পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ১ by Arijit Chaudhury

পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ১

সবাই জানে আর মানে বিজ্ঞান একটা কাজের জিনিষ। কিন্তু, সে হল বস্তু জগতে, সমাজবিজ্ঞান ঐ রকম নাম নিয়েও ঠিক বিজ্ঞান নয়, আর্টস-এ পড়ানো হয়। তবুও বিজ্ঞান মাঝে মাঝে-ই ‘এখানে এসো না’-র বেড়া টপকে মানুষের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ব্যবহারের ব্যাখ্যা করে বসে।  একটু তলিয়ে দেখি-

স্ট্রেস-স্ট্রেন কার্ভ, একটি বস্তুর (ধরা যাক একটি লোহার তার) ওপর ক্রমাগত শক্তি প্রয়োগ করতে করতে সেটি ভেঙ্গে যাওয়া পর্যন্ত তার ব্যবহার ও গতি-প্রকৃতি দেখায়। সংক্ষেপে বললে, প্রথম পর্যায়টি ইলাস্টিক ডিফরমেশন- অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ করলে বস্তুটি যেন তার আকার বদলানোর বিরুদ্ধতায় নামে, আর থামলেই আগে যেমন ছিল সে অবস্থায় ফিরে যায় (সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি)। জোর আরও বাড়ালে প্রতিরোধের দেওয়াল নরম হতে থাকে, অর্থাৎ আমাদের এক মিটারের তারটি টানাটানিতে দেড় মিটার হবার পর সেখানেই আটকে যায় (প্লাস্টিক ডিফরমেশন)। জোর আরও বাড়ালে তারটি ছিঁড়ে যায়।

১৯৩৯ সালে হিটলার জার্মানদের বিশ্বাস করিয়েছিলেন যে ইহুদিদের নিকেশ করলে মহা সুবিধে হবে। জার্মানরা তা শুরু করে শোনা যায় প্রায় ষাট কোটি ইহুদিকে মেরেও ফেলেছিল। ১৯৭১-এ বাংলাদেশে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানী ফৌজ-ও এরকম একটি চেষ্টা চালায়, সেখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, হিটলারের  অত্যাচারের পর ইহুদিরা নিকেশ তো হয়-ই নি, বরং জোরদার হয়েছে। তাদের আলাদা দেশ গড়ে তুলেছে, যা বিজ্ঞানচর্চা, গুপ্তচরবৃত্তি আর চাষআবাদে সারা দুনিয়ার ঈর্ষার পাত্র। বাংলাদেশ, যা হতদরিদ্র অবস্থায় পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছিল, তা এখন সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানের থেকে তো বটেই ভারতের থেকেও এগিয়ে। কিন্তু, সব জায়গায় এরকম হয় নি, পুরো আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আর নিউজিল্যান্ড ইউরোপের মানুষ দখল করে নিয়েছে, সেখানকার আদি বাসিন্দারা সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে দিন কাটাচ্ছে। কেন এমন হয় ভাবনা নিয়ে আলসেমিতে গড়াতে গড়াতে স্কুলে পড়া স্ট্রেস-স্ট্রেন কার্ভ মনে উজিয়ে এল। সেটার লেবেল একটু পাল্টে নিলেই ব্যাপারটা বেশ সরল বোধ হ’ল।

পাশের ছবিটি দেখুন। ক-খ হ’ল প্রতিরোধের জায়গা। অত্যাচার যত বাড়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে জনগোষ্ঠীর লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা। খ-গ অংশে অত্যাচার আর একটু বাড়ে, প্রতিরোধ নরম হয়ে পড়তে থাকে, মানুষ ভরসা হারায় আর গ তে পৌঁছে গেলে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। আর উঠতে পারে না।

এই কার্ভটার প্রয়োগ ব্যক্তিগত জীবনেও করা যায়। একটু হালকা কথায় যাই। কোন বাচ্চা স্কুলে জন্মাবার পর থেকে নানা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে পড়তে ক-খ বেয়ে উঠতে থাকে। যদি তার ইচ্ছে (attitude) আর নিহিত নৈপুণ্য (aptitude) মিলে যায়, তার ক-খ’র যাত্রা অফুরান চলতে থাকে। কিন্তু, যে কোন কারণে যদি সে ইচ্ছে আর নিহিত নৈপুণ্যের তাল-মিলের তোয়াক্কা না করে অন্য দিকে যেতে চায় বা তাকে যেতে বাধ্য করা হয়, তার প্রতিরোধ ভাঙতে থাকে, কুশলতা স্থবির হয়ে সে অতি সাধারণ মানুষে পরিণত হয়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লেখেন-

“আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে,

অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত;

যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,

 উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।”

সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে, তৈরি হয় উদ্ভাবনী চিন্তাহীন, দিশাহীন অনেক মানুষ (খ-গ)। তাতেও চলে যায় কিন্তু, গ-এ পৌঁছে গেলে স্ব-বিনাশ (আত্মহত্যা)-ও অসম্ভব নয়।

আর একটা ব্যাপার আছে জ্যান্ত মানুষ নিষ্প্রাণ তার নয় বলেই সে চাপ কমে গেলে প্লাস্টিক ডিফরমেশন-এর  শেষে প্রায় ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্ত থেকে ইলাস্টিক ডিফরমেশন-এ ফিরে আসতে পারে। সে রকম ব্যতিক্রমী মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখা হয়, সিনেমাও হয়। স্ট্রেস-স্ট্রেন কার্ভের দার্শনিক ব্যাপারটা হ’ল- চাপ দরকার, তাতে ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু, বেশী চাপ দিলে ফল উল্টো হতে পারে। মানুষ মেরুদণ্ডহীন, কল্পনাবিহীন এমন মেশিনে পরিণত হতে পারে যাকে দেখে মনে হয়, “হায় রে বিধাতার অপব্যয়”। বেশী জল দিয়ে গাছ মেরে ফেলার মত ব্যাপার।

আবার ওপরের ছবিটায় ফিরি- হিটলার আর ইয়াহিয়া ইহুদি আর বাংলাদেশীদের ঠিক গ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন নি। বাইরের সহায়তা পেয়ে তারা সড়াৎ করে আবার ইলাস্টিক ডিফরমেশন-এ ফিরে এসে শক্তি সঞ্চয় করে ফেলে।

দ্বিতীয় প্যারায় লেখা আমেরিকা, আস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ছাড়া আফ্রিকার কিছু কিছু দেশ মনে হয় গ-এর গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে, আজকের পাকিস্তান, পূর্ব ইউরোপের পূর্বতন সমাজবাদী দেশগুলো আর মেক্সিকো সহ দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশ যেখানে আইন শুধু মাফিয়া আর বড়লোকদের আওতায় তারা খ-গ’তে বিরাজমান। প্রায়ই প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী অথচ বাস্তবে দরিদ্র এই দেশগুলোর মানুষ পরিবারের রোজকার প্রয়োজন আর শ্ত্রু বানিয়ে তোলা স্বদেশবাসীকে মেরে ফেলার অস্ত্রের জন্য সারা বছর অন্যের দুয়ারে হাত পেতে থাকে। এখনকার উক্রেন, শ্রীলঙ্কা, ভারত আর বাংলাদেশ কোথায় আপনারাই ঠিক করুন।

এবার হিটলার ও ইয়াহিয়ার উপদেশ- বাবা পুতিন, উক্রেন-কে গ থেকে ঠেলে ফেলতে পারবে এমন ভরসা কম, সে চেষ্টা ত্যাগ কর। তোমার এই ভেঞ্চার উক্রেন-কে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।‘ আর অভিভাবকদের প্রতি আমার আবেদন-বাচ্চাদের ওপর চাপ ক-খ’র অঙ্গনে সীমায়িত থাকতে দিলে ওদের ক্ষমতার সহজ বিকাশ আপনাদের অবাক করবে।

আমার এক বন্ধু বলেছিল, সাহেবরা যা পড়তে ইচ্ছে সেটা নিয়ে পড়াশোনা করে, আমরা যা পড়া উচিৎ, সেটা পড়ি। তাই ওদের উদ্ভাবন আর নোবেল পুরস্কারের সংখ্যার কাছাকাছি আমরা চেষ্টা করেও পৌঁছতে পারছি না।                                                                                                                                                           -অরিজিৎ চৌধুরী

 

তথ্যসূত্রঃ

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’র শ্রেষ্ঠ কবিতা- দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

https://www.britannica.com/event/Holocaust

https://data.worldbank.org/indicator/SP.POP.GROW?locations=BD

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

পদার্থবিদ্যাঃ সমাজে আর মননে- ১ by Arijit Chaudhury

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *