লেখার সমস্যা : By Debika Saha Chowdhury

সবচেয়ে কঠিন কি জানেন তো?একটা লেখা শুরু করা , আগে ভেবে ফেলা যায় ভেতরের কোন শব্দটার পর কি বসালে বাক্যটা বেশ যুতসই হবে ,কোন ঘটনার মোড়কটা ঠিক কেমন হবে এইসব ,তবে শুরু করাটা আমার পক্ষে বেশ চাপের মানে আমার আবার ব্যাকরণে ব্যাকরণ সিং ইত্যাদি…যাকগে শুরু তো হয়ে গেল এদ্দুর পড়েও ফেললেন জনাকয়েক, এবার আসি আসল কথায় … আজ একটা ভালোবাসার গল্প শোনাবো , না না নিজের নয় অন্যেরই তবে একটা আলোজ্বলা প্রেমের গল্প …
বছরের দুটো সময় আমাদের বড় প্রিয় এক এই উৎসবের মরসুম আর এক পাতা ঝরার মরসুম , এই সময় সবার ভেতরেই একটা নরম আলো জ্বলে থাকে ,বাইরের রোদেলা দিনের মত ভেতরটা অকারণেই ঝলমলে থাকে আবার যদি খুব ভুল না করি আমারই মত অনেকেরও হয়ত এই সময়টাতেই বেশি বিষাদ ঘনিয়ে আসে ইচ্ছেখুশির কল্পনারা দুঃখবিলাসী হতে চায় ,হয়ত হয় বা হয় না !
ধরা যাক ছেলেটা থাকতো আমাদেরই আশেপাশে মেয়েটা কোথায় থাকত জানিনা , আমি বেশ ছোট তখন ,বেশ তিড়িংবিড়িং মেয়েবেলা , বন্ধু বেশি ছেলে ,পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাও আবার মারপিটও , দাদা আর দাদার বন্ধুরা হুলিয়ে গাট্টা মেরে যায় রামগাট্টা শ্যামগাট্টা আরো কি কি সব ,তখনও অতটা মেয়ে হয়ে উঠিনি ,তখনও মার্চমাসের ধূলোওড়া বিকেল মানে সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা বুক ঢিপঢিপ “ঠাকুর অঙ্কে অন্তত চল্লিশ যেন পাই ” তখনো পাড়ায় ফাংশান আমি নাচব মানে আমি বিরাট হনু , তুলনায় ছোটোদের গ্রুপের ঝামেলা মেটাই আমার প্রিয় প্যাঙলা স্যাঙাতের হয়ে তার বন্ধুকেই ঠেঙিয়ে আসি ইত্যাদি….
সেই আলোজ্বলা ভালোবাসাকে প্রথম দেখি ওই সময়টায় কোন রাঙতাবিকেলে ,মেয়েটা ছেলেটা পাশাপাশি টুকটাক কথা চালাচালি করতে করতে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে , ছেলেটির বাড়িরদিকে, ওইসময় ছেলে বন্ধুর বাড়িতে মেয়ে যাওয়া বা উল্টোটা তাও আমাদের মত মধ্যবিত্ত পাড়ায় এক বিরাট ব্যাপার এবং তা প্রায় অপরাধের পর্যায়ও ফেলে দিত কোন কোন কাকিমা মাসিমারা , তবে ওই হেঁটে আসাটুকুই আর ফিরে যাওয়াটুকু তার মধ্যেকার কিছু জানা নেই , জানতেও চাইনি তখন ,কেনই বা চাইব আমার তো শুধু ওদের ওই পাশাপাশি হেঁটে যাওয়াটা আর দুজনের আলতো হাসিটুকু দেখতেই সবচেয়ে ভালো লাগত , আর অমন মেয়ে আমি আর দেখিনি ,তারা দুজনেই আমার থেকে বয়সে বড় এবং পরিবারটি অন্যদের থেকে খানিক সম্ভ্রান্ত অতএব এর বেশি ভাবনাতেও আসেনি !

আমাদের সবার তখন বাংলা মিডিয়াম , তেল চুপচুপে চুল , মাঠেঘাটে দৌড়ে বেড়ানো রুক্ষ হাত পা , কলের পাইপের মত সরু কবজিতে লাল সুতোর বিপত্তারিণী , ধুলোমাখা হাওয়াই চটি , সস্তার সুতীজামা বা খুব বেশি হলে স্কার্ট , বছরে একবার মা পাড়ায় নতুন গজিয়ে ওঠা পার্লারে নিয়ে গিয়ে ববছাঁট দিয়ে নিয়ে আসে ,নাহলে বড় চুলে ইশকুল থেকে মাথায় উকুন বাসা বাঁধবে ইত্যাদি ঘ্যানঘ্যানে টোটাল আনইম্প্রেসিভ জীবনে আমার দেখা ওই পুতুল পুতুল মেয়েটি ছিল মায়াকাজল ! এত মানাত দুজনকে পাশাপাশি , ওদের দেখতে গিয়ে কতবার আউট হয়ে বন্ধুদের গালিগালাজ খেয়েছি ! তবু বিকেল হলেই উশখুশ করতাম কখন আসবে তারা , রোজ যে আসত তা নয় তবে প্রায়ই আসত , আমার এক ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বন্ধুর থেকে ওদের সম্পর্কে গল্প শুনেছিলাম ,ওরা একসঙ্গে পড়ত , দুজন দুজনকে চোখে হারাত আরো কত কী , তখন চন্দ্রবিন্দু শুনিনি তবু কেন জানা নেই প্রতিবার “বন্ধু তোমায় ” শুনলে ওদের দুজনের হেঁটে আসাটুকুই দেখতে পাই !
তারপর কালের নিয়মে বড় হয়ে যাই , ছেলেটিও অন্যত্র চলে যায় এবং এক অন্যরকম জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে , মেয়েটিকে আর দেখতে পাইনা , খবর পাইনা , বন্ধুর কাছে শুনি ওরা ভালোই আছে , ক্রমশ ফিকে হয়ে যায় সব, হাত ছেড়ে যায় সময়, হাত ছেড়ে যায় বন্ধুদল , অন্যবৃত্ত তৈরী হয় ,শিকড় উপড়ে অন্য কোথাও থিতু হয় ,বুকের ভেতর বিকেলের ধূলোমাঠ গুমরে গুমরে ওঠে , আমাদের ফেরা হয় না ,আমাদের দেখা হয় অন্য কোথাও আলগা হাতের চাপে ,ছুঁড়ে দেওয়া বানানো হাসি বলে দেয় আমাদের খেলতে যাওয়া নেই , আমাদের ঝগড়া মারপিট নেই , আমাদের ভাগ করে খাওয়া হজমিগুলি নেই ,আর জানতে পারি ওই আদুরে ছেলেমেয়েটিরও ভালোবাসাবাসি নেই , মেয়েটি নাকী বড্ড পজেসিভ ,কেবলই আঁকড়ে ধরে রাখত , ছেলেটির দমবন্ধ লাগত …. আমি মেলাতে পারিনি মেয়েটির সাথে , অমন পরীমতন কেবল ডানাটাই কখনো পিঠে পরেনি তবে জানতাম ঠিক আছে লুকোনো, সে কক্ষোনো এমন করতেই পারে না …বহুদিন পর ছেলেটিকে ফেসবুকে দেখলাম অন্য একজন তার ঘরণী ! আমি আতিপাতি করে খুঁজে পেলাম সেই পরীমেয়েকে …আমার সব ভাবনাটুকু সত্যি করে দেখলাম সেই বিষাদপ্রতিমা যে এখনো থিতু হয়নি হতে পারবেও না হয়ত ,কেন মনে হল সেই আঁকড়ে থাকাটুকুই আসলে তার জীবন ছিল , হাতেরমুঠো আলগা করেছে ঠিকই তবে রাশ টানতে পারেনি ভালবাসার আমি তার ছবি দেখছি একজায়গায় নাচের মুদ্রায় চোখ বন্ধ , জানি বন্ধ চোখ সে খুলতে চায় না ,ওইসময়টুকতে সে ছেলেটির পাশাপাশি মাথা নীচু করে হেঁটে যায় আর আলতো তাকিয়ে থাকে !

এই লেখাটুকু লিখতে লিখতে ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে আসে , গাছেরছায়া দীর্ঘ হতে হতে যখন মিলিয়ে যায় আর পরীক্ষা পরীক্ষা হাওয়া দেয়, ঠিক তখনকার মনখারাপের সাথে এক আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই !
মাটির প্রতিমা জলে বিলীন হলে শুন্য দেউলে যে একলা প্রদীপ জ্বলে থাকে তার কষ্টের আলোতে তৈরী হয় বিষাদপ্রতিমার মুখ… বিজয়া ঘনিয়ে আসে!

 

About the author :


নামখানি গ্রাম্ভারী হলেও স্বভাবখানি জলবৎ। নব্বই দশকের নস্টালজিকতার মৌরুসিপাট্টা নেওয়া আছে। লেখালেখির ব্যাপারে তো বটেই জীবনের হিসেবের বেলাতেও অত্যন্ত কুঁড়ে। আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া কুকুর ছানা বড় করতে শেখায় নিজের ছেলেকে। সমবায় ভিত্তিতে একটি ক্যাফেটেরিয়ার আধা মালকিন। আপাদমস্তক একজন অপেশাদার বাঙালি।

লেখার সমস্যা : By Debika Saha Chowdhury

One thought on “লেখার সমস্যা : By Debika Saha Chowdhury

  • April 9, 2022 at 2:06 pm
    Permalink

    আলতো ছোঁয়া, হালকা‌ চাল, ব্যঞ্জনা অতি গভীর। খুব..খুব ভালো‌ লেখা

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *