By Subir Kumar Roy, Age 60 +

জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে বিবাহ সহায়ক না প্রতিবন্ধক, এই প্রশ্নটা বড় আপেক্ষিক। চিনি মিষ্টি না টক-এর মতো, এক্ষেত্রে হাত তুলে এক কথায় ‘মিষ্টি’ উত্তর দেওয়ার অবকাশ প্রায় শুন্য। পরিসংখ্যান ঘেঁটেও এই তথ্য উদ্ধার করা দুরূহ, কারণ স্বামী বা স্ত্রীর সাহচর্য ও অনুপ্রেরণায় অপরজন তাঁর নিজ ক্ষেত্রে চলার পথে শীর্ষে আরোহন করেছেন এই ঘটনা যেমন শোনা বা দেখা যায়, আবার অপরজনের অসহযোগিতায়, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে বিবাহের পরে স্বামী বা তাঁর পরিবারের অসহযোগিতা ও বাধাদানে কতো প্রতিভা যে কুঁড়িতেই বিনষ্ট হয়েছে, তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর একবারে সাধারণ মানুষের বৈবাহিক জীবনে পরিপূর্ণতা বা তার বিকাশ ঘটার সুযোগ বড়ই সীমিত। সাংসারিক চাপে তাঁদের জীবনটা থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের মতো কাটতে কাটতে একদিন শেষ হয়ে যায়। তবু তাঁদের বৈবাহিক জীবন অনেক সুখের, সংসার ও পুত্র কন্যা নিয়ে তাঁদের জীবন পরিপূর্ণ। অপর দিকে যদিও শোনা যায়, প্রতিটা উন্নতির পিছনে একজন মহিলার ভূমিকা অসীম, কিন্তু স্বামী বা স্ত্রীর উন্নতি বা নিজ ক্ষেত্রে পূর্ণতা বিকাশের পিছনে তাঁর পাশের অত্যন্ত কাছের মানুষটির ভূমিকা জানা না গেলেও, উন্নতি ও পরিচিতির পরবর্তী অবস্থাটা অনেক ক্ষেত্রেই সুখকর হয় না। নামীদামি স্ত্রী পুরুষের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ সমাজের বুকে যাঁরা সেলিব্রিটি তকমাধারী, তাঁদের কিন্তু একটু নামডাক হলেই অপরকে পরিত্যাগ করে অন্য কোন নারী বা পুরুষের সাথে পরম সুখে বসবাস করতে আকচার লক্ষ্য করা যায়। সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এর সংখ্যা প্রচুর। আসলে বিবাহ পূর্ণতা বিকাশের সহায়ক না প্রতিবন্ধক, এটা স্বামী স্ত্রীর সহনশীলতা ও মানসিকতার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তবু বলবো বিবাহিত মানুষরা যেহেতু একটা নিয়মিত রুটিনের মতো জীবন যাপন করেন এবং সর্বক্ষণ পাশে একজন আপনার লোকের সাহায্য পেয়ে থাকেন, তাই বিবাহ জীবনের পূর্ণতা আহরণের পথে অবশ্যই সহায়ক। অনেক সাধ অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজেদের বিবাহিত জীবনটা সুন্দর হওয়ার কামনা নিয়ে মানুষ বিবাহের স্বপ্ন দেখে থাকে, কিন্তু ওই কাঙ্ক্ষিত সুদীর্ঘ চলার পথটি কিন্তু মাখনের মতো মোলায়েম ও মসৃণ নয়। নিজ স্বার্থ পরিত্যাগ করে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা সহযোগিতা সম্মান ও ভালবাসা দিয়ে একসাথে পথ চলতে পারলে, এবং চলার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো সুষ্ঠুভাবে অতিক্রম করতে পারলে বিবাহের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

জন্ম থেকে মৃত্যু, প্রকারভেদ হলেও, প্রাণীকূলের প্রতিটা জীবের মধ্যেই একটা জীবনচক্র কাজ করে। জন্ম, ধীরে ধীরে বড় হওয়া, খাদ্য সংগ্রহ, শত্রু ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা, নিজ নিজ প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা, সন্তানকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা, ও অবশেষে মৃত্যু।

মানবকূলও এই প্রাণী জগতেরই অন্তর্গত, কাজেই তাদের জীবনচক্রও একই ধারায় বহে, তবে সুষ্ঠুভাবে জীবন ধারণ করার জন্য প্রাকৃতিক নিয়ম ছাড়াও, নিজেদের সৃষ্ট কিছু আইন ও সামাজিক নিয়মের বাঁধনে তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

আর পাঁচটা প্রাণীর মতো মানুষও তাদের জৈবিক চাহিদা মেটাতে নারী পুরুষ মিলিত হয়, সন্তান উৎপাদন করে। তবে দেশ কাল জাতি ধর্ম বা সমাজের নিজস্ব প্রথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন শৃঙ্খলের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। আর এই বিশেষ অধ্যায়টির জন্যই বিবাহ নামক আইনের বাঁধনের জন্ম ও প্রয়োজন। তা নাহলে নিজ নিজ অধিকার, একে অপরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, দায়িত্ব ও কর্তব্য, অধিক শক্তিশালী প্রভাবশালী ও বিত্তবান মানুষের হাত থেকে পরিবারকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়তো। আর এখান থেকেই এক অন্য ধরনের অশান্তির শুরু, কারণ এই বিবাহের সুফল যেমন আছে, সুফল গ্রহণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও আছে।

বিবাহের পর কিছুদিন, হয়তো বা বেশ কিছুদিন পর অনেক দম্পতির মধ্যেই মন কষাকষি ও অশান্তি শুরু হয়। নিজের স্ত্রী বা স্বামীর থেকে, অপর কোন মহিলা বা পুরুষের প্রতি আসক্তি ও ভালবাসা একটা কারণ হলেও, ইচ্ছা থাকলেও বৈবাহিক বাঁধন, সামাজিক ও পারিবারিক লজ্জা সম্মান ইত্যাদি কারণে, এর সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। মূলত অশান্তি ও গোলমালটা দেখা দেয় ভিন্ন কিছু কারণে, যেমন অহংবোধ, একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও সম্মানের অভাব, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হাস্যকর প্রচেষ্টায়, একে অপরকে নিজের অযোগ্য বিবেচনা করা, ও অকারণে অপরের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত সন্দেহ করা।

বিবাহ করার থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক ঝামেলা ও লজ্জার কাজ হিসাবে বিবেচিত হওয়ায়, এই অবস্থায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী স্ত্রী সারাটা জীবন অশান্তি ও মনঃকষ্ট নিয়ে এক ছাদের তলায় বাস করতে বাধ্য হয়।

আমি অতি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, চিকিৎসা বিজ্ঞানও আমার জানা নেই, তবু এই ব্যাপারে বিধিনিষেধ সৃষ্টিকারী কিছু অসাধারণ মানুষের সৃষ্ট নিয়ম শৃঙ্খলার যুক্তি ও তাৎপর্য আজও আমার কাছে অধরাই রয়ে গেছে। ভাই বোন, বা একই পরিবারের নরনারীর মধ্যে বিবাহ শারীরিক দিক থেকে ক্ষতিকারক হতেই পারে, কিন্তু এই বাধানিষেধের মধ্যে গোত্র কোন যুক্তিতে স্থান পায় বুঝি না, কারণ একই গোত্রের নরনারীর মধ্যে বিবাহ নাকি অবৈধ।

‘ক’ বাবুর গোত্র কাশ্যপ, তাঁর স্ত্রী ‘অ’ দেবীর গোত্র শাণ্ডিল্য। তাঁদের পুত্র,’খ’ বাবু, ও কন্যা, ‘আ’ দেবীর গোত্র নাহয় কাশ্যপ, এবং তাঁদের পুত্র ও কন্যার বিবাহ যথাক্রমে, ভরদ্বাজ ও বাৎস্য গোত্রের সাথে হলো মেনে নেওয়া গেলো, কিন্তু ‘খ’ বাবুর পুত্র কন্যার কাশ্যপ গোত্র ছাড়া দুনিয়ার যেকোন গোত্রে, এবং ‘আ’ দেবীর পুত্র কন্যার বাৎস্য গোত্র ছাড়া যেকোন গোত্রে বিবাহ দেওয়া যায় কোন যুক্তিতে? তাহলে কী নরনারীর শরীরে পিতার ঔরস ও রক্ত ছাড়া মাতার রক্তের কোন ভূমিকাই নেই? আবার অন্যান্য সকল বিষয়ের আইনের ফাঁকের মতো বিবাহের ব্যাপারেও আইনের ফাঁক রাখা হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী এক গোত্রে বিবাহ যদি পরের প্রজন্মের মানুষের শারীরিক কোন ক্ষতি সাধন করে, তাহলে পিতার গোত্রের লোভনীয় পাত্র পাওয়া গেলে, সেই পাত্রকে হাতছাড়া না করে অন্য কোন গোত্রের কেউ সেই কন্যাকে দত্তক নিয়ে নিলে ওই কন্যার তার পিতার গোত্রের পাত্রকে কোন ক্ষতি ছাড়াই স্বছন্দে বিবাহ করতে পারে। তাহলে কী চিকিৎসা বিজ্ঞান মিথ্যা? কি জানি, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এইসব গূঢ় তত্ত্বের সুলুক সন্ধান করা অসম্ভব।

পরিশেষে একথা স্বীকার করতেই হবে, যে প্রাকৃতিক ও শারীরিক নিয়মে নিজের জৈবিক চাহিদা মেটাতে, ও বংশ রক্ষার তাগিদে দুজন নারী পুরুষকে একসাথে একে অপরকে নিজের পরিপূরক হিসাবে বিবেচিত করে পাশাপাশি থাকতেই হবে। আর মানুষ যেহেতু একটি সামাজিক জীব, তাই সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলাকে যাথার্থ্য মান্যতা দিয়ে বিবাহেরও প্রয়োজন আছেই। আমার তো তাই মনে হয়।

সুবীর কুমার রায়

By Subir Kumar Roy, Age 60 +

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *