Kishkindhya by : Dipankar Chowdhury

(A Sci-fi story, in 2 parts. Original in Bangla by Dipankar Chowdhury, English translation by Amitabh Moitro)
(Part 1)

 

Bangali Version

বিজুদা-র গল্প।  অদ্ভুতুড়ে গল্প!

 

।। কিষ্কিন্ধ্যা ।।

।।১।।

‘এ’গল্প যখনকার তখন আমি সবে হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরব ধরব করছি’

চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বিজুদার ঘোষণা।

আজকের গল্পের আসরে।

ঘোষণা মোতাবেক আজ বিজুদার গল্পের আসর বসেছে অনেকদিন পরে । কারণ, সকল সদস্যের দাবি— বহুকাল আসেননি বিজুদা, বসেনি গল্পের আসর। অতএব আজ  সন্ধ্যায় বসিল বিজুদার গল্পের বিশেষ অধিবেশন।   নৈশাহারে রয়েছে বিজুদার অতি প্রিয় ধোঁকার ডালনা! তা, সে-সব ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখা রয়েছে, কারণ কচিকাঁচাদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও বসে গেছেন যে বিজুদার গল্প শুনতে।

‘কিন্তু বাপু হে, গপ্প কি আর তোমার ঐ বোতাম-টেপা মেশিন, যে সুইচটি অন করবে, আর হুড় হুড় করে বেরোতে থাকবে তা?’

বিজুদার সবিনয় নিবেদন -টির মধ্যেও যেন একটু উস্কানির গন্ধ!

অধ্যাপক শ্যামল বাবাজী পিছনে লাগতে ছাড়েন না, বলেন, ‘আপনি বাইনে বাইনে-ই বলুন না। ভালোই তো বলেন….’

‘…বানিয়ে বানিয়ে’, বিজুদার সহাস্য যোগ, ‘আর আপনেরাও ছোটদের আষাঢ়ে গল্পের আসরে…..’

‘জমিয়ে বসি’। আমার সুগৃহিনী সুমিত্রাদেবীর সংযোজন।

‘জেঠু, তুমি বলো না গল্পটা। শুরু কর না। থামলে কেন?’—একযোগে দাবি  অয়ন-রূপা-গুগ্ গুলদের।

*

—হ্যাঁ, তাহলে বলি শোনো, গল্প!

—ভূতের গল্প?  অয়নের প্রশ্ন।

—ভূত? উঁ উঁ উঁ উঁ—-না, ধরে নাও রাক্ষসের গল্প।

—রাক্ষসের গল্প!

—রাক্ষস বলে আবার কিছু হয় নাকি?

—নাও! হওয়া-হওয়ির আবার আছেটা কী গো? রাক্ষস ইজ রাক্ষস!’  বিজুদা।

—আদি কাল থেকে দক্ষিণভারতে পাশাপাশি দুই প্রজাতি বাস করতো, রামায়ণে যাদের বানর আর রাক্ষস  বলা হয়েছে, জানো তো? বন্ধুবর সুদীপের সংযোজন, ‘চমৎকার একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখলাম সেদিন এর উপরে।’

—ঐ শোন তাহলে।  বিজুদা খুশি।

—আরে বাপু সুদীপ, রাক্ষসরা বিলেতেও থাকতো, এটা জানিস?  অধ্যাপক শ্যামলকুমার জানালেন।

—বলিস কী! সুসভ্য বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে রাক্কসরা থাকত?  অবাক হই।

—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর। তারাই সে দ্বীপের আদি নিবাসী।   সাহেবদের ইতিহাসে লিখেছে, সৌন্দর্যের গ্রীক-দেবী এফ্রোডিটির  পুত্র ইনিয়াস ট্রয়ের যুদ্ধে হেরে দেশ ছেড়ে পালায় ও তারই বংশধর ‘ব্রুটে অব্ ট্রয়’  ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে সে দেশের আদি অধিবাসী রাক্ষসদের হারিয়ে রাজা হয়ে বসে। তিনিই সে দেশের প্রথম নৃপতি।  তাঁর থেকেই বৃটেন  নামটা এয়েচে।

—ভাবো!

ঐসব ইতিহাস-আর মিথোলজী থাক্। শোনো তবে আজকের গপ্প।

বিজুদা আজকের গল্প শুরু করেন।

*

ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমি।

আমার রাঙামামা পেশায় ছিলেন এক সিভিল এঞ্জিনিয়র। অকৃতদার মানুষ ছিলেন প্রমথনাথ  ব্রহ্ম।    সেবার  কোনো ছুটিতে এসেছিলেন  কলকাতায়।  উনি চাকরি করতেন হুবলি-তে।

—হুগলী জেলা?

—আজ্ঞে না স্যর। হুবলি হলো কর্ণাটকের একটা বড় শহর, গোয়া থেকে প্রায় ডেড়শ কিলোমিটার সোজা পুবে। জেনে পুলকিত হলাম যে উনি কিছুদিন আগেই ‘তুঙ্গভদ্রা বাঁধ প্রকল্পে’ বদলি হয়ে এসেছেন।

তুঙ্গভদ্রা! সদ্য শরদিন্দুর ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়ে আছি। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি শহর ছিল তার নিকটেই। শুনলাম।

বিজয়নগর! মহা পরাক্রমশালী নৃপতি কৃষ্ণদেব রায়! আমার রোমাঞ্চ হলো।

জায়গাটা  এখন পড়ে কর্ণাটক রাজ্যে, শহরের নাম হসপেট , যেখানে রাঙামামা থাকেন ।

অতএব মন চনমন করে উঠল সে স্বপ্নসাম্রাজ্য দেখবার জন্যে। কিন্তু অতদূরে কি আর বেড়াতে যাওয়া হবে?  এর আগে অতদূরে কোথাও যাইনি । কলকাতা থেকে বোম্বাই প্রায় দু হাজার কিমি দূরত্ব, সেখান থেকে গোয়া  ছ’শো, গোয়া টু হসপেট তিনশ’ কিলোমিটার। তাহলেই বোঝো, টোটাল প্রা-য় তিন হাজার কিলোমিটারের ধাক্কা। চারটে দিন-রাত্তিরের ট্রেন জার্নি, দুইবার বদলে, তিনটি ট্রেনে। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তখনও এয়ার ট্রাভেল মধ্যবিত্তের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল, ট্রেন জার্নিও তথৈবচ।

‘চলুন দাদা, দেখে আসুন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কীর্তি!’ বাবাকে বলেন রাঙামামা।

বাবারও হাম্পি দেখার খুব উৎসাহ। কিন্তু অফিসে অত লম্বা ছুটি পাওয়া মুশকিল। উপরন্তু হুট্ করে অত দীর্ঘ  ট্রাভেল-প্ল্যান বানানোও সোজা কথা নয়।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো এবার পুজোর ছুটিতে আমরা যাবো।

**

বাবা-মা-আমি আর আমার ছোট বোন মিনি।  দুই প্লাস এক—তিন দিন-রাত্রি ধরে  হাওড়া-বোম্বাই-গোয়া জার্নি করার পর গোয়া থেকে বেজওয়াড়া-গামী এক ঢিকঢিকে এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়া গেল। ততদিনে ত্রাহি ত্রাহি করছে মনটা। আর কাজ নেই বাপু ট্রেনে চড়ে। কখন পৌঁছব? কখন পৌঁছব?

**

গোয়া-টু-হসপেটের ট্রেনে সকালের দিকে আমরা বার্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে বসে আছি। অক্টোবর মাসের শেষ। কিন্তু এখানে গরম খুব, বিশেষত দিনের বেলাটায়। কামরাতে লোকজন কম।  হঠাৎ কোত্থেকে একটা বাচ্চা ছেলে দুষ্টুমি করে এসে মিনির চুলটা ধরে টানতে লাগল।  মিনিরই বয়সী হবে বা তার থেকে কিছু ছোট—বছর সাত-আটের ধবধবে ফর্সা একটা বালক। নেড়া মাথা। লক্ষ্যণীয়, পরনের জামাটার তলা দিয়ে লম্বা পৈতেটা  ঝুলে আছে!

মিনি বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় তার হাতটা সরিয়ে দিতেই দৌড়ে পালিয়ে গেল সে পাশের কোনো বার্থে।

একটু পরেই সে ফিরে এলো, সঙ্গে যমজ ভাই তার। হুবহু এক দেখতে, সেই একই রকম নেড়া মাথা ও জামার তলা দিয়ে পৈতে ঝুলে আছে।

বেশ মজা পেয়ে গেছে তারা একটা বাচ্চা মেয়ের পিছনে লাগতে। দুজনে এসে টুক টুক করে মিনির চুল ধরে  টানতে লাগল।

‘ওয়ট ইজ ইওর নেম?’ বাবা শুধোন।

ইংরিজি বোঝে না বোধহয়। ভোঁ করে আবার পালিয়ে গেল ছেলে দুটো।

‘সনৎ, সনৎ…..৳#%@’ বলে বিজাতীয় ভাষায় পাশের বার্থ থেকে এক বাজখাঁই গলা ভেসে এলো।  ওদের বাবা বোধহয় মানা করছেন ছেলেদের দুষ্টুমি করতে, কাছে ডাকছেন।

এর পরে আমাদের মস্ত অবাক হওয়ার পালা।

আমি একটা অরণ্যদেবের কমিকস পড়ছিলাম জানলার ধারে বসে, হঠাৎ চমকে তাকিয়ে দেখি একটা নয় দুটো নয়, চার চারটে হুবহু এক দেখতে বালক এবার একসঙ্গে এসেছে দুষ্টুমি করতে!

দুইজন যমজ ভাই/বোন দেখা যায়। তিনজন, মানে, ট্রিপলেট—শুনেছি তা-ও হয়। চারজন, মানে জোড়া-যমজ ভাই যে মানুষের হতে পারে তা-ই কখনও শুনিনি, দেখা তো দূরের কথা—তার আগে বা পরে। পরে ডিকশনারি দেখে জেনেছিলাম যে ইংরিজিতে একে ‘কোয়াড্রুপলেট’ বলে।

 

 

এবার আমরা সপরিবার অবাক বিস্ময়ে সেই জোড়া-যমজ, মানে চার চারটে হুবহু এক দেখতে বালককে দেখতে লাগলাম। চার ফুটের চেয়ে কমই হবে উচ্চতা। পরনে প্যান্ট বা পাজামা নয়, ধুতি। গায়ে একটা পাতলা হাফ হাতা কামিজ যার তলা থেকে লম্বা পৈতে ঝুলে আছে! চকচকে নেড়া মাথা চারজনেরই!গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।

কথা কী আর বলব, অবাক বিস্ময়ে তাদের দেখছি আমরা! ট্রেন ফাঁকাই ছিল। ঠিক আশেপাশে আর কোন যাত্রী নেই।

 

‘#৳#@%ঁ&’—বাজখাঁই গলায় বিজাতীয় ভাষায় ধমকাতে ধমকাতে এবার সেই বালকদের ‘বাবা’ ভদ্রলোক উঠে এলেন।  তাঁর অবয়ব দেখে বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম আমরা!

সাড়ে ছয় ফিটের চেয়েও লম্বা আর তেমনি হৃষ্টপুষ্ট বিশাল বপু এক মানুষ!আবলুশ কাঠের মতো গায়ের রং। সাদা বুশ শার্ট আর নীলচে রঙের ঢোলা ট্রাউজার্স পরনে।

আলাপ হলো, চমৎকার মানুষ এই মিঃ কর্ণা! অতি অমায়িক। বাচ্চাদের দুরন্তপনার জন্যে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। আমরা সুদূর কলকাতা থেকে আসছি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।  কিন্তু ওঁর দক্ষিণী ইংরিজি ভাষা বোঝে কার সাধ্যি! যদিও  তারই মধ্যে আলাপচারিতা চলতে থাকল। দীর্ঘ রেল ভ্রমণে সময় কাটানোর আর কীই বা উপায় আছে?’

জানা গেল যে এই বালক চারিটি ওঁর নিজের সন্তান নয়, উনি ওদের ‘অভিভাবক’, কোনো এক আশ্রমে তাদের ছেড়ে আসতে চলেছেন। চমৎকার মাউথ-অর্গান বাজিয়ে শোনালেন আমাদের। একটু পরে লাঞ্চের থালি দিয়ে গেলে উনি নিজেই চারটে খেলেন, ছেলেদের চারটে আলাদা। ওঁর অবয়বের সঙ্গে মানানসই বটে।

আর তার পরেই পাশের বার্থে উঠে প্রচণ্ড নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন , আর ছেলে চারটজন  নিজেদের মধ্যে ‘ইকড়ি মিকড়ি’-জাতীয়  অবোধ্য কোনো ছড়া বলতে বলতে খেলা করতে লাগল।

**

বিকেলের দিকে ট্রেন পৌঁছনোর কথা হসপেট। লেট করছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। হঠাৎ ‘সনৎ….সনৎ’ করে ডাকতে ডাকতে সেই বিশালবপু কর্ণা-বাবাজী ঘুম থেকে উঠে মহা হট্টগোল বাধিয়ে তুললেন। কম্পার্টমেন্টের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে গিয়ে শুধোচ্ছেন ছোট ছেলেটাকে কেউ দেখেছে কিনা।

কী কাণ্ড?!

না, সেই চারটির একটি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তিনজন রয়েছে, যারা বেচারি খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে নিচের বার্থে পরস্পর জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।চতুর্থ ছেলেটি নেই, যার নাম সনৎ।

ট্রেন হসপেট স্টেশনে ঢুকছে।

কোথায় গেল ছেলেটি?

সে ট্রেন তো আর ভেস্টিবিউল ছিল না সেকালে, মানে এক কামরার মধ্যে দিয়ে পাশের কামরায় চলে যাওয়া যেতো না।

তবে গেল কোথায় বাচ্চাটা? কী করে?

**

রাঙামামা এসেছিলেন স্টেশনে আমাদের রিসিভ করতে। খুব আনন্দ হৈ হৈ হতে লাগল।

তারপর মস্ত এক হ্রদের তীরে ‘তুঙ্গভদ্রা

বাঁধ প্রকল্প’-এর ঘেরা আবাসনের মধ্যে তাঁর কোয়ার্টার্সে গিয়ে ওঠা হলো। ওখানকার কর্মীদের চমৎকার একটা ক্লাব আছে সেখানে, সেটাই সকলের মিলনস্থল। ছোট-বড়-মাঝারিদের জন্য আলাদা আলাদা অলিখিত গ্রুপ রয়েছে। আমি ও আমরাও শীগগরই সেখানে মিশে গেলাম।  সেখানে বাচ্চাদের নাচাগানা  নাটক এইসব হয় টয়, শুনলাম। পরেরদিন দেখলামও একটা ম্যাজিক শো। কয়েকটি বাঙালী পরিবারও রয়েছে। শীগগিরই আমরা হাম্পির ঐতিহাসিক বিরূপাক্ষ মন্দির দেখতে যাব দল বেঁধে, এই ঠিক হলো। এই হসপেট শহরটা থেকে হাম্পি  কাছেই। হাম্পি ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার প্রাসাদ-মন্দির-নগর দেখলে আজও স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।

‘জানো তো বাবা বিজু, মুঘল সাম্রাজ্যেরও দুশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল সারা দাক্ষিণাত্য জুড়ে—তিনশ’ বছর ধরে। ইতালীয়, পর্তুগীজ, পারসীক ও চৈনিক পর্যটকেরা রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন’—ঐ সাইটে ঘুরতে ঘুরতে বাবা বলেছিলেন আমায় ।

কিন্তু আমার মনটা কেন যেন খচ্ খচ্ করছিল  সেই জোড়া-যমজের জন্য—তাদের  একটা ছেলে, সনৎ, কোথায় গেল সে? মা-ও আমাকে ঠিক সেই কথা বলে উঠলেন দু’দিন পরে খেতে দিতে দিতে।

—‘আমার মনটা কেমন কেমন করছে, জানিস’।

আমি তাকালাম মায়ের মুখের দিকে।

মা বললেন, ‘তুই-ও নিশ্চয়ই এটা ভাবছিস?’ আমাকে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে হলো না। চুপ করে রইলাম।

কিন্তু ট্রেনে হঠাৎ সেই বিশালবপু মিঃ কর্ণা, তাঁর সঙ্গী চারটি যমজ বালক, এবং তাদের মধ্যে থেকে একজনের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটা—-কেমন একটা অবাক-করা ঘটনা বলে মনে হতে লাগল।

কোন্ স্টেশনে শেষাবধি গিয়ে নেমেছিলেন ওঁরা?   কে জানে?

***

হসপেটেই এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এইরকম নাম কারোর শুনিনি।

কুশাক্ষ নাথ বালী। কে এন বালী। বেশ হাসিখুশি মানুষটি। দেখে মনেই হয় না যে বেশ কয়েক বছর আগেই রিটায়ার করে গেছেন উনি। বেঁটেখাট গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, অনেকটা কুস্তিগীরদের মতো।

‘আদতে আমরা হলাম পাঞ্জাবী, বুঝলেন। আদি বাড়ি জলন্ধর। কিন্তু এই পম্পা-সাগর তীরে চাকুরি থেকে রিটায়ার করে শেষে আর দেশে ফিরে যাইনি্, এখানেই থেকে গেছি। তার অবিশ্যি অন্য আর একটা বিশেষ কারণও আছে । বলবো এখন একদিন।’ বাবার সঙ্গে প্রথম আলাপে বলেছিলেন বালী-সাহেব, ‘দীর্ঘদিন আমি বঙ্গালে ছিলাম, জানেন তো? কাঁকিনাড়া জুট মিলে ওয়েলফেয়ার অফিসার।’

 

*

উনি আসতেন রাঙামামার সঙ্গে দাবা খেলতে। আমরা আসাতে ওঁর ভালোই হলো, কারণ আমার বাবারও দাবা খেলায় প্রবল উৎসাহ , যদিও ওঁর সঙ্গে পেরে উঠতেন না। পাক্কা দাবাড়ু ছিলেন এই কে এন বালী মশাই।

‘কী মিঃ বিজনবিহারী সরকার? কী করে সময় কাটছে  এখানে এসে? হাম্পি যাচ্ছ তো? সুগ্রীব-গুহা দেখে এসো। রামায়ণ পড়েছ তো বটে?’ দাবার ঘুঁটি সাজাতে সাজাতে একদিন আড়চোখে পাশে বসা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন বালী-জী।

‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর ‘ছোটদের রামায়ণ’ পড়া ছিল। খুব প্রিয়। বললাম।

—যেখানে আজ আমরা বসে আছি এখন, রামায়ণে কী নাম ছিল বলতো এই জায়গাটার?

—বিজয়নগর।

—সে তো মাত্তর আট শ’ বছর আগে। আমি বলছি  আড়াই হাজার বছর আগের কথা। রামায়ণের কালে।

আমরা নিরুত্তর।

সেই রবিবার সকালে প্রাতঃরাশ সেরে রাঙামামার সঙ্গে  বৈঠকখানায় হাজির ছিলাম আমরা সপরিবার চারজনই। দাবা খেলা হবে। দেখব।

—হাম্পি?  উল বুনতে বুনতে মা বললেন।

—হাম্পি শহর ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যেরই রাজধানী যেখানে পরশু ছুটির দিন বেড়াতে যাবেন আপনারা। এখান থেকে মাত্র সাত-আট  মাইল দূরে।  বললেন উনি।

‘রামায়ণের কালে এই স্থানটাই ছিল কিষ্কিন্ধ্যা, বানররাজ্যের রাজধানী!’  বালীজী।

আচ্ছা! নূতন তথ্য। জানতাম না। তার মানে সীতার অন্বেষণে বেরিয়ে এখানেই রাম-লক্ষ্মণ প্রথম সুগ্রীব ও হনুমানের দেখা পান, এবং ঘটনাপ্রবাহ  এগিয়ে যায় সেতুবন্ধনের দিকে। বেশ।

— রাবণের বড় শ্যালক ছিল দুন্দুভি রাক্ষস।  মদমত্ত দুন্দুভি এসে বানররাজ বালীকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে করলে আহ্বান।  মহা শক্তধর বালী তাকে মাথায় তুলে দশটা পাক দিয়ে  বহু যোজন দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে সময়ে তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল ঋষ্যমুক পর্বতে মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে। কী! রাক্ষসের রক্ত ফেলে অপবিত্র করে দিলে আমার আশ্রম? এই পাহাড়ের চৌহুদ্দিতে এলে মাথা ফেটে মরে যাবে তুমি—ঋষিমশাই অভিশাপ দিয়েছিলেন বানররাজকে। সেই থেকে ভয়ে বালী আর এ’মুখো হয় না। দাদার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাই সুগ্রীব-হনুমানাদি এই ঋষ্যমুক পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন।

দেখে আসবে সে-সব, দিদিমণি। ঋষ্যমুখ পাহাড় আজও আছে।

মিনির গাল টিপে বলেছিলেন বালীজী।

‘এ কি সব সত্যি?’ অবাক বিস্ময়ে মিনির প্রশ্ন।

‘মিথ্যে কী করে বলি, দিদিমণি? রামায়ণে লেখা আছে যে ।’.

বেশ লাগছিল বালীজীর মুখে রামায়ণের গল্প শুনতে, বিশেষ করে আমরা যে এখন বসে আছি কিষ্কিন্ধ্যাতেই ।

কিন্ত হঠাৎ ই প্রসঙ্গ  পালটে রাঙামামার দিকে তাকিয়ে বললেন উনি ,

‘একটা খবর জানেন কি ব্রহ্ম-জী?’ শুনলাম, পরশু রাতে পুলিশ আসিয়েছিল আমাদের এই কমপ্লেক্সে! সি আই ডি!’

সি আই ডি মানে ‘ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট’—এটা আমি জানতাম। রাজ্য পুলিশের এক অঙ্গ হল সি আই ডি, যারা কঠিন অপরাধের তদন্ত করে থাকে।

‘সে কী! কেন? কী হয়েছে?’ মামা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

‘কোন্ এক মিসিং চাইল্ডের সন্ধানে!’

মিসিং চাইল্ড? নিরুদ্দিষ্ট শিশু! কান খাড়া হয়ে উঠল আমার।

‘হ্যাঁ। দিন চারেক আগে নাকি ট্রেন থেকে কৌন লড়কাকে কেহ গুম করে নিছে। এই অঞ্চলেই পুলিশ খুঁজছে তাকে।’

বালীজীর কথা শুনে বুক ধুকপুক করতে লাগল আমার। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। দেখি মা-ও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।

।। ২ ।।

অসাধারণ এক জায়গা এই হাম্পি!

বিশাল চত্বর জুড়ে মস্ত বিরূপাক্ষ মন্দির, বিঠঠল মন্দির, গরুড় রথমন্দির ইত্যাদি ছড়িয়ে রয়েছে ।

দুটি জীপ গাড়ি ভাড়া করে  আমরা তিনটি পরিবার গিয়েছিলাম এক ডে-পিকনিকে। হানিফ বলে চমৎকার  ইয়ং  গাইড পেয়েছিলাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব দেখালো সে আমাদের। সারাদিন অনাবিল আনন্দ পাওয়া গেল। অসাধারণ এক স্থান দেখা হল, যা না দেখা হলে হয়ত অপূর্ণতা থেকে যেত জীবনে।

 

—কী অয়নবাবু আর রূপা-মা আর গুগ্ গুল সোনা—তোমরা আবার বোরড হচ্ছ না তো আমার আজকের এই গল্প শুনে?

গলায় কুণ্ঠা বিজুদার।

—না না না না। বল বল জেঠু তারপরে কী হল? রাক্ষস দেখতে পেয়েছিলে?   রূপার জিজ্ঞাসা।

—রাক্ষস? তোমরা দেখতে পাওনি?

—সেই হারিয়ে-যাওয়া বাচ্চা ছেলেটার কী হল? পাওয়া গেল কি তাকে?  নীতিনের প্রশ্ন।

—বলছি। বলছি। শোনই না।

বিজুদা বলে যেতে থাকেন।

পরের দিন দুপুরে লাঞ্চ করতে এসে রাঙামামা বললেন, ‘কী কাণ্ড দেখ দেখি,ছোড়দি। তোমরা দু’দিনের জন্যে বেড়াতে এলে এখানে আর এখনই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল…..।’

পাতে ডাল ঢালতে ঢালতে রুকে গেল মায়ের  হাত।

—‘কেন রে? কী হয়েছে?’

আমাদের মুখের গ্রাস আটকে গেছে।

‘ শোনা গেল, কাল রাতে বালীজীকে নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে পুলিশে!’

‘সে কী? বল কী? কেন? তিনি তো এক সজ্জন বৃদ্ধ মানুষ।’ বাবাও হতবাক।

‘রিটায়ার করে থেকে উনি কলোনীর বাইরে শহরে একটা ছোট বাসায় থাকেন।কী সব আরকিওলজিক্যাল গবেষণা-টনা করেন হাম্পির চারিদিকের পাহাড়ের গুহায় ঘুরে ঘুরে….। যা হোক্​ , পাকা খবরটা নিচ্ছি।’  রাঙামামা।

এই ছোট্ট কলোনীতে এটা একটা বিরাট খবর।

কিন্তু কারণটা কী?

 

না, কারণটা তখনই কিছু জানা গেল না। কিন্তু আবহাওয়াটা  কেমন মিইয়ে গেল যদিও বালীজী আমাদের কেউ হতেন না। সামান্য পরিচিতি মাত্র।

*

বাঁধ-প্রকল্পের মধ্যে ঐ আবাসিক-ক্লাবখানিই ছিল সেখানকার প্রাণভোমরা। সারাটা দিনই প্রায় সেখানে ছোটদের গ্রুপ-বড়দের গ্রুপ-মাঝারি দের গ্রুপ কেউ না কেউ দখল নিয়ে থাকে ভাগ ভাগ করে

। আমিও প্রায় সারাদিনই সেখানে পড়ে থাকি। ক্যারাম খেলা, টেবিল টেনিস খেলা, বিকালে লনে ব্যাডমিন্টন খেলা চলে পুরো দমে। ছোট একটা লাইব্রেরিও আছে। না, তখনও টেলিভিশন বস্তুটি আসেনি, তবে সন্ধ্যেবেলা ক্লাবের লনে সাদা পর্দা খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হত মাঝে মাঝে।   মনোজকুমারের সিনেমা  ‘উপকার’!

সেখানে সমবয়সী কিছু বন্ধুও জুটতে দেরি হয়নি। নীহারদা, নীহাররঞ্জন বিশ্বাস ছিল সেখানকার পাণ্ডা। ক্লাসে টেনে পড়ে। তখনই মুখে বেশ দাড়িগোঁফ বেরিয়েছে। একটা সবজান্তা নেতা-নেতা ভাব। তার বাবা প্রজেক্টের ফোরম্যান!

সেদিন সকালে ক্যারাম খেলা চলছে। একটা ডিফিকাল্ট এঙ্গেল থেকে রেডটা পকেটস্থ করে স্ট্রাইকারটা প্যান্টে ঘষতে ঘষতে নীহারদা বলল, ‘বালীজীকে কেন পুলিশে গ্রেফতার করেছে  তা কি তোমরা জানো?’

‘শুনলাম নাকি গ্রেফতার করেনি….’, কেউ বলল।

‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।’ পাশ থেকে রুমা বলে উঠল। কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে পাশটিতে । রুমা হলো নীহারের পিঠোপিঠি ছোট বোন।

‘কিন্তু কেন?’

‘আসল সন্দেহের তীর বালীজীর ভাই এর দিকে।  তার গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক’। রুমা।

‘সে কি? সে কি কোন কালোবাজারী করে?’ আমার প্রশ্ন।

‘ধুস্ বিজন। হচ্ছে শিশু-অপহরণের মতো চাঞ্চল্যকর  কথা আর তুই কোত্থেকে কালোবাজারী-টারী কী সব বলছিস’, নীহারদা ধমকে উঠল আমাকে।

‘ব্রিজ বা বাঁধ তৈরির সময়ে নরবলি বা শিশুবলি দেবার কথা শোনা যায়’। ভারিক্কি চালে বলল রুমা।

এই গল্পটা আমিও যেন কোথাও পড়েছিলাম। চুপ করে রইলাম। যদিও বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছে আমার।

‘কিন্তু হারিয়েছে কোন্ শিশু? কাদের ঘরের ছেলে? এই প্রজেক্ট এরিয়ার  কারোর নয় তো?’ একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললাম আমি।

এবং   বলে আবার ধমক খেলাম।

‘কোন্ শিশু হারিয়েছে সেটা বড় কথা নয়, একটা শিশু নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটাই  মোক্ষম কথা। নৈলে পুলিশ কি এমনি এমনি তোলপাড় করে খুঁজছে?’ গম্ভীর গলায় নীহারদা বলল।

আমি চুপ মেরে গেলাম।

কিন্তু আমার মনে ঘুরছে একটা ছবি। পৌনে চারফুটি এক বালক। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথা নেড়া। লম্বা উপবীত জামা ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে!

 

।।৩।।

‘একটা জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার আগেই বলা উচিত ছিল’, মাফি-মাঙার ঢঙে বললেন বিজুদা, আজকের গল্পের আসরে।

কী সেই কাহানী?

—সেইদিন দাবা খেলার শেষে বালীজী বলেছিলেন আমায়, ‘তা বিজনবাবু, রামায়ণ তো পড়েছ, যেখানে আমাদের এই কিষ্কিন্ধ্যার  কথা আছে…..’

‘রামের বন্ধু সুগ্রীব ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার রাজা!’ পাশ থেকে বলে উঠল মিনি, সে-ও জানে রামায়ণের গল্প।

‘উঁহুঃ। তার আগে আদতে তাঁর দাদা মহাবীর বালী ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যা-নরেশ, বালী-সুগ্রীব মল্লযুদ্ধে রামচন্দ্র যাঁকে আড়াল থেকে অন্যায়ভাবে বাণ মেরে হত্যা করেন’ বললেন বালীজী; ‘ আমি অন্য কথা বলছি।

বলি,  নিকোলো কণ্টি র নাম শুনেছ?’

কী কন্টি?  না, নাম শুনিনি ওঁর। বললাম।

‘নিকোলো দ্য কন্টি। ইটালিয়ান পর্যটক। বহুভাষাবিদ্। মার্কো পোলো ও ইবন বতুতার মতো জগদ্বিখ্যাত ভূ-পর্যটকের সঙ্গে একাসনেই বসাতে হয় ওঁকে, যিনি সেকালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত হয়ে চীন ও ইন্দোনেশিয়া ঘুরে আসেন’  বালীজী বললেন।

‘কন্টি যখন ভারতে আসেন তখনও কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার  করেনি, বঙ্গদেশে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব হয়  তারও  অর্ধশতাব্দী পরে।’

‘আর কন্টির শ্বশুরবাড়ি  ছিল এই বিজয়নগরেই’, পাশ থেকে রাঙামামার সহাস্য সংযোজন, ‘আপনার কাছ থেকেই শুনেছিলাম আগে একদিন।’

‘জী। বিজয়নগরের এক কন্যাকেই বিবাহ করেছিলেন কন্টি। আর তারপর এখান থেকে বঙ্গালদেশ, মালয়, চীন, জাভা যেখানেই গেছেন সস্ত্রীক-সপুত্রই গেছেন নিকোলো! বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন উনি ওঁর পান্থলিপিতে।’

‘কন্টি-র উপরেই তো আপনার গবেষণা, যে কারণে আপনি এই অঞ্চলেই থেকে গেছেন, রিটায়ার করে আর পাঞ্জাবে ফেরেননি!’ এ-ও রাঙামামার সহাস্য সংযোজন।

‘গবেষণা-টণা বলবেন না, ব্রহ্ম-জী। আমি সামান্য  পড়ুয়া মাত্র, তবে কেতাবের চাইতে পত্থর আর গুহা-কন্দর আর জমি-মাটি  পাঠ  করাতেই আমার বেশি উৎসাহ, যার জন্যে এখানে পড়ে থাকা। বিশেষ করে এক যুগান্তকারী ইটালিয়ান ম্যাপের উপরে তীব্র আকর্ষণ আছে আমার’। বালীজী।

‘ফ্রা মাউরো ম্যাপ!’ রাঙামামা।

‘হ্যাঁ ব্রহ্ম-জী। এর সম্বন্ধেও  আগে আপনাকে  অনেক গল্প করেছি আমি। দিস ইস মাই অবসেশন।’,  বললেন মিঃ কে এন বালী, ‘ এইটা হলো এক যুগান্তকারী ম্যাপ ! ভাস্কো-ডা-গামা ইউরোপ থেকে সটান ভারতে আসাবার  সমুদ্রপথ আবিষ্কারের অনেক আগেই ফ্রা মাউরো তাঁর ম্যাপে সে পথের হদিশ এঁকে দিয়েছিলেন।  ইটালির এক পাদ্রী ছিলেন ফ্রা মাউরো। ভেনিস ছেড়ে জীবনে এক পা-ও বেরোননি । দেশভ্রমণ করে নিকলো কন্টি ইটালীর বাড়িতে ফিরে এলে মাউরো নাকি এই ম্যাপটা এঁকেছিলেন কন্টির মুখে গল্প শুনে শুনে, কিন্তু এর এক আদি কপি সম্ভবত ছিল কন্টির কাছে, এবং…’

‘এবং…কী?’ আমাদের সমস্বর প্রশ্ন।

‘এর এক আদি কপি ছিল নিকোলো কন্টির কাছে, যা তিনি বিজয়নগরেই ছেড়ে যান’ বালীজী বললেন।

‘এটা খোঁজাই আমার মিশন!’

সত্যি?

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার।

।।৪ ।।

এ’হেন ইন্টারেস্টিং তথা বুজুর্গ মানুষ মিঃ কুশাক্ষনাথ বালীকে শিশু-অপহরণের দায়ে পুলিশে ধরেছে—খবরটা হজম করা শক্ত। উপরন্তু, খবরটার সোর্স কী—সেটাই কেউ বলতে পারছে না, যেমন বলতে পারছে না ঠিক  কোন্  শিশুটি অপহৃত হয়েছে, যদিও সারা কলোনী জুড়ে এই গরমাগরম আলোচনা চলছে তুমুল ভাবে।

এই প্রশ্ন ফের উত্থাপন করে ধমক না খেয়ে পরেরদিন সকালে এক ডিসিশন নিয়ে ফেললাম, বুঝলি হরেরাম!

সুদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন বিজুদা, আজকের গল্পের আসরে।

ওঁর স্বভাবোচিত উদ্ভট নামে ডাকা শুরু হতেই বুঝলাম যে বেশ মুডে এসে গেছেন বিজুদা, কারণ গল্পের মুডটা খোলতাই হলেই উনি আমাকে হয়ত ‘চন্ডীপ্রকাশ’ বা নীতিনকে ‘হাতেমতাই’ বা সুদীপকে ‘রাধামাধব’ বলে ডাকেন। পরক্ষণেই হয়ত আমি হয়ে গেলাম ‘ডঃ জিভাগো’ , সুদীপ ‘সত্যপ্রকাশ’ ও নীতিন ‘কাব্যবিশারদ’!  সত্যি, বিজুদার এই নিত্যনতুন উদ্ভট উদ্ভট নামে আমাদের  ডাকাটা বড্ড উপভোগ করি আমরা। আমাদের কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না উনি কখন কাকে ডাকছেন। কেবল আমাদের মধ্যে  শ্যামল অধ্যাপক মানুষ বলে সর্বদাই তাকে ‘পোরোফেসর সাআআব’ বলে ডাকেন বিজুদা।

যা হোক্, গল্পে ফিরে আসি।

বলে যেতে থাকেন বিজুদা….

পরদিন সকালে জলখাবার-টাবার খেয়ে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা রাঙামামার লজঝড়ে সাইকেলখানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি।

‘ওটা নিয়ে আবার কোথায় চললি,বিজু?’ মা।

‘পাম্প দিইয়ে নোব আমি। দুপুরে খাওয়ার আগেই ফিরব’। সাইকেলে চড়তে চড়তে বললাম।

এই কে এন বালীর গ্রেফতার রহস্যটা উদ্ধার করতেই হবে আমায়। কাগে কান নিয়ে গেছে শুনে কাগের পিছনে দৌড়নোটা  আমার স্বভাবে লেখা নেই। নিজে হাত বুলিয়ে দেখে নেব কানটা আছে কিনা। তাই চললাম বালীসাহেবের বাড়ি খুঁজতে। সরেজমিন তদন্ত।

বালীজী মানুষটিকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল আমার।

*

কলোনীর হাতার কিছুটা বাইরে একটা ছোট কসবা আছে, সেখানে কয়েকটা দোকানপাট,  কয়েকটা পাকাবাড়ি-টাড়ি রয়েছে। সকালের দিকে একটা ছোট বাজারও বসে।  বালীজী এখানেই থাকেন, শুনেছিলাম। ওঁর নাম করতেই লোকে দেখিয়ে দিলো।

একটি ছোট দোতলা বাড়ি। হলুদ রঙ। দরজা জানলা সবুজ। সব টাইট করে বন্ধ করা রয়েছে। গেটে কিন্তু তালা দেওয়া নেই। অনেকবার কড়া নাড়বার পরে এক বুড়ি পরিচারিকা গোছের মহিলা বেরিয়ে এসে অবোধ্যভাষায় কী সব বলে দড়াম করে মুখের উপরে দরোজাটা বন্ধ করে দিল।

এতো দূর এসেছি খুঁজে খুঁজে,  চলে যাব খবরটা না-নিয়েই? বালী সাহেব কি সত্যিই গ্রেফতার হয়েছেন, না ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে আছেন ঘরের ভিতরে? জানতে হবে না? কেন উনি গ্রেফতার হবেন? কী দোষ করেছেন উনি?

আবার কড়া নাড়া। আবার। বেশ কিছুক্ষণ ধরে।

ফের সেই বুড়ি দরজা খুলতেই হাত জোড় করে নমস্কার করলাম। নিজের বুকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘বিজন। বিজন। কলকাত্তা।’  ইঙ্গিতে দেখালাম যে ভিতরে আসতে চাই। ভাষা না বুঝলেও বুড়ি যেন বুঝতে পারে যে গৃহকর্তাকে গিয়ে বলতে বলছি যে আমি বিজন। কলকাতা থেকে আসছি। ভিতরে আসতে চাই।ব্যক্তিত্ব বাড়াতে সেদিন ফুলপ্যান্ট পরে গিয়েছিলাম আমি!

হাতের ভঙ্গিতে ‘ওয়েট’ দেখিয়ে বুড়ি অন্দরে চলে গেল। আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে ফিরে এসে ভেতরে ডাকল। ইঙ্গিতে উপরের দিকে দেখালো।

অন্ধকারাচ্ছন্ন  ঘর ডিঙিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়  উঠে এলাম।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকেই একটা ঘরের দরোজা খোলা। বেশ বড় ঘর একটা। তার অন্য সব দরজা-জানলা বন্ধ। বাইরের রোদ থেকে ঢুকে আরও ঠাহর পাচ্ছি না কিছু।

ঘরের দেওয়াল জুড়ে কেবল বই আর বই—এইটা হালকা রকম দেখতে পেলাম। মস্ত বড় একটা টেবিলের ওপারে চেয়ারে বসে আছেন  খর্বকায় বালীজী, ওঁর বুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সামনে টেবিলের উপরে রাখা অনেক কাগজপত্তর, কয়েকটা পাথরের ঢেলা ও এক ম্যাগনিফাইং গ্লাস—সামনের টিমটিমে টেবিল ল্যাম্পটির আলোয় দেখা গেল। উনি এগুলি নিয়েই কাজ করছিলেন, অনুমান।

‘আমি বিজন। আমাকে চিনতে পেরেছেন কি?’ বললাম।

‘আসেন আসেন । বসতে আজ্ঞা হৌক্’  হাসতে হাসতে উঠে  বাইরের বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিলেন উনি। আলোয় ভরে উঠল ঘরটা।

ঘরে ঢুকে বড় টেবিলটার পাশ দিয়ে গিয়ে ওঁর চেয়ারের কাছটায় দাঁড়ালাম।

উনি সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। অস্বস্তি হচ্ছে আমার। কি, চিনতে পারছেন না নাকি? কিন্তু অভিবাদনে তো তা মনে হলো না।

‘আপনার নাম বিজন ? কলকাত্তা থেকে এসেছেন? পি কে ব্রহ্ম-সাহেবের ভাগ্নে হন তো আপনি ?’ অবাক হলাম ওঁর এই কথা শুনে। প্রায় দু’ সপ্তাহ হয়ে গেল আমরা হসপেটে এসেছি। এর মধ্যে কতো দিন উনি রাঙামামার কোয়ার্টার্সে এসেছেন, দাবা খেলেছেন, কত গল্প করেছেন আমার সঙ্গে, আর এখন এই কথা বলছেন? যেন চিনতেই পারছেন না! চূড়ান্ত অবাক হলাম।

জলের জগটা এগিয়ে দিতে দিতে স্মিত হেসে বললেন তিনি আমায়, ‘বসেন, বসেন। এই লিন, পানি পীয়ে লিন। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? কেলাস এইট পর্যন্ত আমিও বঙ্গালদেশে পড়াশোনা করেছি, কলকাত্তার কাছেই থাকতাম। দাদার মতো বঙ্গালীভাষাতে আমিও ভালো জানে।’ বললেন।

‘দাদার মতো?’ অবাক হয়ে শুধোই আমি।

‘মিঃ কুশাক্ষনাথ  বালী। আপনি তাঁর সাথেই দেখা করতে এসেছেন তো? আমি তাঁরই ছোট ভাই, সুখবীর। গোয়াতে থাকি। আমার বিজনেস আছে পাত্থর আর সেরামিক টাইলসের। এই হাম্পি অঞ্চলে প্রায়ই আসি, খাদান আছে। এবার বলেন, হাউ ক্যান আই হেল্প ইয়ু? দাদা কিন্তু এখন এখানে নেই।’

ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল পান করে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। হুবহু এক দেখতে দুই ভাইকে। কথা বলার ধরন, হাত নাড়ানো, ঘাড় ঘোরানো একই প্রকার।তাই প্রথম দর্শনে এঁকে বালীজী ভেবে ভুল করেছিলাম আমি।   তবে একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় এঁর ঘাড়টা আরেকটু যেন বেশি শক্তসামর্থ্য, চালু কথায় বলতে এই ছোট ভাইটি আরেকটু যেন বেশি ঘাড়ে-গর্দানে। আর কোনো পার্থক্য নেই ভাইয়ে ভাইয়ে। ব্যবহার কিন্তু তেমনই অমায়িক।

‘ক্কোথায় গেছেন বালী সাহেব? ওঁর সাথে কেন দেখা হবে না? গত কয়েকদিন উনি দাবা খেলতে আমার মামার বাসায় আসেনও নি। ’ কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে প্রশ্ন করি আমি। [উনি কি তাহলে  সত্যিই জেলে গেছেন? বাজারে চালু অপবাদটা কি তাহলে সত্যি?]

‘দেখা পাবেন না কারণ দাদা এখন ওঁর স্টুডিও-তে আছেন। ব্যস্ত।’

‘স্টুডিও? মানে, উনি কি একজন শিল্পী?’ অবাক প্রশ্ন আমার।

‘কার্টোগ্রাফার’  [এর মানে যে ম্যাপ-মেকার, যাঁরা ম্যাপ আঁকে—এটা আমি জানতাম] , বললেন সুখবীর-জী, ‘আর ওঁর স্টুডিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই কিষ্কিন্ধ্যা অঞ্চলের পর্বতে কন্দরে গুহায় নদীতে হ্রদে—হাম্পির ভগ্নাবশেষের চৌভিতে। বর্তমানে উনি সুগ্রীব-গুহার ওখানে গবেষণারত আছেন।দেখা তো হবে না ভাই এখন ওঁর সঙ্গে।’

‘কিন্তু আমাদের কলোনীতে কী খবর রটেছে সেটা কি আপনি জানেন?’

‘আলবৎ। পুলিশ আসবার খবর তো ? কিন্তু পুলিশ তো এসেছিল আমার কাছে, খাদানের লাইসেন্স রিনিউ করা নিয়ে এক ডিসপ্যুটে । দাদা ইন্টারভিন করেছিলেন সেই খাদানের গায়েই এক ঐতিহাসিক গুহা আছে, সেই ব্যাপারে। আরকিওলজিক্যাল সার্ভে এখনও সেটা অধিগ্রহণ করেনি, কথা বার্তা চলছে—সেই নিয়ে।’

‘তাহলে, এর সঙ্গে ট্রেন থেকে শিশু অপহরণের কোনো সম্পর্ক নেই, বলছেন?’ আমি বলি।

চমকে উঠলেন ভদ্রলোক।

‘শিশু অপহরণ? শিশু চুরি গেছে? সে কী? কবে হয়েছে? কার শিশু চুরি গেছে?’ সুখবীরজীর গলায় খাঁটি বিস্ময়।

এবার ঢোঁক গেলার পালা আমার কারণ এই ডিটেইলসটা আমিও জানিনা, আর এটা জানতে চেয়েই ক্লাবে নীহারদার কাছে ধমক খেয়েছি।

অন্যভাবে গুছিয়ে বললাম সেটা ওঁকে।  চিন্তিত হয়ে উঠল ওঁর মুখ।

‘তাহলে তো এখনই আপনাদের কলোনীতে যেতে হয় আমায়। ক্লাবে গিয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলে ভুল ভাঙাতে হয়। নৈলে এক নিরপরাধ মানুষের নামে অযথা কলঙ্ক রটছে—এটা ঠিক নয়!’

।।৫।।

সেদিন বিকালে কিন্তু সুখবীরজী আসেননি আমাদের কলোনীতে, সান্ধ্যে আড্ডাতেও না , যদিও উনি বলেছিলেন যে কলোনীতে ওঁর বহু যাতায়াত আছে, অনেক বন্ধু আছে সেখানে।

বলা বাহুল্য, আমার সকালের অভিযানের কথা কারোকেই বলিনি। চেয়েছিলাম, বালীজীর ভাই নিজেই চলে আসুন, সকলের সঙ্গে কথা হয়ে যাক সামনাসামনি। কে এন বালী নিজে উপস্থিত হলে তো সবচেয়ে ভালো হতো, কিন্তু কী যে গবেষণা  করছেন উনি পাহাড়ী  স্টুডিও-তে  বসে, খোদায় মালুম।’

 

**

সুখবীরজী এসেছিলেন। তার  পরের দিন। দশটা নাগাদ আমি ক্লাবে ঢুকতে যাচ্ছি, এবার ক্যারামের আসর বসবে, দেখি ভট্ ভট্ করতে করতে এক ল্যাম্ব্রেটা স্কুটার চড়ে উনি আসছেন।

‘আসেন, আসেন, বসে পড়েন। বিস্তর কথা আছে আপনার সঙ্গে।’ বললেন উনি আমায়।

একে তো স্কুটার চড়ার সুযোগ (১৯৬০এর দশকে খুব রেয়ার ছিল), তার উপরে উনি ‘আপনি’ বলে কথা বলছেন  আমাকে [সেদিনও গতকালের ঐ ফুলপ্যান্টটা পরে ছিলাম]—সাত-পাঁচ না ভেবেই উঠে বসলাম পিলিয়নে।

‘তুঙ্গভদ্রার তীরে গঙ্গাবতী গ্রাম। তার পাশে আছে টিলা। পাত্থুরে জায়গা। স্কুটারে আধা ঘন্টা লাগবে। আমি যাচ্ছি। উড ইউ আকম্প্যানি মী?’

মূলত স্কুটারে চড়তে পাবার আনন্দেই রাজী হয়ে গেলাম।  এখনই তো ফিরে আসবো।

‘গুহাটা সেখানেই।’ সুখবীরজী।

‘গুহা?’ পুছি।

স্টুডিও!’ হাসেন সুখবীরজী ঘাড় ফিরিয়ে,

‘কাল রাতে ভূমিকম্প হয়েছিল, টের পেয়েছিলেন কি?’

‘না তো’

‘সে কী! পরশুও তো হয়েছিল, আরও বেশি। বুঝতে পারেননি কি?’

‘হ্যাঁ, সেটা নিয়ে বাড়িতে-ক্লাবে চর্চা হচ্ছিল বটে’। বললাম।

পথটা এখানে বেশ পাহাড়ী উঁচুনিচু।

‘ঐ দেখেন পম্পা-সরোবর। রামায়ণের কালে সীতা মাঈয়া স্নান করেছিলেন এখানে’ ,  আঙুল তুলে দূরে একটা হ্রদ দেখালেন সুখবীরজী। চমৎকার ফুল-ফলশোভিত গাছপালা দিয়ে ঘেরা সেই জায়গাটা।

‘সামলিয়ে বসেন বিজনবাবু। পত্থর ভরা আছে রাস্তায়’।

আমি ওঁর কোমরের বেল্টটা বেশ পাকড়ে ধরলাম।

‘ঐ যে দূরে দেখছেন বড় বড় পাত্থর , ঐগুলি কিন্তু আসলে দুন্দুভি রাক্ষসের হাড়গোড়। বালী রাজা ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। এখন সব শিলা হয়ে গিয়েছে।’

বেশ মজা পেলাম ওঁর কথায়। উনি বোধহয় সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন এ’সব গল্প।

 

 

।।৬।।

‘আসেন আসেন আসেন আসেন—মিঃ বিজন বিহারী সরকার। আসেন।’

মস্ত মস্ত পাথরের বোল্ডার টপকে টপকে   পাহাড় থেকে নেমে আসতে থাকেন মিঃ বালী—মিস্টার কুশাক্ষ নাথ বালী। মাথায় তাঁর খনিকর্মীদের মতো এক সার্চ লাইট বাঁধা রয়েছে।

হাসতে হাসতে  বলেন, ‘সামলিয়ে সামলিয়ে উঠবেন ভাই।’

পাশে ঘাসের উপর স্কুটারটা স্ট্যান্ড করিয়ে আমাকে নিয়ে টিলা বেয়ে উপরের দিকে উঠতে যাচ্ছিলেন ওঁর ভাই।

প্রখর রৌদ্রে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। হাওয়াও দিচ্ছে। মাসটা কার্তিক। বেশ উপভোগ্য আবহাওয়া।

 

নিচে নেমে এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন বালীজী, আলিঙ্গনও করলেন। উচ্চতায় উনি আমার চেয়ে সামান্য বেশি হবেন মাত্র।

‘বিজন, তোমার উৎসাহ আছে তাই বলিঃ আমার এতোদিনের গবেষণা আজ সফল হয়েছে ? ’

ওঁকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শুধাই, ‘তার মানে আপনি নিকোলো কন্টির পান্থলিপি খুঁজে পেয়েছেন? আর সেই ম্যাপ? ফ্রা মাউরোর ম্যাপ?’

‘ফ্রা মাউরোর অরিজিন্যাল ম্যাপখানি তো রাখা রয়েছে ইটালির ভেনিসের এক যাদুঘরে। কিন্তু অন্য নানান সোর্স থেকে ও ট্রাভেলোগ পড়ে আমার মনে হয়েছিল…….’

হঠাৎ গুড় গুড় করে শব্দ আর দুলে উঠলো মাটিটা।

ভূমিকম্প শুরু হয়েছে! ভূমিকম্প!

তিনজনে আমরা দৌড়ে গিয়ে  পাশের ফাঁকা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম।

তীব্রতা বেশি নয় এই ভূকম্পের। কয়েক মিনিট পরেই মাটি কাঁপা থেমে গেল।

‘বিজনবাবু কি দেখতে চান সেই ঐতিহাসিক ম্যাপ, ভাস্কোরও আগে ভারতে আসার সটান জলপথ আঁকা ছিল যেখানে?’

‘আপনার কাছে আছে সে ম্যাপ?’

‘বহু গুণের অধিকারী ছিলেন বটে এই কন্টি সাহেব কিন্তু উনি যে ম্যাপ আঁকাতেও দড় ছিলেন সেটা লেখেনা কোনো প্রতিষ্ঠিত  সোর্সে । তারই প্রমাণ সদ্য পেয়েছি গুহার দেওয়ালে!’

‘দেওয়ালে?’

‘জী। দেওয়ালের গায়ে আপন খেয়ালে এঁকে গিয়েছেলেন উনি গোলাকার পৃথিবীর ম্যাপ, যদিও আরবী পরম্পরা মেনে ম্যাপের উপর দিকটা দক্ষিণ আর তলাটা উত্তরদিক। এই দেখুন….!’

নানা রকম কথা বলতে বলতে আমরা টিলায় চড়ে গুহাটির মধ্যে ঢুকে এসেছিলাম।

বিভিন্ন ছবি ,রঙ ও জ্যামিতিক ফিগারে ভরা রয়েছে গুহার দেওয়াল।

যদিও ‘এ’সবগুলিই যে কন্টির কাজ, তা নয়। রামায়ণের কালেরও কাজ থেকে থাকবে, কার্বন ডেটিং করলে বোঝা যাবে।’ বালীজীর গলা ভেসে এলো পিছন থেকে।

গুহার মধ্যে এক সরু সুড়ঙ্গ পথ ধরে এগোচ্ছি আমরা। প্রথমে বালীজী, তারপরে আমি, শেষে সুখবীরজী। সামান্য সামান্য আলো আসছে  কোন্​ ফাঁক ফোকর দিয়ে কে জানে। কোনোখানে আবার সম্পূর্ণ অন্ধকার।

‘এইবার দেখেন’। সার্চ লাইট অন করে দিতে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে মস্ত এক মানচিত্র আঁকা রয়েছে। নানান রঙে। অনেক অনেক স্থাননাম লেখা তাতে। লাতিন ভাষা হবে। অক্ষরগুলোর মিল আছে ইংরিজির সঙ্গে। নীল রঙের সমুদ্র। হলদেটে স্থলাঞ্চল।

 

উনি আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলেন আর অবাক বিস্ময়ে দেখি আমি—- কলকেতার এক কিশোর, ক্লাস এইটে পড়ি তখন। ঐতিহাসিক এক  মানচিত্রের সামনে কি দাঁড়িয়ে আছি আমি, ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে আসাবারও আগে নাকি যেখানে সেই জলপথ অঙ্কিত ছিল!

আর এইদিকে দেখেন। বালীজী।

  • বালী-সুগ্রীবের মল্লযুদ্ধের ছবি।
  • বানর-রাক্ষসের লড়াইয়ের ছবি।
  • সেতুবন্ধনের ছবি।

কার আঁকা ছবি এ’সব? নিকোলো কন্টির?

‘নিশ্চইয়ই নয়। এর স্টাইল আরও প্রাচীন। এই গুহাটার কথাই আমি প্রাচীন এক টেক্সটে পড়েছিলাম, এ’অঞ্চলের ওরাল-হিস্ট্রিতেও  ঘোরে এ’সব গপ্প। এটাই ছিল আমার বিগত বিশ বছরের খোঁজ, বুঝলেন বিজনবাবু?  পরশুদিনের ভূমিকম্পের ফলে এই গুহার সামনের কোনো পাত্থর সরে গিয়ে থাকবে, যাতে উন্মুক্ত হয়ে যায় এটি।’ বালীজী  বললেন।

পরের পর গুহাচিত্র দেখে চলেছি।

*

তারপর হঠাৎ একটা ছবির উপর দিয়ে আলো ঘুরে যেতেই চমকে উঠলাম আমি।

‘দাঁড়ান দাঁড়ান।  দেখি দেখি, এটা কার ছবি?’

সেই ছবিতে দেখি চারটি হুবহু এক দেখতে বালক। মুণ্ডিত মস্তক।দীর্ঘ উপবীত।পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।

আমার স্মৃতিতে চলে এলো ট্রেনের কামরায় দেখা একটা ছবি !

‘এরা কারা?’ শুধাই অবাক বিস্ময়ে।

‘এ’ছবি তো দেখা যায়। আগে দেখেছি আমি  কোথাও’, বললেন বালীজী, ‘এঁরা হলেন সনকাদি বাল-চতুষ্টয়।

‘একটু ব্যাখ্যা করে বলুন প্লিজ।’ হাত-পা কাঁপছে আমার।

‘পুরানে আছে, ব্রহ্মার আদি পুত্র এই চারজনঃ   সনক, সনন্দ , সনাতন আর সনৎ। তাই বলে সনকাদি—সনক আদি, মানে সনক প্রমুখ ।চারজন।’

‘সনৎ?’ অবাক প্রশ্ন আমার।

‘হ্যাঁ, চতুর্থজন।’

‘সনৎ কি হারিয়ে গেছে?’ আমার জিজ্ঞাসা।

‘বৈকুন্ঠধামের দ্বারে প্রহরী ছিলেন জয় আর বিজয় দুইভাই। তাঁরা কাজে অবহেলা করায় শাপগ্রস্ত হয়ে ত্রেতাযুগে রাবণ আর কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।‘

‘কুম্ভকর্ণ? যে খুব ঘুমতো? আর খেত?’ আমার প্রশ্ন।

‘মস্ত ধার্মিক আর মহাবীর ছিলেন কুম্ভকর্ণ। রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্যে দাদা  রাবণ তাঁকে জাগিয়ে তুললে প্রথমেই উনি সীতাকে ফেরৎ দিয়ে দেবার কথা বলেছিলেন….. সনকাদির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ওঁদের নিয়ে  সারা জগৎ-চরাচরে ঘুরে বেরিয়েছেন….’

‘কে? মিঃ কর্ণা?’ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার।

‘আর দায়িত্ব অ-পালনের দোষে শাপভ্রষ্ট হয়েছেন’, আমার প্রশ্ন গ্রাহ্য না করে বালীজী বললেন।

কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি।

‘সনৎ কি হারিয়ে গেছে?’ শুধালাম।

‘ওগো, সনৎকুমার হলো নিত্যকুমার। তিনি সদাই সর্বত্র বিরাজমান আছেন, আজ এখানে কাল সেখানে। এই দেখা দেন এই পালান। তাঁকে খুঁজবে কে গো?’

‘তার মনে সনৎ কি হারায়নি?’ আমার উদগ্রীব প্রশ্ন।

আরও কত কী বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু  বালীজীর কথা শেষ হতে-না-হতেই হঠাৎ গুড় গুড় করে উঠল মাটি!

আবার ভূমিকম্প  শুরু হয়েছে! ভূমিকম্প।

এবারে তেজটা অনেক বেশি। গুম গুম গুম গুম্ করে শব্দ আসছে মাটির তলা থেকে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে মাটি।

ক্রমে  আরও বেড়ে উঠলো  কম্পন। দুম্ দুম্ করে উপর থেকে পাথর গড়িয়ে গড়িয়ে  এসে পড়ছে।

‘কুইক। কুইক। পালাও পালাও এখান থেকে’। আমার  হাত ধরে গুহার বাইরের দিকে দৌড় লাগালেন বালীজী। পিছন পিছনে সুখবীরজী।

‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। এই ভূমিকম্পের আবহে গুহাতে ঢোকা উচিত হয়নি।’ বললেন তিনি।

গুহামুখ খুঁজে পাচ্ছি না। পথ ভুল করলাম নাকি?

তা নয়। মাটির কম্পনে কোনো এক বড় পাথর গড়িয়ে এসে ঢেকে দিয়েছে গুহামুখ! সর্বনাশ! এবার আমরা বেরোবো কী করে? ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলাম। সার্চলাইটের আলোও কমতে শুরু করেছে।

বহু প্রচেষ্টায়  শেষে এক পথ বেরোলো।

‘জয় বজরঙ্গবালী! ঐ দেখেন সামান্য সূর্যালোক আসছে ঐ ফোকর দিয়ে।’ বললেন বালীজী। তুমি ছোটখাট আছ, পাতলা শরীর। তুমি আগে এই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাও।

ডানদিকে এক উপ-সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে বালীজী ঠেলে তুলে দিলেন আমাকে। অনেক কষ্টে আমার মাথাটা বাইরে বেরলো, তারপর পুরো শরীরটা।

 

বাইরে এসে মস্ত এক পাথরের চাঙড়ের উপরে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লাম আমি।  হাঁফাচ্ছি।  অসম্ভব ক্লান্ত আর ভীত হয়ে পড়েছিলাম আমি। শরীর আর দিচ্ছে না। আর পারছি না।

কিন্তু পারতে  যে আমাকে হবেই।

ভাই সুখবীরকে এবার ঠেলে তুলে বাইরে বার করতে চাইলেন বালীজী। বাইরে থেকে ওঁর হাত ধরে আমি টানছি। কিন্তু কিছুতেই বার করতে পারলাম না ওঁর ভারী শরীর।

**

বিজুদা চুপ।

বিজুদার গল্প শেষ। আজকের গল্প শেষ।

‘কী হলো? শেষ পর্যন্ত কী হলো ওঁদের? বলুন? থেমে গেলেন কেন?’ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম আমরা শ্রোতৃকুল; ‘উদ্ধার করতে পেরেছিলেন ওঁদের?’ আমাদের মিলিত  প্রশ্ন।

—‘ বহু কষ্টে অনেক পরে  এক খাদানের লরি পেয়ে সন্ধ্যাবেলায় যখন কলোনীতে ফিরে এসেছিলাম , ততক্ষণে কান্নাকাটি পড়ে গেছে সেখানে—আগের সেই ‘অজ্ঞাত’ বালকের মতো আরও একটি ছেলে চুরি হয়ে গেল নাকি? গেটেই বহু লোকের ভিড়।

—‘এরপরের গল্প আর আমার কাছ থেকে আর শুনতে চেওনি বাপু। মা সুমিত্রা, দাদাকে এক কাপ চা দিবিনি? গলা যে শুকিয়ে গেল’, হাতজোড় বিনতি বিজুদার।

*

‘শেষে শুধু জানাই, না, প্রস্তর-সমাধি হয়নি বালী-সুখবীরের। শহর থেকে লরি ভরে লোকলস্কর শাবল-টাবল নিয়ে এসে গুহামুখের পাথর সরিয়ে ওঁদের উদ্ধার যখন করা গেল, রাত ভোর হয়ে গেছে ততক্ষণে।’

**

বিজুদার আজকের গল্পের শেষে  আমাদের কারো মুখে আর বাক্যি সরেনি।।

 

জয় বজরঙ্গবলী!!

।।সমাপ্ত।।

 

English Version

Kiskindhya

By : Dipankar Choudhuri (in Bangla)

Eng. trans. by : Amitabh Moitro

 

Part 1

(Part 2 will be on next issue)

 

Keeping down his emptied tea cup, Biju-da had put his story in motion – This happened in those times when I was a knicker-wearing teenager school student.

 

This story-telling session of Bijuda is happening after a long gap. The children have taken their vantage positions on floor to hear the story. Ladies of the household cozied themselves on sofas, after finishing food-making chores in a hurry. Male folks also joined the audience. Someone had teased Bijuda on inventing whammy stories and befooling all. Duch negative vibes got muted with a quip that even if the stories are fabricated, he himself remains an eager listener.

 

Then Bijuda’s story unfolds :.

-Since long, in the southern part of India, there lived 2 species. In Ramayana, they were called as ‘Banar’ and ‘Rakshas’.

 

One of the audiences chipped in – Yes. I have seen a BBC documentary on that. Bijuda flashed a happy smile on this BBC support. “See ! But you still call me a story-fabricator.”

 

Another elaborated – Rakshas are in England also, they are not only desi incarnations.They were the original inhabitants of England (island). Son of Aphrodite (Greek goddess of beauty), Inius was defeated in Battle of Troy and fled. His later linage Brute of Troy crossed English Channel, defeated the local inhabitants (Rakshas) and became the king. The name Britain had it’s origin at Brute of Troy.

 

Bijuda had picked up the reign of his story again.

It was in 1960s. I was then in class VIII. I had a mamaji who was a civil engineer, working at Hospete (now in Karnataka) with Tungabhadra Dam project. Tungabhadra is a familiar name to Bengalees,  through a very popular historical novel In the Banks of Tungabhadra by Saradindu Bandopadhaya. I also had read that book and got fascinated by the description and happenings at Hampi.That was the capital of Vijaynagar empire and very near to my mama’s workplace of Hospete.

 

So a family holiday was planned to Hospete during Puja vacation. A long 3 phase train journey was involved – Howrah to Bombay, Bombay to Goa and Goa to Hospete. It was a long and tiring journey and we all are extremely worn out towards the end of the journey.

 

A strang thing happened in Goa-Hospet leg of our journey.. There in the sparsely crowded train compartment, a boy of 7- 8 years played some prank with us. He was of a very fair complexion, with shaven head and was wearing the sacred thread along his torso. And after some time there appeared another boy with same complexion, shaven head and wearing the thread. Oh, they are twins ! The family must be sitting some seats away in this compartment.

But holy grain, soon we have seen more – 4 of them. All with similar features. They are quadruplets.

 

Sometime later a dark man appeared, chiding the kids for pranks. We started a courtsey conversation with him. He was Mr. Karna, gurdian to these kids (not their father). He was taking the kids to leave them at some ashram.

 

But a strange thing happened before our train reached Hospet. Mr. Karna came howling and worrying – one of the four kids has gone missing. He searched everywhere but no trace. That was not a vestibule train and none can go out of compartment. But still the kid disappeared and remained untraced.

 

At Hospet, we alighted. We were showered a very warm welcome. Mama’s residense was in Dam project campus. In his house, a breeze of happiness wafted on feel of family get-together. Campus life had activities that revolved around Club House. There were many community celebrations and events in club house in which we had also joined. After few days of merrymaking at Hospete, a family trip to Hampi was planned. Hampi was only a few kilo meters away.

 

Hampi was the capital of Vijaynagar empire. They started their reign in major parts of South India 200 years before Moughal’s ruled. And their reign spanned over 300 years. Foreign travellers of that time – Italian, Portuguese, Iranian, Chinese etc. had spoken very highly of Vijaynagar empire.

 

At Hospete we met an unique elderly person – Mr. Bali. He had worked in the Dam project and on retirement, he had settled at Hospet though his native place is Jullandhar. He used to come at mama’s campus quarter for a chat. He told us tit bits of Ramayan stories related to Hospet. He told us that Hospet was known as Kishkindhya in Ramayan times, it was the capital of Banar kingdom and Bali was the king and Sugreeb was his brother. In the duel of Bali – Sugreeb, Ram killed Bali by deceit and Sugreeb became the king. After Ravan had stolen Sita, Ram-Laxman, in their mission of tracing Sita,  first met Sugreeb here. He insisted that in our Hampi trip, we must visit Sugreeb gufa.

 

One day, during one such chat, he disclosed in hushed tone that a child has gone missing and police is searching him. It immediately rang a bell in our minds. We linked it with the missing boy during our train journey.

 

Ruins of Vijaynagar empire are standing with a royal grandeour all over Hampi. Virupaksha Temple, Vitthal temple, Dussera Mandap, Paan Supari Bazar are standing with regal splendour, emitting the dazzling glitter of a bygone era. It was awe-inspiring – commented Bijuda in a reminisant mood.

 

But by now the audience got restless as the story was not going to what happened to that missing child. They prodded him for that. Our Mami broke a news that last night, police had arrested Mr. Bali, suspecting him for stealing the missing boy. Next day, teen group in the clubhouse brought in some tricked information that Mr. Bali’s brother (not Mr. Bali) was arrested. The practise of human sacrifice while making big bridge or dam was also aired in the present context.

(End of Part 1. To be continued to Part 2)

 

About the author
Dipankar Choudhuri (born 1961) is a Kolkata based author. He had his schooling at Hindu School and Presidency college. He had been working with a bank and travelled extensively. He regularly writes science fiction stories for teenagers which are published in various magazines. He has 2 books to his credit. Post retirement (from bank), he plans to devote his full time in writing.

 

 

 

 

Kishkindhya by : Dipankar Chowdhury

One thought on “Kishkindhya by : Dipankar Chowdhury

  • March 29, 2022 at 5:45 pm
    Permalink

    Very well woven story.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *