মহিলা দিবসের পর-২ by Arijit Kathanchit

মহিলা দিবসের পর-২

প্রকৃতিরাণী বেশ অভিমানিনী। তাঁর দেওয়া জিনিষকে হেলাফেলা করার ফল তিনি বুঝিয়ে ছাড়েন। যেমন দেখুন, তিনি হাঁটার জন্য পা দিয়েছেন। তবু, মানুষ গাড়ি ইত্যাদি আবিষ্কার করে সোফায় আলু-র (কাউচ পটাটো) মত এলিয়ে পড়তে শুরু করলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তাদের হার্ট, রক্তচাপ আর চিনি’র প্রকোপ বাড়িয়ে এমন বেকায়দায় ফেললেন যে বাবু-বিবি’রা এখন হেঁটে-দৌড়ে-জিমে গিয়ে কূল পাচ্ছেন না। মেয়েরা প্রকৃতির অংশ শুধু নয়, নারী-পুরুষকে প্রকৃতি ও পুরুষ বলে তাদের খোদ প্রকৃতি’র সাথে অঙ্গাঙ্গী করে দেওয়া হয়। তাদের বঞ্চিত করা কি প্রকৃতি সহজে মেনে নেবেন?  

ঠেলতে ঠেলতে মহিলাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধের মত অতি ভয়ানক ঘটনা কামনা করলেও মন থেকে দোষ দেওয়ার জায়গা থাকে না। যেমন ধরুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকায় চাকুরীরতা মেয়েদের অনুপাত ২৫% থেকে বেড়ে ৩৬%-এ পৌঁছয়। ঐ সময়েই জাহাজ তৈরির মত সম্পূর্ণ পুরুষপ্রধান জায়গায় তাঁদের প্রথম কাজ করতে দেওয়া হয়, আর সংখ্যানুপাত ৯% এর ওপরে চলে যায়। খেলার জগতে মেয়েদের অল আমেরিকান গার্লস বেসবল লীগ-ও ঐ সময়েই শুরু হয়েছিল জানলে যুদ্ধকাল যে মেয়েদের নানা ক্ষেত্রে সুযোগের জানলা খুলে দেয় সে নিয়ে আর সন্দেহ থাকে কি?

যুদ্ধ থামলে আবার মেয়েদের ঘরে ঢূকিয়ে দেবার যে চেষ্টা চলে (প্রথম পর্বে এএপিজি প্রসঙ্গে লিখেছি)  তা কিন্তু পুরুষের তুলনায় তাঁদের কাজে অক্ষমতার জন্য নয়। এ ব্যাপারে নানা রকম সমীক্ষা নানা কথা বলে। ২০২০ সালের একটি লেখায় দেখছি ফরচুন ৫০০ বা ১০০০ সাথে ইউরোপ ও আমেরিকার আরও কিছু সংস্থা জুড়ে দেখা গেছে, যে সব কোম্পানি বোর্ডে অন্ততঃ ৩০ শতাংশ মহিলা আছেন তাদের লাভ পুরুষমাত্র-বোর্ড ওয়ালাদের চেয়ে ১৫% শতাংশ বেশি। ক্যাটালিস্ট নামের একটি সংস্থা  ২০০৭ সালে আমেরিকার ৫২০টি কোম্পানীকে বোর্ডে মেয়েদের উপস্থিতির ভিত্তিতে চারটি গ্রুপে (প্রতি গ্রুপে ১৩০) ভাগ করে দেখায় তুলনামূলক ভাবে মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় রকম বেশী লাভেরও কারণ। এসব সমাপতন অতি আকর্ষণীয় বটে, কিন্তু তাদের কারণ আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে। তাই আমরা বরং একটু অন্যদিকে দেখব।

সন্তানজন্মের চাবিটি মেয়েদের হাতে থাকার কথা। বাস্তব অবস্থা হ’ল- কারো হাত থেকে সে চাবির স্বত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কেউ কেউ চাবি হাতে থাকলেও সেটি ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। তার ফলে পৃথিবীময় মানুষের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার বাঙ্‌ময় বৃত্তান্ত নীচের জন্মহারের ম্যাপটিতে। এখনকার চিত্র ২০১৭ সালের  থেকে খুব একটা বদলায় নি। ভারতের আভ্যন্তরীণ ছবিটিও এই ম্যাপটিতে মোটামুটি স্পষ্ট।

ম্যাপটির হালকা সবুজ থেকে নীল (প্রধানতঃ উন্নত, মেয়েরা শিক্ষিত) অংশগুলিতে মেয়েদের সন্তান কম হওয়ায় জনসংকোচন ঘটছে, স্থিতাবস্থা বা বৃদ্ধি হচ্ছে হলুদ থেকে বেগুনী (অনুন্নত বা মেয়েরা অশিক্ষিত বা নিয়মের নিগড়ে বাঁধা) জায়গাগুলিতে। লক্ষ্য করে দেখুন ভারতের অন্তর্বর্তী অবস্থাটিও অনুরূপ। এখানেও মেয়েদের শিক্ষার হার যেখানে বেশী (বিশেষতঃ দক্ষিণ ভারত) সেখানে লোক কমছে। একটু ভাবলে দেখবেন, লোক বাড়ছে যে সব জায়গায়, সেখানে যথেষ্ট খাদ্য আর স্বাস্থ্য’র অভাব। শিশুমৃত্যুর হারও যে সেখানেই বেশী তা চোখে পড়ে, যেটা চোখে পড়ে না তা হ’ল বেড়ে ওঠার সময় যথাযথ চিকিৎসা ও পুষ্টি’র অভাব হওয়ায় সেখানকার শিশুরা বড় হবার পরেও গড়পড়তায় শরীরে-মনে ও কর্মক্ষমতায় পিছিয়ে থাকে, অসুস্থও হয় বেশী।

সোজাসুজি বললে বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের এখনকার সংকট হ’ল, কিছু কিছু জায়গায় দুর্বল, অপুষ্ট অল্পবয়সীদের ভীড়, আর বাকি জায়গাগুলিতে বয়স্কদের আনুপাতিক বৃদ্ধি। অন্যভাবে বললে, প্রধান সংকটটি জনসংখ্যার বৃদ্ধি নয়, সেটি হ’ল কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া, কারণ, শিশুকালের দারিদ্র্য ও অপুষ্টি সারা জীবন ধরে মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ ও উৎপাদনশীলতাকে

ব্যাহত করে, এটি আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।                                                জনসংখ্যাবৃদ্ধি’র সাথে অনেক সময় ধর্মের যোগ খোঁজা হয়। তথ্য কি তা বলে? পাশে   অতি প্রজননশীল আফ্রিকার জন্মহার ও ধর্মপ্রভাবের ম্যাপদু’টি জন্মহারের সাথে ধর্মের কোন যোগাযোগ দেখায় না। ভারতেও সেন্সাসের তথ্য ইঙ্গিত দেয়, কেরলের মুসলমান বা খ্রিস্টানদের চেয়ে গড়পড়তা বিহারী হিন্দু বেশী প্রজননশীল।

কোন মা-ই চান না, তাঁর সন্তান ক্ষুধার্ত থাক। তবু, গরীব দেশে জন্মহার বৃদ্ধি’র কারণটি কি, ভাবতে বসলে মনে হয় মেয়েরা যেখানে অশিক্ষিত ও পরনির্ভর সেখানে জন্ম রোধ করা তাঁদের ক্ষমতার বাইরে। তাঁরা প্রায়-ই প্রজননের যন্ত্রে পরিণত হ’ন। চিকিৎসার অভাব, শিশুমৃত্যু ঐ ব্যবস্থাকে একটি যুক্তি’র আভরণও পরিয়ে দেয়। এই সমস্যার সমাধান আমরা অধুনা দেখেছি বাংলাদেশ, ইরান ও ভারতের কোন কোন অংশে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের স্বাস্থ্য-শিক্ষার উন্নতি ও তার ফল হিসেবে উপার্জনের সুযোগ বাড়লে যে জন্মহার কমে যায় এই দেশগুলি তার সাক্ষী।

জনসংখ্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিশ্ব যখন মশগুল ছিল, তখন প্রায় অগোচরে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হ’ল জনসংকোচন। অবাক ব্যাপার, এটি ঘটছে সম্পন্ন অঞ্চলগুলিতে যেখানে মেয়েরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও শক্তিময়ী। প্রকৃতিদেবী নিশ্চিতভাবে তাঁদের স্ব-ভাবেও মাতৃভাব প্রোথিত করতে ভুলে যান নি।

সমাধানের প্রথম ধাপ হ’ল, কথার অরণ্য থেকে আসল প্রশ্নটি খুঁজে বার করা। এটি করতে গিয়ে অবধারিত ভাবে চলে যেতে হয় পেশার ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থানের দিকে। আমরা দেখতে পাই জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে সন্তানজন্ম মেয়েদের বহির্জগতের যখন দৃশ্যমান উজ্জ্বল কর্মক্ষেত্র থেকে গৃহে সরিয়ে নিয়ে যায়, পেশার ক্ষেত্রে যোগ্যতামাফিক ওপরে ওঠার রাস্তাটিও তখনই অগোচরে বন্ধ হয়ে যায়। এই অবধারিত সত্যটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেয়েরা মাতৃত্বের বদলে কি পেশাকেই বেছে নিচ্ছেন?

শিশুকে জন্ম দেওয়া ও তাকে একজন সমর্থ নাগরিক হিসেবে বড় করে তোলা যে ব্যক্তিগত কিছু নয়, সমাজ ও দেশের কাজ। এই কাজটি করতে গিয়ে মেয়েরা যাতে কর্মক্ষেত্রে তাঁদের উন্নতির স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে পারেন, তথাকথিত উন্নত অঞ্চলগুলির নীতি নির্ধারকদের সে বিষয়ে নজর দিতে হবে অথবা লুপ্ত হয়ে যেতে হবে- অন্য কোন উপায় চোখে পড়ছে না।

একটু হালকা কথা বলি, মেয়েরা সাধারণতঃ অন্তঃসত্বা হবার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ঈষৎ লজ্জিত হয়ে পড়েন। এক ভদ্রমহিলাকে বলতে শুনেছিলাম, পৃথিবীতে নতুন প্রাণ আনতে পারি সে লজ্জার নয়, আনন্দের ব্যাপার। নারী আন্দোলনে ‘আমরা পুরুষের সমান’- যখন শুনি তখন মনে পড়ে, “আমরা প্রায়-ই অন্যের মত হতে গিয়ে নিজেদের হারিয়ে ফেলি” (We often forfeit ourselves trying to be others.)। তাঁদের বলা উচিৎ, আমরা কারও মতো নই- অনন্যা। পুরুষের পথ আমার নয়, আমাদের বিকশিত হবার জন্য পুরুষের মতো নয়, অন্য রকম অধিকার চাই। এদের সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথ পড়ুন-

পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্‌ধে  সে নহি নহি,                                                                   হেলা করি  মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি। (চিত্রাঙ্গদা)

আমি নারী, আমি মহিয়সী,                                                                         আমার সুরে সুর বেঁধেছে জোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী। (মুক্তি)

সারা পৃথিবীতে মেয়েদের গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশী (ইউরোপে এই তফাৎ সাত বছর)। তাঁদের হার্টের রোগ-ও কম হয়। তাঁদের কেরিয়ারের জন্য বিশেষ কিছু করা কি সম্ভব? করতেই হবে, কারণ আর কোন উপায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা কি পাচ্ছেন?

-অরিজিৎ চৌধুরী

 

 

 

তথ্যসূত্র

China’s Communist Party at 100: Where are the women? | Politics News | Al Jazeera

Women on boards and firm performance | SpringerLink

When and Why Diversity Improves Your Board’s Performance (hbr.org)

7 Reasons to Bring More Women on Corporate Boards – The CSR Journal

Fertility Birth Rate Map – Bing

Women of World War II: Women in the Workplace (thoughtco.com)

AAPG Explorer issues of 2018

https://www.catalyst.org/research/women-on-corporate-boards/

https://ec.europa.eu/eurostat/statistics-explained/index.php/Mortality_and_life_expectancy_statistics

https://www.forbes.com/sites/forbeslacouncil/2018/05/21/women-on-boards-why-the-conversation-matters/#765c245b73a5

https://www.oecd-ilibrary.org/docserver/health_glance-2017-7-en.pdf?expires=1551939330&id=id&accname=guest&checksum=6577A1EE2690BB4523FFA6EDB92CD67E

https://www.statista.com/statistics/274514/life-expectancy-in-europe/

https://www.wikigender.org/

 

যে কথাটি রয়ে গেল বলিতে-

নীরবতার সাথে আলাপচারি অসম্ভব না হ’লেও বেশ শক্ত কাজ। লেখাগুলো সকলের পছন্দ হবে এমন নয়। সমালোচনা করতে দ্বিধা করবেন না। রাগ করি না, বরং তথ্য দিয়ে বিরোধিতা করলে, ‘বাঃ আগে এরকম ভাবি নি তো!’ মনে হয়। আর একটা কারণ, আমার ভাবনাগুলো কোনটাই একান্ত নিজস্ব নয়, নানা লেখা পড়ে, কথা শুনে মনে যে ভাবগুলো জেগে ওঠে তার সংকলন। লেখা যখন আমার নয়, সমালোচনা আমার  হতে যাবে কোন দুঃখে।

https://data.worldbank.org/indicator/SP.POP.GROW?locations=BD

About Author

Arijit Chaudhuri, located in Navi Mumbai, petroleum geologist by profession. Also interested in issues concerning pollution, climate change and fast depleting groundwater reserves.Traveling, reading, writing articles, composing rhymes and recitation are his hobbies.

 

মহিলা দিবসের পর-২ by Arijit Kathanchit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *