মহিলা দিবসের পর-১ – Arijit Kathanchit

মহিলা দিবসের পর-১

প্রতি বছরের মত এবারও যথাসাধ্য আড়ম্বরের সাথে মহিলা দিবস উদযাপিত হ’ল। ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে বস্ত্র কারখানায় মহিলা মজুররা পুরুষদের তুলনায় কম মাইনে ও শারীরিক অত্যাচারের (এখন এর নাম #মি টু) বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছিলেন তার স্মরণেই এই দিবস পালন। তখন মেয়েরা যে কারণে বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিলেন তার অনেকটাই এখনও বিদ্যমান। সমাধানের জন্য একদল দাবী করেন সমানাধিকার, আর একদল বলেন উন্নয়ন আর কাজের সুযোগ বাড়লেই সমস্যা মিটবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ, তথ্য এ দুটি ধারণার কোনটিকেই সমর্থন করে না।

মহিলাদের সম্মান করার দিনটি কবিতা, গান, পুরস্কার ও প্রশংসায় এমন ছয়লাপ হয়ে থাকে যে স্বাভাবিক যুক্তি’র কথা বলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই বিলম্বিত বকবকানি তাই মহিলা দিবস বাদ দিয়ে বছরের বাকি দিনগুলির জন্য- এমনটি ধরে নিন।

সার কথা হ’ল, মেয়েদের সাহিত্যে আর আবেগে জায়গা দিলেও আসল কিছু জায়গায় তাদের ওপরে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। যেমন ধরুন, কোন বড় ধর্মের উচ্চাসনে মেয়েরা নেই, সবরিমালার মত মন্দিরে, দরগায় এমন কি ভারতের বেশির ভাগ মসজিদে মেয়েরা ঢুকতে পারে না। আদমের হাড় থেকে ঈভ-এর জন্ম হওয়ায় খ্রিস্টধর্মেও তাদের অবস্থা ভাল নয়, এখনও অনেক চার্চের মধ্যে তাদের কথা বলা বা মাথা না ঢেকে রাখা ভাল চোখে দেখা হয় না । ধর্ম পুরনো ব্যাপার। মহিলা পোপ, পুরোহিত বা মৌলভী ক’জন দেখতে পাওয়া যায়? বুদ্ধ স্ত্রী-পুরুষের তফাৎ না করলেও তাঁর পরবর্তীকালে মেয়েদের ওপর নানা বিভেদপন্থার বোঝা চাপানো হয়। এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ১৪ জন দালাই লামা’র পদ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন-ও মহিলা নন।

ধর্মের কথা তবু বোঝা যায়। তাদের জন্ম প্রাচীনতায়, পুরনো ভাবনার ঘোর কাটাতে তাদের একটু বেশি সময় দরকার হতেই পারে। কিন্তু, আধুনিক দুনিয়ায় যাদের উৎপত্তি- সেই গণতন্ত্র আর সমাজবাদের চত্বরে মেয়েদের অবস্থা কেমন তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। সবাই জানেন, মেয়েরা জনসংখ্যার আধাআধি। উন্নত দেশগুলিতে তাদের প্রতি কোন পুষ্টি, শিক্ষা, পেশা বা আইনগত বৈষম্য না থাকায় জীবনের সব ক্ষেত্রেই তারা পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে এরকম ভাবা স্বাভাবিক।

আধুনিক দুনিয়ার তথ্য বলছে,যতই পড়াশোনা করুন না কেন, পেশার ক্ষেত্রে মেয়েরা সিদ্ধান্ত নেবার মত উঁচু পদে যদি উঠতে পারেন – তা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম। মেয়েদের ক্ষমতায় একটু নীচু ভাবা শুধু ছেলেদের নয়, তাদের নিজেদের মনেও বাসা বেঁধে আছে। আমেরিকার উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সহ-অধ্যাপিকা লরেন বারগেনহেইয়ার লিখছেন, ‘জরুরি কথাটা বুঝি যে, সমাজে থাকতে থাকতেই আমার মনে লিঙ্গ বৈষম্যের অভ্যাস ঢুকে গেছে…আমি নিজেও হয়তো মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের কাজকে বেশী মূল্য দিই…একজন অধ্যাপক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের রেকমেন্ডেশনের চিঠি দিই এবং এটা বেশ স্পষ্ট যে একই রকম মেধা ও ক্ষমতার  ছেলেরা মেয়েদের থেকে অনেক ভাল চিঠি  পায়…’।

মন খুলে দেখলেই বোঝা যায়, সামাজিক ও প্রাকৃতিক নানা অসুবিধের মধ্যেও মেয়েরা তাদের নিষ্ঠা ও ক্ষমতার জোরে সমাজে, বিদ্বৎমণ্ডলীতে এবং রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। মারী কুরি, হেলেন কেলার, আগাথা ক্রিস্টি, গোল্ডা মেয়ার, ইন্দিরা গান্ধী, মারগারেট থ্যাচার, অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অনেকের মধ্যে সামান্য কটি উদাহরণ মাত্র। মারী কুরি-ই একমাত্র মানুষ যিনি বিজ্ঞানের দুটি শাখায় (রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

 

 

বহুজাতিক কনসালটেন্সি সংস্থা ডেলয়েট প্রতি বছর কোম্পানিগুলির উঁচু পদে মেয়েদের উপস্থিতি নিয়ে যে সমীক্ষা চালায় তাতে ৫১টি দেশের ১০৪৯৩টি কোম্পানি’র তথ্যভিত্তিক ২০২১ সালের মার্চ মাসের পরিস্থিতি নীচের টেবিল-এ।

বোর্ড সদস্য (%) চেয়ারপার্সন (%)
 বিশ্ব ১৯.৭ ৬.৭
এশিয়া ১১.৭ ৫.৪
আফ্রিকা ৩০.৫ ১৬.৩
ইউরোপ ৩০.৭ ১০
উত্তর আমেরিকা ২৪.৩ ৬.১
ভারত ১৭.১ ৩.৬
চীন ১৩.১ ১০.৩
জাপান ৮.২ ০.৩
দক্ষিণ কোরিয়া ৪.২ ২.৩
সৌদি আরব ১.৭ ১.৩
সংযুক্ত আমিরশাহী ৫.৩ ০.০
পাকিস্তান ৮.৭ ০.০

সাধারণতঃ দারিদ্র্য আর উন্নয়নের অভাবকেই প্রকট লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এই ধারণাও ধোপে টেঁকে না। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, ধনী আরব জাতিগুলি যতটা বৈষম্যপ্রবণ, আফ্রিকার অন্য গরীব দেশগুলি, বিশেষতঃ সাহারা মরুভূমির নীচে যে দেশগুলি আছে,তারা অতটা নয় বরং বেশ সমভাবাপন্ন, আর ধনী আরব আমিরশাহী-র সাথে গরীব পাকিস্তানের এ ব্যাপারে একান্ত সমভাব। শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে গণতান্ত্রিক দক্ষিণ কোরিয়া আধুনিক বিশ্বে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আর সমাজতন্ত্র, যার প্রধান নীতিকথা বৈষম্য দূরীকরণ, তার উদাহরণ চীন। এই দুটি দেশের সংস্থাগুলির উচ্চাসনে মেয়েদের অনুপাত ওপরের টেবিলে দেখুন আর একটু অবাক হোন, কারণ এসব যখন ঘটছে তখন দেখা যাচ্ছে যে সব বোর্ডে মেয়েদের উপস্থিতি বেশি সে সব কোম্পানীগুলি নজরে পড়ার মত ভাল করছে।

গত বছর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপনের সময় পঁচিশ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন মহিলা। আর তারও ওপরে সাত সদস্যের পলিটব্যুরো মহিলাশূন্য। ওদিকে আমেরিকার তেল খোঁজা ভূবিজ্ঞানীদের সংস্থা আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ পেট্রোলিয়াম জিওলজিস্ট (এএপিজি) লিখছে কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মহিলা ভূবিজ্ঞানীদের তেল খোঁজার কাজে যোগ দিতে যে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল, যুদ্ধ শেষ হতেই তা কেমন উবে যায়। দায়িত্বপালনে বেশ সফল এই বিজ্ঞানীদের ঘরে ফেরানোর একটি প্রধান অজুহাত ছিল বিয়ে। তাতে কাজ না হলে সন্তানের জন্মের পর তাঁদের ফেরানো হত। সেই সময়ের কেরিয়ার মনস্ক কিছু মহিলা বিজ্ঞানী বিয়ে করেন নি।

অসাম্য দূর করতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে মেনে নেওয়া ভাল যে মানবসমাজ ভয়ানক নীতিবাদী কিছু নয়, তারা কষ্টে-সৃষ্টে নীতি বোঝে বটে,কিন্তু অন্য জন্তু-জানোয়ারদের মতই সহজে বোঝে নিজেদের সুবিধাটা। তাই, ‘মেয়েদের বাড়তে না দিলে আমাদের কোন ক্ষতিটা হচ্ছে ভাই?’ পুরুষালি এই প্রশ্নটা না এড়িয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পরের পর্যায়ে সেই কর্মটি করার ইচ্ছে রইল।

অরিজিৎ চৌধুরী

https://data.worldbank.org/indicator/SP.POP.GROW?locations=BD

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

মহিলা দিবসের পর-১ – Arijit Kathanchit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *