Kuntala Bhattacharya

ঋতুবদলে মনবদল হয়। ঘন ময়লামেঘ সরে গিয়ে শরতের আকাশ হয়ে যায় আর্জেন্টিনা। নীল আকাশে সাদা মেঘ-উড়ান, আহা! ঠিক যেন নীলরঙা পানীয়তে সাদা বরফকুচি। পানীয় পান করতে আয়েশ রাখতে হয়। ঢকঢক ঢেলে নেওয়া কোনো কম্মের না। শরতের শরবৎ জিভে দিতে হয় রয়ে সয়ে,অল্প অল্প করে। জিভ আর জীবন তো যমজ বাচ্চা, কে না জানে! পিচ্ছিল মিউকাস পর্দায় ঢাকা, পর্দায় বুটিবুটি হাজার হাজার স্বাদকোরক। জমিনজীবনের জামদানি জিভ। টক ঝাল নোনতা মিষ্টি যা খাবে খাও। আমরা খাই। খেতেই হয়। বিজ্ঞাপন আজ্ঞা মাথায় রেখে আমরা খেয়ে যাই। ‘কেনাকাটায় বিশেষ ছাড়’, পুজো পরিক্রমা, হালফ্যাশন, জুতোর দোকান, দর্জির দরবার এসব আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়,পুজোয় কোনটা করা উচিত! বিজ্ঞাপনের নৈতিকতা গ্লানি এনে দিতে পারে,যদি বিশেষ থিমের পুজোপ্যান্ডেলটি দেখা না হয়। অষ্টমীর অঞ্জলী যদি ঘিচা শাড়ি দিয়ে দিতে নাই পারলাম তাহলে এ জীবন বৃথা। ম্যাডক স্কয়ারে আড্ডা না দিলে সমাজ একঘরে করে দেবে। এসব নৈতিক অনুজ্ঞা বাক্য মনে রেখে, ঠিক ঠিক বিচার করে হতে থাকে প্রাক্ পুজোর কেনাকাটা। হবে না কেন? এ তো শাস্ত্রবিহিত। শাস্ত্রে আছে, হে দেবী, তুমি মহিষাসুরমর্দিনী, অসুরের অসুখ থেকে আমাদের তুমি বাঁচিয়ে দিয়েছ,তুমি সুখদায়িনী, তোমাকে প্রণাম– ‘ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’।
… রূপসাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় কুপোকাত। মহামারীর ফেনিল ঢেউ এগিয়ে আসছে ফণা তুলে। তা নির্বিষ করার শক্তি দাও মা! জয়ী করো। ‘দ্বিষো জহি’ — শত্রু নাশ করে দাও গো, শত্রুনাশিনী মা! তাবড় তাবড় রাষ্ট্র নেতাদের আকচা-আকচি আমরা বুঝি না। অগ্রজ কবি চাঁদকে ঝলসানো রুটি ব’লে চিনিয়েছে। ঐ রুটি এখন আঁকশি দিয়ে পেরে আনতে ছুটছি। পারতে গিয়ে মরছি। ছিন্নভিন্ন হচ্ছি। রুটির গায়ে ছিটকে লাগে রক্তদাগ। ডিটারজেন্টের ক্ষমতা নেই সে দাগ ওঠায়। ছোপ দাগ জড়িয়েই আবার চলছি। কেই বা আমাদের দাগ ক্ষত দেখছে? আমাদের নাম নেই, নম্বর আছে, যশ নেই- জোশ আছে। ‘জনসাধারণ’ গালভরা এই সমষ্টিতলায় মুরুব্বি প্রধান যা বলে,’জো হুজুর,জো হুকুম’ করে বসে থাকি। আমাদের নাম যশ দাও, মা গো! আগমনী আলো মা আমাদের, এবার উৎসবের আয়োজন থেকে সরিয়ে নাও। বাপেরবাড়ি আসা সেই স্নেহকন্যার আরোপ থেকে নিজেকে বের করে দেখাও তোমার আসল সংহারী সংগ্রামী রূপ … স্বামীসোহাগী মেয়ে বরের সঙ্গে ঝামেলা করে বাপের বাড়ি আসা মেয়ে তুমি নও। ওসব ঠুনকো অভিমানিনী মেয়ে করে তোমায় বরণ করার চল একপ্রকার পুরুষালি ভণ্ডামি। এযুগের বা একটু আগের পুরুষের কামনায় অসুরদলনী দেবী হয়ে যায় ঘরোয়া আটপৌরে মেয়ে বৌ। এসব তুচ্ছ একপেশে রীতির নিকুচি করে দাও। বৃষোৎমুণ্ডু মহিষাসুরের মাথায় ঢোকে নি, দেবনর গন্ধর্বযক্ষ অসুরদানব ছাড়াও ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ থেকে কেউ তাকে মেরে ফেলতে পারে। নারীকে উপেক্ষা, অবহেলা, ধর্তব্যের মধ্যেই না ধরার ভুলটাই মহিষাসুরের বিনাশ করাল। দানবদলনী মা! এযুগের মহিষাসুর-মস্তিষ্কগুলো ধ্বংস করার ভার দাও আমাদের। আঁজলায় তুলে দাও আঁশবটি। ঘচাং ঘচাং করে কেটে নিই কুমাথাগুলো,কুপ্রথাগুলো।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আগে যে বললাম, শরবৎ পানে ধৈর্য্য ধরতে হয়। আমরা ধৈর্য্য রাখছি। আশ্চর্য ধৈর্য্য আমাদের। সবুরের ফলাফল মিষ্টি হয়। একটু একটু মিঠে স্বাদ পাচ্ছি জিভে। মিষ্টি মুখ করার রীতিতে বাধা নেই। প্রত্যেকের পূজো সুন্দর হোক। ‘স্তবের বানী আড়াল টানি’ মার্কা পূজো পাল্টে রূপকল্পনার দেবী প্রতিষ্ঠিত হোক প্রতিটি রক্তমাংসমানসী নারীর মধ্যে। বলা ভালো নারী পুরুষ সবার চোখে পড়ুক ‘অরুণ আলোর অঞ্জলী’। অভ্যন্তরং শুচি’তে বোধন হোক আমাদের অন্তর্চক্ষুর।

Kuntala Bhattacharya

5 thoughts on “Kuntala Bhattacharya

  • Pingback:Druga Puja 2021 – Ganga Zuari Academy

  • October 1, 2021 at 4:55 pm
    Permalink

    Wonderful. What a depth in language and intense thought. Sibram-Sanjib-Tarapada ke mone poriye dilo. Tookhoor. Anek dhannyobad janben. Namaskar.

    Reply
    • October 26, 2021 at 10:36 am
      Permalink

      Onek onek dhonyobad

      Reply
  • November 9, 2021 at 12:44 pm
    Permalink

    khub bhaalo lekha.

    Reply
  • January 3, 2022 at 5:31 pm
    Permalink

    হাল্কা চালের লেখার মধ্যে গভীর তা‌ৎপরয আছে।
    লেখা নয়তো যেন খরস্রোতা নদী হুঁ হুঁ করে মোহোনারদিকে টেনে নিয়ে গেল!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *