Arijit Chaudhuri

অরিজিৎ কথঞ্চিৎ/ অরিজিতের কলম

নাস্তিকের পুজো

লোভ যে হয় ভারী, ঘরে থাকতে নারি:  পুজো, বিশেষতঃ বাঙ্গালীর দুর্গাপুজো আর সরস্বতীপুজো এমন মন কাড়া ব্যাপার যে তা থেকে দূরে থাকা মুশকিল। গোঁড়া নাস্তিক যাঁরা তা করতে বাধ্য হ’ন তাঁদের মধ্যেও একটা আত্মবঞ্চনার অনুভূতি চাগিয়ে ওঠে। দু’তিনদিন ‘কেন এসব করছি? কী নিয়ে এসেছি, কী নিয়েই বা যাবো’ এসব উচ্চমার্গী চিন্তা’র সাথে ভোগের খিচুড়ির মন মাতানো গন্ধের দ্বন্দ্ব চেপে ধরে। আর একটা মুশকিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার উল্টো রকম –‘যেতে পারি কিন্তু কোথায় যাবো?’ যাদের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে তারা সবাই তো পুজোমণ্ডপে। অবস্থাটা অনেকটা এই স্বাস্থ্যপ্রেমীদের মত-

 

সকাল সকাল ওঠো প্রিয়, শীঘ্র নিদ্রা যাও,

একটিও কি ভালো লোকের দেখা তুমি পাও?

(‘Early to bed, early to rise and you don’t get to see our best people’)

একটা পুরনো প্রবচন আছে, ‘কানু (কৃষ্ণ) বিনা গীত নাই’। যত কাঠ-নাস্তিক হোন না কেন, কৃষ্ণবাবুর রোমিওগিরি, কুরুক্ষেত্রে একপক্ষে নিজে, অন্যপক্ষে নিজের সৈন্য দিয়ে যুদ্ধবাজী করে বহু সাধারণ সৈন্যের মৃত্যুর কারণ ঘটানো, আবার সেখানে বসেই গীতার উপদেশ দেওয়া-র বৈপরীত্য যত-ই না-পসন্দ হোক, মার্গসঙ্গীত শিখতে গেলে এমন কি ভরতনাট্যম বা ওড়িশি একটু ঠুকরে দেখতে গেলেও “কৃষ্ণপ্রেম-আস্বাদন তপ্ত ইক্ষু চর্বণ, জিব জ্বলে না যায় ত্যজন”-এর অবস্থানে না গিয়ে উপায় থাকে না।

কানু বিনা গীত নাই-এর গল্প বিদেশেও। শুধু কানু’র নাম আর চেহারা পালটে যায়। যে সব জায়গায় চার্চে মানুষ যেতেই চায় না, সেখানেই বড়দিনে ঘর আর পাড়া সাজানো নিয়ে হুড়োহুড়ি। এখানে যেমন রামলীলা দেখার লোকের অভাব হয় না, তেমন ওখানেও বড়দিনের আগে যীশুর জন্ম নিয়ে অতি প্রাচীন নাটক দেখতে নাস্তিক-ধার্মিক নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় জমায়। মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা নাস্তিক তাঁরাও ইফতারের ভোজ বা ঈদের বিরিয়ানি থেকে দূরে থাকতে পারেন বলে মনে হয় না।

অভিমানী কিসের ঘোরে, বঞ্চিত করে আপনারে : সংখ্যালঘুরা একটু বেশী অভিমানী হ’ন। আর নাস্তিকরা ক্রনিক সংখ্যালঘু। শুধু তাই নয়, তাঁদের ওপরে সবার নজর থাকে। তাঁরা সুস্বাদু খাদ্যের খোঁজে পুজোর আশপাশে গেলেই আড়চোখে দেখে নিন্দুকরা প্রায় শুনিয়েই বলতে থাকে, ‘ওগো দ্যাকো, লুকিয়ে পুজো করতে এয়েচে।‘ বেচারী নাস্তিক রোল-এর দোকান থেকে ভগ্নহৃদয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হ’ন। অনেক আগে আজকাল পত্রিকায় এক নাস্তিক মুসলমানের সমস্যা নিয়ে একটি চিঠি ছাপা হয়। পত্রলেখক বলেন, মুসলমানরা আমাকে ঘৃণা করে, আর আমিও যে নাস্তিক হতে পারি, হিন্দুরা এ কথা বিশ্বাস করে না। আমারও অভিজ্ঞতাও শুনুন, রবিবার কম পরিশ্রমে ভোজনাধিক্য হয় বলে পেটকে আরাম দিতে আমি সোমবার-এর সকাল আর দুপুরের খাওয়া বাদ দিতে শুরু করি, উপকারও হল। একবার এক বন্ধুগৃহে সেই কথা ওঠায়  বন্ধুপত্নীর চোখে চোর ধরা লন্ঠনের আলো জ্বলে উঠল। তিনি জানালেন, আমার ভালো হচ্ছে পেটের বিশ্রামের জন্য নয়, শিবের আশীর্বাদে।

তা হ’লে উপায়:  নবী মুম্বই-এ আমাদের হাউসিং সোসাইটিতে এবার গণেশপুজো করা হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেক্রেটারি (যিনি গণেশের মন বোঝেন) বললেন, পাঁচ বছর করার পর না করলেও চলে যায়। মতটা আমার খারাপ লাগে নি। কিন্তু, আর একজন বললেন পুজো তো শুধু আরাধনা নয়, এ সব অনুষ্ঠান সবাই এক সাথে হবার, গল্প করার একটা সুযোগ। যথারীতি আমার সর্বদা দ্বিধা থরথর চিত্তে এই উল্টো কথাটাও বেশ ভাল লাগল।

হয়তো গণেশের কৃপাতেই অন্তর্দৃষ্টি ঝলসে উঠলো যেন। চেনা পুজোর নানা মুখ ফুটে উঠলো। পরিষ্কার দেখলাম পুজো শুধু ভক্তদের নয় আরাধনায় রুচিহীন অভক্তদেরও। সত্যি বলতে দুর্গাপুজোর বেশীর ভাগটাই ধর্মের আওতার বাইরে। উদাহরণ- মূর্তি থেকে প্যান্ডেলের শিল্পমেলা, সন্ধ্যের অনুষ্ঠানগুলোতে পারফরমিং আর্টের আসর আর তাকে ঘিরে খাদ্যমেলা আর বাঙ্গালীর মেলামশার যে সময়অচেতন স্টাইলকে ইদানীং ভিনপ্রদেশীরা হিংসে করতে শুরু করেছে- সেই আড্ডা (যাতে  প্রায়-ই মা দুর্গা’র নাকের নীচে বসে ‘ওঁর পুজো করে কি হবে?’ আলোচনা হয়)।

মীন কেন হীন হয়ে থাকো সরোবরে: অনেকদূর ভেবে ভেবেও নাস্তিকদের পুজো,বড়দিন বা ঈদ থেকে দূরে থাকার কোন গভীর কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। বাজেট হিসেবে খুব সামান্য অংশ পুজোতে খরচ হয়, বেশীর ভাগটাই যায় খাদ্য, আর শিল্পকলার নানা দিকে। যেভাবে সেটা ঘটে তুলনা আর নাই। কিছু পয়সা আরাধনায় খরচ হচ্ছে বলে সে সব আনন্দ থেকে নিজেকে সরানো-অন্য ভালো তুলনা পেলাম না মাপ করবেন- চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মত অর্থহীন আত্মনিপীড়ন। তাছাড়া পরমার্থ-র দিকে তো নাস্তিকরা বঞ্চিত হবেনই। নাচ-গান করা, রোল-বিরিয়ানি-ভোগের খিচুড়ি উপভোগ তাঁদের এই জীবনেই শেষ। উঁচুস্তরের ভক্তরা স্বর্গে রম্ভা-উর্বশীর নাচ দেখবেন, পেটখারাপের শংকামুক্ত হয়ে যদৃচ্ছা ভোজন করবেন- পুরুষদের অপ্সরা, মহিলাদের কিন্নরকুলের সাথে যুগ্ম নৃত্যর সুযোগও যে মিলবে না তা হলফ করে কেই বা বলতে পারে? নীচুদরের ভক্তরা পুনর্জন্ম নিয়ে বেঁচে থাকার সুখ ভোগ করবেন আবার (সেটাই বা মন্দ কি?)।

আমার তো মনে হয় পুজোপার্বণে নাস্তিকদের আগে খাইয়ে দেওয়া, রোল-বিরিয়ানি-চপকাটলেটের স্টলে বিশেষ ডিসকাউন্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসতে দেওয়া, গান গাইতে না জানলেও ‘করুক না ক্ষতি কি’ ভিত্তিতে গাইতে দেওয়া ইত্যাদির ব্যাপারে ভক্তদের-ই উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। তা যদি তারা না করে তবে ‘হে নাস্তিক, ওঠো, জাগো, প্রতিটি পুজোয় নিজেদের অধিকার আদায় করে ছাড়ো।‘ আর একটি ছোট কথা-

অঞ্জলি না-ই বা দিলে, পুজোয় চাঁদাটি দিয়ো ভাই

হাড়-কিপটে’র চেয়েও খারাপ গালি বেশী নাই।।

 

Arijit Chaudhuri

3 thoughts on “Arijit Chaudhuri

  • Pingback:Druga Puja – Ganga Zuari Academy

  • October 1, 2021 at 4:29 pm
    Permalink

    Bejay anando pelam rommo-rochona ti pore.

    Erokom asanti amaro hoi- alochanar somoy dui sider argument sune mone hoi dui pokkhoi to thik bolche. Tarpore ami jakhon bolte suru kori boka khai-‘etokhhyon ki korchilen apni? Ei point gulo to aage bola uchit chhilo’
    Ki mushkil, bolun to??
    Manush mone hoi sapne thakte valobase, “Aachi, athocho nei” anekta ‘jete to pari kintu jabo kothaye?’.

    Lekhak ke anek ohannyobad..

    Reply
  • November 9, 2021 at 12:33 pm
    Permalink

    ভাল লিখ্ন্যবাদ, ধন্যবাদ। নাস্তিকের পুজোর ধারণাটা মাথায় বহুদিন ঘুর ঘুর করলেওলেখা হয় নি। লোকে কি ভাবে নেবে সেই ভয়ও ছিল। ছাপানোর পর দেখছি, বেশীর ভাগ-ই পড়ে খুশি।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *