanjana Mitra

  • March 11, 2024 at 9:28 pm
    Permalink

    WAH, NILANJANA,
    WELL DESCRIBED.
    I TOO HAVE SWEETE MEMORIES OF BARODA ,A CITY OF GUJRAT. WILL SHARE WITH YOU SOME TIME.
    KEEP IT UP.
    VERY WELL DONE.
    BIMALDA

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *