পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ২

পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ২

মন আর বস্তু বেশ আলাদা, কারণ প্রথমটি -অবস্তু, দ্বিতীয়টি বস্তু।  বস্তু থেকে পাওয়া সূত্রাবলী মন ও সমাজে খুঁজতে গেলে একটু অশুদ্ধ, একটু আলগা ভাব রাখা শুধু ভালো নয়, একান্ত প্রয়োজন। এবার সেই ঢিলে ভাব নিয়ে এগোনো যাক…

নিউটনের গতিসূত্রাবলী

প্রথম সূত্র বলে যে বাইরের কোন শক্তি প্রয়োগ  না হলে থেমে থাকা জিনিষ নড়বে না আর চলতে থাকা বস্তু চলতেই থাকবে।

ভেবে দেখছি, ছোটবেলায় বাইরের থেকে বাবা আর মাস্টারমশাইরা শক্তি প্রয়োগ না করলে খেলার মাঠে বা তার আশপাশেই আমার জীবন কেটে যেত- প্রথমে কয়েক বছর খেলে, আর পরে বহু দশক বাদাম বা আলু-কাবলি বিক্রি করে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই বাইরের শক্তি প্রকৃতির থেকে আসে। যতই আমরা নিজেদের জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধক ভেবে ফুলে-ফেঁপে থাকি না কেন, প্রকৃতিরাণী বাইরে থেকে মাঝে মাঝেই, ভূমিকম্প, বন্যা, মহামারী, ভাইরাস ইত্যাদি দিয়ে ঝুঁটি নাড়িয়ে না দিলে বিজ্ঞান চর্চায় গুলি মেরে সমস্ত মানুষজাতি আমার সাথে বাদাম বেচত। আর যাদের খেলায় মন নেই- সেই চেঙ্গিস, নেপোলিয়ন, হিটলার বা তাদের বংশধররা কোন বাধা না পেয়ে আজও সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াতো।

যে কোন জিনিষের রকমফের ঘটাতে মানুষ ওস্তাদ। সভ্যতার  বাড়াবাড়ির সাথে বাইরের শক্তি (লাঠি) প্রয়োগ কমিয়ে ফেলতে হওয়ায় সে পুরষ্কার নামক গাজরের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা রকম পুরষ্কারের জন্য যে রাতদিন অ্যাথলিট থেকে আর্টিস্ট যে রাতদিন নেচে-কুঁদে জিম ঠেঙ্গিয়ে বেড়াচ্ছে, তার মধ্যে বাহ্যিক বলের আর নিউটনের প্রথম সূত্রের ছায়া দেখতে না পেলে একবার চোখের ডাক্তারের চেম্বার ঘুরে আসুন।

দ্বিতীয় সুত্রের বক্তব্য, কোন বস্তুর ওপর প্রয়োগ করা বলের দিক আর জোর নির্ধারণ করে সেটি কোন দিকে কত জোরে যাবে (মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বাংলার বাগধারা ‘যত গুড়, তত  মিষ্টি’ থেকে নিউটন সাহেব ১৬৮৭ সালে  আইডিয়াটা চুরি করেন নি তো?)। এ সূত্রটি ব্যক্তিজীবনে, দেশে, সমাজে, ফুটবলে, ক্রিকেটে, দুর্গাপুজোয় অথবা বডিবিল্ডিং-এ কী ভয়ানক রকম প্রযোজ্য আপনারাই ভেবে দেখুন।

তৃতীয় সুত্র হ’ল, যে কোন ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

মিল অঙ্কের মত না হলেও সাদা বাংলায় এই সূত্রটি দাঁড়ায়- ঢিল ছুঁড়লে পাটকেলটি খেতে হবে। তবে পাটকেলের সাইজ যে ঢিলের সমানই হতে হবে, জৈবপ্রকৃতি তা মানতে নারাজ। প্রতিক্রিয়া কী বেহিসেবী হতে পারে দেখুন- মনস্তত্ববিদ ধীরেন্দ্রনাথ সান্যাল তাঁর বইয়ে লিখেছেন- একটি বাচ্চার মা তাঁকে বলেন বাচ্চাকে দুধ খেতে বললে খায় না কিন্তু, তিনি বাড়িতে না থাকলে চুরি করে খায়। বেশী বললে প্রতিক্রিয়া হ’ল, করার ইচ্ছে চলে যাওয়া শুধু নয়, ‘করবো না’র ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরা।

জীবনের নানা ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ না দেখে উপায় নেই। শুধু পাটিগণিত নয় বলে হিসেবটা অত সোজাসুজি নয়। বিশ্বাস না হলে রাস্তায় শান্তিতে শুয়ে থাকা কোন কুকুরকে একটি লাথি কষিয়ে অথবা জাবর কাটতে থাকা কোন গোমাতা’র লেজে মোচড় দিয়ে দেখতে পারেন।

লেঞ্জ-এর সুত্র

পদার্থবিদ্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ লেঞ্জ-এর সুত্র বলে, যে কারণে একটি আবিষ্ট তড়িচ্চালক বল (Induced electromotive force) সৃষ্টি হবার পর থেকে যে কারণে তার সৃষ্টি সেই কারণটিকেই বাধা দিতে থাকে। অর্থাৎ-

যার জন্য জীবন পেলে                                                                                                         তাকেই যে দাও খাদে ঠেলে।

এই বৈপরীত্য (কেউ বলতে পারেন, বস্তুগুলো স্কুলে যায় নি, তাই নীতিবোধের অভাব) পদার্থবিজ্ঞানী লেঞ্জ প্রথম লক্ষ্য করে সুত্র বানিয়ে ফেললেও মনে হয় সমাজবিজ্ঞানীদের ব্যাপারটা আগে  নজরে আসা উচিৎ ছিল।

যেমন ধরুন, বাড়ি কিনতে গেলে বন্ধু বলবেন এমন জায়গায় যাবে যেখানে লোকজন আছে। প্রথমে মনে হবে উনি একটু মেলামেশা’র পক্ষপাতী। কিন্তু তিনি-ই গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেয়ে বেরোবার মুখে যদি বলেন, পাঁচিলটা দেখছি নীচু, গেটটাও সহজেই বাইরে থেকে খোলা যায়-হুট হাট পাড়াপড়শি ঢুকে পড়বে যে! স্তম্ভিত হবেন না। বুঝবেন লেঞ্জের সুত্র কাজ করছে।

অথবা, কেন ঐ বাইকটি সকলের কেনা উচিৎ তা নিয়ে অনেক কচকচির পর আপনার ছেলেটিকে একটি সৌখীন যন্ত্র কিনে দেবার পর যখন দেখবেন সে চায় না আশপাশে আর কেউ সেই বাইক কিনুক তখন লেঞ্জকে মনে করবেন।

দেশ-বিদেশের রাজনীতিকদের দেখুন। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবার পর তাদের অবধারিতভাবে মনে হতে থাকে, ‘ভোটের আর দরকার কি?’ অথবা চিন্তা হতে থাকে ‘গণতন্ত্র একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে না তো?’

ধর্মের ব্যাপারে এ ব্যাপারটা আরও প্রকট। আফগানিস্তানে কম্যুনিস্ট আর গণতন্ত্রীরা ধর্মপালনের স্বাভাবিক অধিকার ব্যাহত করছিল, তাই লড়াই করে তাদের তাড়ানো হ’ল। এখন সেখানে মেয়েদের পড়াশোনা করার গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বললে কোতল হওয়ার সম্ভাবনা। যারা অন্যত্র অন্ততঃ নিজেদের মত খাওয়া-দাওয়ার ন্যূনতম অধিকার চেয়ে পাড়া মাত করেন তারাই ক্ষমতা পেলে অন্যদের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন।

নজর করলে পিঁপড়ে, কুকুর, পাখীদের মধ্যেও লেঞ্জের সুত্রের প্রভাব দেখতে পাবেন। মানুষের বসতিতে একদল বেওয়ারিশ কুকুর খাওয়া-দাওয়ার সুবিধের জন্য গেড়ে বসতে পারলেই নতুন কুকুরদের সেখানে ঢুকতে বাধা দেওয়ার জন্য বেশ হিংস্র প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এই এক-ই নিয়মে একদা ইউরোপবাসী জনগণ দুটো তিনটে মহাদেশ দখল করে সেখানকার আদিবাসীদের নিকেশ করে বসার পর অন্যদের ভিসা দিতে চায় না।

১৮৩১ সালে নোবেল প্রাইজ চালু হবার ৭০ বছর আগে প্রায় সর্বত্র প্রযোজ্য এই সূত্রটি আবিষ্কার করার জন্য লেঞ্জ সাহেব নোবেল প্রাইজ পান নি। তাঁর প্রয়াণ ঘটে ১৮৬৫ সালে, আর নোবেল (শুরু হয়েছিল ১৯০১ সালে) পেতে গেলে জীবিত থাকা  প্রয়োজন। এই কারণে ১৭২৭ সালে প্রয়াত নিউটন-ও পুরষ্কারটি পান নি। ওঁদের কথা উঠলে হয়তো পদার্থ আর মনোবিদ্যা মিলিয়ে কিছু দিতে হ’ত।

-অরিজিৎ চৌধুরী

https://data.worldbank.org/indicator/SP.POP.GROW?locations=BD

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ২

One thought on “পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *