Arijit Kathanchit

বিয়ে আর প্রেম-২

প্রেম ব্যাপারটা মেঘবাসরের উঁচুতলায় বা মাটির কাছাকাছি বাসন্তী হাওয়ায় ঘুরে ফিরে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও বিয়ের পর তা চলে না। দেহ তার দাবী নিয়ে দাঁড়ায়- বাইরের চাঁদ-ফুল-জ্যোৎস্না নয়, শরীরের চাহিদার ওপর-ই যে প্রেমানুভূতি দাঁড়িয়ে সেই সত্যটি মনে করায়। তাছাড়া, প্রেমের সম্পর্কে সামাজিক আচার, আনুগত্য, অধিকার ইত্যাদি যে বিষয়গুলো দুর্বল হীনভাব নিয়ে ঘোরাফেরা করে, বিয়ের পর তারাই জোরদার হয়ে পুলিশী নজরদারি করতে থাকে। অর্থাৎ, প্রেম কিছুটা মুক্তির হাওয়া লাগানো ব্যক্তিগত বিষয় হলেও বিয়ে একটি সামাজিক ও আইনী ব্যাপার যার বাঁধন কড়া আর ভাব ‘প্রেম থাকুক বা না থাকুক আমার বয়ে গেল।’

বিয়ের জোর- প্রেমের থেকে বিয়ের বড় হয়ে দাঁড়ানো কারো কারো কাছে ‘অন্যায়-অবিচার’ ধরণের কিছু মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যুক্তি বলে, বিবাহপ্রথাটি খুব কাজের না হলে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারতো না। কিন্তু, আধুনিক জগতে বিবাহপ্রথাটি ‘লিভ-ইন রিলেশন’, ‘সামূহিক বিবাহ’*, ‘একাকী বিবাহ’, ‘ডেটিং অ্যাপ’, পুতুল সঙ্গী ইত্যাদি নানা নবীন ও প্রাচীন প্রথার চাপে উত্তরোত্তর অবনমিত হতে হতে দাঁড়িয়ে আছে কোণঠাসা হয়ে। অনেক দেশে বিয়ে এখন নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম। তবুও প্রথাটি তার আদি ভিত্তিভূমি সমাজ বা পরিবারের শৃঙ্খলা, সন্তানের পরিচিতি ইত্যাদি নানা নিয়মের অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মও তার পাশে-‘তোমাদের জুটি হয়েছে ভগবানের ইচ্ছেয়’- এই কথা শুনলে, মন নরম হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে উত্তরাধিকারের সাথে জুড়ে দেওয়ায় বিবাহপ্রথার ভিত আরও শক্ত হয়েছে। গ্রহণযোগ্যতাও যে বেড়েছে, বিয়ের অধিকার পাবার জন্য সমকামীদের লড়াই তার মোক্ষম প্রমাণ।

মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি। তাকে প্রকৃতিরাণী তাঁর মূল উদ্দেশ্য, প্রজাতিকে টিঁকিয়ে রাখার পথে টানবেনই। তাই দেখছি, আপাতদুনিয়ায় তৃপ্তি না পেয়ে জাপানী যুবসমাজের একদল বাস্তবজগতে সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজতে মরীয়া।
লৌকিক কবি লিখেছেন-
“যত পারো থাকো পাখী আকাশ উপরে,
ধরায় নামিতে হবে আহারের তরে।।“

বিয়ের দুর্বলতা- তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতে, এমন কি ভারতের শিক্ষিত সমাজের স্বাবলম্বী বহু যুবক–যুবতী বিয়ে করতে চাইছে না। সেটি দেখে অনেকে বলেন, মানুষ যত সভ্য হবে, ততই লুপ্ত হবে বিবাহপ্রথা। মানুষ অর্ডার দিয়ে নিজের জন্যই তৈরি কৃত্রিম প্রেমাস্পদ বানিয়ে নিতে পারছে এখন। সেই সব মানবপ্রতিম যন্ত্রমানব (হিউম্যানয়েড রোবট) মিষ্টি ব্যবহারে ভবিষ্যতের প্রেমিক-প্রেমিকার জায়গা নিয়ে নেবে- বাড়ছে এই ভয়। ভার্চুয়াল প্রেম ছাড়াও এখনই নানা দেশে পুতুলের প্রতি প্রেম অতি জনপ্রিয়। ভাল পুতুলের দাম ৬০০০ ইউরো (অন্ততঃ ৫ লক্ষ টাকা)। এত টাকা কেন খরচ করছ? জিজ্ঞেস করায় আমেরিকা-ইংল্যান্ডের এক জন বলছেন, ‘আমার দাঁত খারাপ, চামড়াও ভাল নয়, আমার কাছে কে আসবে?’ আর এক জনের বক্তব্য, ‘আমার বয়স হয়েছে, সুন্দরী মেয়েদের দেখি, তাদের আমার প্রতি আগ্রহ নেই।’ তা ছাড়া জীবন্ত মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছে সামলে চলতে হয়, রেগে চড় মারলে পুলিশ আসে। পুতুলের কোন চাহিদা নেই, খাওয়ানোর সমস্যাও নেই, তাই এঁরা ইচ্ছে মত নানা বয়সের, নানা চেহারার একাধিক পুতুল বানিয়ে তাদের সাথে থাকছেন, বেড়াতেও যাচ্ছেন।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে রক্তমাংসের অর্ডারি মানুষ বানানোর ভয়ও ক্রমবর্ধমান। সে সব সম্ভাবনা কিছুটা দূরে থাকতে থাকতেই যে বিবাহসঙ্কট (আর তার হাত ধরে জনসঙ্কোচন) শুরু হয়েছে তা অতি দ্রুত আমাদের প্রজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। মানুষের জায়গায় প্রমাণ সাইজের পুতুল প্রেমিকার জন্মদিন পালন করে, নানা রকম পোশাক পরিয়ে ছবি তুলে এমন অবস্থা হয়েছে যে সত্যিকার ছেলেমেয়েদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশা শেখানোর জন্য জাপানে ক্যাম্প হচ্ছে, চীনের সরকার বাড়তি ছুটি দিয়ে প্রকারান্তরে বলছে, ‘যাও ডেটিং করো।’

সামাজিক স্বীকৃতি, বিশেষতঃ ব্যক্তিগত সঙ্কট ও বার্দ্ধক্যে পারস্পরিক নির্ভরতা আর শিশুদের রক্ষণাবেক্ষনের প্রয়োজন পূরণ করেছিল বিবাহপ্রথা। পরবর্তীকালে ঐ সব প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব অনেক দেশের সরকার নিয়ে নিয়েছে। সরকার যদি বাচ্চাদের আর অশক্ত বৃদ্ধদের দায়িত্ব নেয়, কেউ যদি জীবননির্বাহের জন্য সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ওপর নির্ভরশীল না থাকেন, ঈশ্বর চেয়েছেন, তাই মিলন-এ রকম স্থির বিশ্বাস যদি কমে, সন্তানের শখ মেটাতে শিশুদের জন্ম যদি ল্যাবরেটরিতেই হয়, বিবাহপ্রথার অস্তিত্বের অজুহাত (raison d’etre) ক্ষীয়মাণ হতে বাধ্য।

ইউরোপের বহু দেশের কাছে প্রতিটি শিশুই স্বাগত, আবশ্যিক নয় তাদের বাবা-মার পরিচয়। এশিয়াতে তা নয়। সে জন্য বিবাহবিলুপ্তি জাপান, চীন, কোরিয়া বা ভারতের পক্ষে অনেক বেশী ভয়ের কারণ। শিক্ষিত-স্বাবলম্বী যুব সমাজের এক বিরাট অংশ বিয়ে করতে চায় না-ভয় প্রতারণার, ঠকে যাওয়ার। যারা কম্পিউটারে তৈরি অবাস্তব কিন্ত প্রিয়ভাষী প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে সময় কাটায়, তাদের কারো কারো আশঙ্কা বাস্তব প্রেমিকারা নানা খুঁতের সাথে সাথে নিয়ে আসবে মিথ্যাভাষণের ঝুঁকি। আরও একটি ব্যাপার আছে। ভাল জীবিকার জন্য তৈরি হতে হতে ছেলেমেয়েরা পৌঁছে যাচ্ছে সন্তান উৎপাদনের সু-সময়ের প্রান্তসীমায়। একবার ত্রিশোর্‌দ্ধ ব্যাচেলর এক সহকর্মীকে বিয়ে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করায় বলেন, এতদিন ধরে একা থাকা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে!

বিয়ের ভবিষ্যৎ- কৃত্রিম মেধা আর হিউম্যানয়েড রোবট, ল্যাবরেটরিতে সন্তান উৎপাদনের যুগেও বিয়ে সম্পূর্ণ বাতিল না হলেও শারীরিক সম্বন্ধের, সন্তান উৎপাদনের সাথে বিয়ের একদেহী যমজ ভাবটি হয়তো কেটে যাবে। কৃত্রিম আপাতবাস্তব (ভার্চুয়াল রিয়ালিটি) দুনিয়ায় বাস্তব সঙ্গীর প্রয়োজন অনেকেই অনুভব করছেন না একথা ঠিক। এরা কেউ কেউ বাস্তব মানুষের সাথে কীভাবে আলাপ শুরু করা যায় তাও বুঝতে পারে না- এও সত্যি।

টোকিয়োতে থিতু এক ফরাসী একটি ক্লাব বানিয়েছেন যেখানে খোলা আলাপচারিতে যাতে মন খোলা থাকে, তার জন্য সভ্যদের মুখোশ পরে ঢুকতে হয়। চীনেও ছবিটা প্রায় এক রকম। তথাকথিত উন্নত সমাজ না পারলেও আদিবাসীদের কোন কোন গোষ্ঠী যুবসমাজের মেলামেশা, দেহের চাহিদা ইত্যাদির সমাধান বহু যুগ ধরে করে আসছে।

ভারতের এক ধরণের আদিবাসী সমাজে (মুরিয়া) বহু আগে থেকেই ঘোটুল নামে একটি প্রথা আছে যাতে সমাজ কৈশোরের আগে থেকে যৌবনোদ্গম পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। তারা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে একটি কুটিরে একসাথে থাকে। ছেলেমেয়েরা পর্যায়ক্রমে একে অন্যের সাথে রাত্রিযাপন করে এক ধরণের সমবিচার ও সমন্বয়ের পরিবেশ তৈরী করে, পছন্দসই সঙ্গী- সঙ্গিনী বাছার অধিকার থাকে না। এমন কি, বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত হবু বর বা বৌ-এর একত্র শয়ন বারণ। তখন নিজেদের বাদ দিয়ে অন্যদের সাথে রাত্রিযাপন বাধ্যতামূলক। এ যেন শুধুমাত্র শারীরিক টানের প্রেমহীন বিয়ে আটকানোর ফিল্টার। আধুনিক শিক্ষিত সমাজে বিয়ে আর প্রেমকে অনেকেই আলাদা করে দেখতে চান। ঘোটুল প্রথা যুগ যুগ ধরে সেটিই করে আসছে।

বিয়েকে আমরা যে ভাবে দেখছি, জিনিষের প্রাচুর্য, টেকনোলজির উন্নতির সাথে সাথে চাহিদার পরিবর্তন তাকে হয়তো ঠিক সেই ভাবে বেশীদিন থাকতে দেবে না। সঙ্কটের সময়ে সভ্য মানুষকে বার বার অতীত প্রথাকে পুনরাবিষ্কার করতে হয়, যেমন হাঁটা এড়ানো রকমারি যান বাহনের আবিষ্কারের পর ট্রেডমিল, জাঙ্ক ফুড-এর পর অরগ্যানিক খাদ্য, কৃত্রিম সারের ক্ষতি এড়াতে জৈব সার। আদিবাসীদের ঘোটুলপ্রথাও হয়তো সেভাবেই তথাকথিত সভ্যসমাজে ফিরে আসবে।

কিন্তু, তাতেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে কি? লেখাটা শুরু করেছিলাম প্রেম আর বিয়ের সমস্যাগুলো ব্যক্তির, বড় জোর মুষ্টিমেয় এক গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ- এই ভেবে। বিষয়টার মধ্যে যত ঢুকছি, ততই পরিধি বেড়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এই সমস্যার বীজ সভ্যতার মধ্যেই। যেন প্রজাতির বিলোপের অভিশাপ নিয়েই তার জন্ম।

*একদল মহিলা-পুরুষ যাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক ভাসমান ধরণের, কোন বিশেষ ব্যক্তি-নির্ভর নয়।

 

২৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০২৪                                                                              -অরিজিৎ চৌধুরী

 

তথ্যসূত্র

The Ghotul System: Chhattisgarh’s Muria Tribe Challenges Western Perceptions of Indian Culture – The Jaipur Dialogues

IJRTI (ijcrt.org)

দন্ডক শবরী, নারায়ণ সান্যাল, দে’জ পাবলিশিং, ২০২১

About the author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change, and fast-depleting groundwater reserves. Traveling, reading, writing articles, composing rhymes, and recitation are his hobbies.

Arijit Kathanchit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *