Clock Tower by Dipankar Choudhuri


।। ঘন্টাঘরঃ বৃটিশ ভারতের টাইম-পলিটিক্স তথা খবর্দারি ! ।।

।।১।।

বৃটিশ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম তখন রাশিয়ায় গেছেন ভাইয়ের কাছে।
১৭৮৬-৮৭ খৃ. নাগাদ তখন বয়সটা তাাঁর বছর চল্লিশেক হবে । মরালস
এণ্ড লেজিসলেশনের উপর ক্লাসিকখানি লিখে তখনই খ্যাতির তুঙ্গে
তিনি। ভাই স্যামুয়েল বেন্থামের রাশিয়াতে চাকুরি ছিল এক দেশীয় রাজ্যের
‘শিল্পমন্ত্রী’ হিসেবে; রুশসাম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন-দ্য-গ্রেটের প্রিয়পাত্র!
সেই সময় সময়টায় শহর কলিকাতায় তখন সবে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র
প্রতিষ্ঠা হয়েছে; রামমোহনের বয়স চৌদ্দ, সদ্য পাটনা থেকে ফার্সী
শিখে ফিরেছেন।

রাশিয়াতেই ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ও সেখানকার কারা-ব্যবস্থা
পরিদর্শন করে, জেরেমি বেন্থাম এক গোল-গম্বুজাকৃতি ‘মানবিক’
কারাগারের পরিকল্পনা করেন, যেখানে অতি অল্পসংখ্যক কারারক্ষী
অলক্ষে ও অজান্তে বহুসংখ্যক বন্দীর উপরে নজরদারী করতে পারবে।
দণ্ডশাস্ত্রের (penology) ইতিহাসে ‘প্যানোপ্টিকন’ কারাগার বলে
খ্যাত হয়ে আছে বেন্থামের এই পরিকল্পনা, যদিও নানা কারণে
প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করা যায়নি।

সে অন্য গল্প।

জানিনা, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর থেকে বৃটিশ রাজশক্তি ভারতবর্ষের
প্রান্তে প্রান্তে যে ‘ঘন্টাঘর’ বসাতে আরম্ভ করলো, তার
পিছনে বেন্থামের এই প্যানোপ্টিকন কারাগারের ধারণা সুপ্ত ছিল কিনা,
যদিও কোনো জেল-টেল নয়, শহরের এক্কেবার মাঝ-মধ্যিখানের সবচেয়ে
দৃশ্যমান স্থানে উাঁচুতে এই ঘড়িগুলি বসাতো ইংরেজ। এই
ঘড়িঘরগুলিই আমজনতার কথ্যে ঘণ্টাঘর, কারণ ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং
করে সময় ঘোষণা করে বৃটিশরাজ যেন জানান দিতো: এই দেখো বাপু,
আমি আছি, রয়েছি এখানে সদা বিরাজমান। আর উত্তুঙ্গ টাওয়ারের
উপরে বসানো মস্ত ডায়াওয়ালা টারেট ক্লকগুলি যেন ছিল বৃটিশরাজের
সদাজাগ্রত চক্ষু—-রাজা যেন দেখছে, প্রজারা কে কখন ঘুম থেকে উঠে
কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কী খাচ্ছে!

লণ্ডনের ‘বিগ বেন’ যেমন বৃটিশরাজশক্তির প্রতীক, তেমনি বম্বে
ইউনিভার্সিটির রাজাবাঈ টাওয়ার ক্লক থেকে দিল্লির চাাঁদনি চক বা
লক্ষ্মৌ-র ক্লক-টাওয়ার (হুসেইনাবাদ) যেন ভারতে বৃটেনের ‘রাজ-মুখ’
হয়ে দাাঁড়িয়েছিল। অন্ততঃ একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় তো এটি বিশেষ রকম
প্রকট হয়ে পড়ে। সেই গল্পেও আসবো আমরা শেষের দিকে।
***

‘সময়’ অনাদি ও অনন্ত!
সৃষ্টির আদিতমকাল থেকে সে অলক্ষে এগিয়ে চলেছে, যদিও সে ‘ঘড়ি’-র
টিক্টিক্টা শোনা যায়নি।

আজকের মেকানিক্যাল ক্লক ইউরোপে ষোড়শ শতকের আগে আসেনি, –
–স্প্রিং ও পেণ্ডুলাম দেওয়া আরও ‘আধুনিক’ ঘড়ি আসতে তো আরও
দু’শো বছর লেগে গেছে । যদিও সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি বা বালিঘড়ি দিয়ে
সময়কে মাপার প্রয়াস প্রাচীন ব্যাবিলন ও মিশরীয় সভ্যতাতেও
ছিল। কিন্তুশিল্পবিপ্লবের সময় থেকে ফ্যাক্টরিতে ফ্যাক্টরিতে আরও
সূক্ষ্ম সময় রাখার প্রয়োজন পড়ল—সে অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি দিতে
হবে যে! ভারতে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ আসবার পর সারা দেশ জুড়ে একই
সময় রাখার দরকার হয়, যেটা সূর্যঘড়ি দ্বারা সম্ভব নয়।

কারণ, সূর্যঘড়ি্র ছায়া যখন শহর কলিকাতায় সকাল দশটা দেখাবে
বেনারসে তো তখনও সে ছায়া দশে পৌাঁছবে না, আরও পশ্চিমে কানপুরদিল্লিতে আরও পরে পৌাঁছবে। কিন্তু বৃটিশ রেলওয়জের চাই সারা
ভারতব্যাপী এক নিখুাঁত টাইমটেবিল—একটাই সময়।
তাই যন্ত্র-ঘড়ি। তাই ক্লক টাওয়ার। ঘণ্টাঘর!
***

ডিসিপ্লিন ও পাংচুয়ালিটি—নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা এ’দুটি যেন
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এবং ভিক্টোরীয়-যুগের এ’ এক লক্ষণ।
সাহেবীয়ানা বা Britishness-এরই আরেক নাম! বেস্পতিবার রাত ঠিক ন’টা
বাজলে হাওড়া স্টেশন থেকে রয়াল ব্লুরঙের রাজকীয় ইম্পিরিয়াল মেইল
ট্রেন ছেড়ে বেরিয়ে যাবে শনিবারে বোম্বাই বন্দর থেকে লণ্ডনগামী পি
এন্ড ও স্টিম-নেভিগেশন কোম্পানির জাহাজ ধরাতে,— তাতে কোনো
লালমুখো আই সি এস সাহেব বা মস্ত কোনো টি-প্ল্যানটেশনের মালিক
এসে উঠতে পারলেন কিনা তার জন্যে ট্রেন দাাঁড়িয়ে থাকবে না। ১৮৯০-এর
দশক থেকে এই নিয়ম চলে আসছিল। বৃটিশ সময়ানুবর্তিতার এ এক
উদাহরণঃ— তোমার জন্য সিস্টেম বদলাবে না, তোমাকেই সিস্টেমের
মতো করে নিজেকে বদলে নিতে হবে । আর সেই সময়টা কী? ক’টা বাজে
এখন? সেটা দেখবার জন্য ঐ দেখ হাওড়া স্টেশনের ‘বড় ঘড়ি’ বা জিপিওর ক্লক বা সুদূর দাক্ষিণাত্যে সুলতানবাজার (হায়দ্রাবাদ)-ওসেকেন্দ্রাবাদেও বড় বড় ডায়ালক্লক বসানো রয়েছে, যে কাজ শুরুহয়ে
গিয়েছিল আঠেরশ’ ষাটের দশক থেকেই। ছাত্ররা ঘড়ি দেখে সময়ানুবর্তিতা
শিখবে বলে শিবপুরের বি ই কলেজে ক্লক টাওয়ার বসালেন স্যর রাজেন
মুখুজ্যে , তার প্রায় ষাট বছর আগেই বিশ্বাসী ভক্তজন ঠিক ঠিক সময়ে
নমাযে এসে বসবে বলে মহসীন সাহেবের হুগলি ইমামবাড়াতে মস্ত ডায়াল
ক্লক বসে (১৮৬১ খৃ.) , যা আজও নিখুাঁত সময় দিয়ে চলেছে। শৈলশহর
দার্জিলিঙে যেমন, তেমনি আন্দামানের এবার্ডিন বাজারে রয়েছে উাঁচু

টাওয়ারের মাথায় মাথায় এমন সব আইকনিক ডায়াল ক্লক, যেগুলি সেই
সেই শহরের প্রতীক , এবং শহরবাসীর বড় প্রিয়! প্রেসিডেন্সি কলেজ
শীর্ষের ঘড়িটি স্লো চললে বা বন্ধ হয়ে গেলে সংবাদপত্রের শিরোনাম
হয়। হ্যাাঁ, এ’সব ঘড়িই বৃটিশ রাজ জমানায় বসানো, এবং, ঐ যা
বলছিলাম, রাজের মুখ, তার প্রতীক!
***

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ থেকে বিশ্বব্যাপী এই সময়ের রাজনীতি কী
ভাবে বদলাতে লাগল তা নিয়ে ইউ সি এল এ-র অধ্যাপিকা ভানেসা ওগ্ল্
সম্প্রতি অনবদ্য এক কেতাব লিখেছেন। সেই প্রসঙ্গে ‘Whose time
is it?’—প্রশ্নটা এসে পড়েছে ঘুরে ফিরে। শুধু বৃটিশ পার্লামেন্ট বা
আমেরিকান কংগ্রেসে নয়, জার্মান রাইখস্ট্যাগেও ১৮৯১
খৃষ্টাব্দে ‘ইউনিফর্ম টাইম’-এর পক্ষে তুফান তুলেছিলেন নবতিপর
জেনারেল হেলম্যুট মল্টকে। এটা না হলে জার্মানদেশের ইউনিফিকেশন
হয়তো রুকে যেত। যান্ত্রিক ঘড়ি ও তার সময় রাখা নিয়ে তারও অনেক
আগে, খৃ. ১৬৬০-এ যার শুরুয়াৎ স্কটল্যান্ডের প্রথম সেই সংবাদপত্র
Mercurius Caledonius -এ’ শহরের মস্ত কম্যুনিটি ক্লকটিকে নিয়ে
কবিতা লেখা হয়েছে—রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টিতে যে বিশ্বস্ত প্রেমিকার
মতো তন্নিষ্ঠ থাকে—-নাকি এক দৃশ্যমান ঈশ্বরের মতো যে
পারিপার্শ্বিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও থাকে অক্ষয়-অনড়-অব্যয়—-
দিতেই থাকে দিতেই থাকে সঠিক সময়।
মেকানিক্যাল ক্লক ছিল যেন ইউরোপীয়ান আধুনিকতার প্রতীক! নৈলে
মিউটিনির পরে আলিগড়ের মতো স্থানে মুঘল আমলের এক ফৌজি
জয়স্তম্ভ ভেঙে ফেলে বৃটিশ কেন বসাবে এক ক্লক টাওয়ার? আলিগড়
মুসলিম ইউনিভার্সিটির ক্লক টাওয়ার আজও এক দর্শনীয় বস্তুহয়ে
আছে। চমৎকার তার রাজকীয় রূপ।

।।২।।
সঠিক সময়ে প্রার্থনাকারীরা যাতে গীর্জায় চলে আসতে পারে তার জন্যে
তাদের সময় দেখাতে গীর্জার চূড়ায় যান্ত্রিক ঘড়ি বসানোর ধারা
ইউরোপে ষোড়শ শতাব্দী থেকে চলে আসছে। খৃষ্টতন্ত্রের যে কোনো
উপ-বিভাগে (denomination)-ই এটা দেখা যায়। তাই তো কলকাতার
আর্মেনিয়ান চার্চে যেমন তেমনই বাংলার আদিতম পর্তুগীজ ব্যাণ্ডেল
চার্চে (ক্যাথলিক) বা কলকাতারই সুপ্রাচীন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের
চূড়ায় যান্ত্রিক ঘড়ি বসানো আছে, যা আজও সঠিক সময় দিয়ে চলেছে।
সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে বৃটিশ কিন্তুধর্মের সঙ্গে ঘড়ির এই
সংযোগটাকে হঠাতে সক্রিয় হয়েছিল, তাই বৃটিশ ভারতের কোণায়
কোণায়—কোথায় হায়দ্রাবাদ কোথায় গোরক্ষপুর কোথায়
রামপুর/বহরাইচে নগরপালিকা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ঘন্টাঘর দেখা যায়
আজও। লক্ষ্যণীয়, এই এই সব ঘড়িগুলি নগরপালিকা দ্বারা বা,
ব্যক্তিগত উদ্যোগে বসানো হয়েছিল, কোন বিশেষ ধর্মীয় উদ্যোগে
নয়। অবিশ্যি, হুগলি মহসীন ইমামবাড়ায় যেমন, তেমনি গুজরাটেও
বোহরা মুসলমানগণ দর্শনীয় উচ্চস্থানে যন্ত্রঘড়ি লাগিয়েছিলেন।
এনারাও শিয়া ওনারাও শিয়া; লক্ষ্মৌর হুসেনাবাদেও শিয়া-মুসলিমগণই
এই আধুনিকতাকে বরণ করে নিয়েছিলেন চমৎকার ক্লক টাওয়ার বসিয়ে।
কিন্তুবোম্বাইয়ে ১৮৯৮এ’র এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে দিয়ে বৃটিশ
রাজশক্তি-তথা-ঘড়িঘর অভিমুখে নিপীড়িত ভারতীয়ের যে প্রতীকি লড়াই
দেখা দিয়েছিলে সেটি অনন্য! সেটা দিয়েই আজকের গল্প শেষ করব, তবে
তার আগে এই সময়-রাজনীতির সম্পর্কে আরও দু’-কথা বলে নিই।
।। ৩ ।।

পুণের বিখ্যাত ‘ফার্গুসন কলেজ’ যাাঁর নামে , প্রখ্যাত সেই স্কটিশ
অভিজাত স্যার জেমস ফার্গুসন তখন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির গভর্নর।
খৃ. ১৮৮১-র কথা এ’। নাগপুর যাবার পথে তিনি একদিন এক ট্রেন মিস্
করলেন বোম্বাই থেকে—ভিক্টোরিয়া টার্মিনার্স (ভি.টি.)-এর
নির্মাণ তখন সেখানে সমাপ্তির পথে। না, লাটসাহেব আসতে দেরি
করেননি, স্থানীয় টাইমজোনের চক্করে মিস্হয়ে গিয়েছিল ট্রেনটা। সেই
থেকে সারা ভারতব্যাপী একই টাইমজোন করার কথা তাাঁর মাথায় আসে।
মান্দ্রাজ বন্দরের সেন্ট টমাস ক্যাথিড্রাল ব্যাসিলিকা গীর্জায় রক্ষিত
ঘড়িখানির মান্যতা তখন সারা ভারত জুড়ে—যাকে মেনে চলে ভারতের সব
টেলিগ্রাফ আপিস থেকে রেলওয়ে টাইমটেবিল। মনে রাখতে হবে এর আশি
বছর আগে সন ১৮০২ খৃষ্টাব্দে সারাভারত মাপার কাজ এই মান্দ্রাজ
থেকেই শুরু করেছিল ল্যামটন-এভারেস্ট
সাহেবদের ট্রিগোনোমেট্রেকাল সার্ভে, সত্তর বছর পরে যার শেষ
হয়েছিল হিমালয়ের সর্বোচ্চ এভারেস্ট শৃঙ্গে গিয়ে।
তা, লর্ড ফার্গুসন সাহেব তো এক ঝলমলে শীতসকালে ঘোষণা করে
দিলেন যে ঐ ম্যাড্রাস টাইম-ই বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতেও লাগুহৈবে!!
মস্ত শোরগোল পড়ে গেল তখন বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে। প্রখ্যাত
ব্যবহারজীবি স্যর ফিরোজ শাহ্মেহতা তখন বোম্বাই মিউনিসিপ্যাল
কর্পোরেশনের কমিশনার, পরে যিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের
প্রেসিডেন্ট হন (১৮৯০ খৃ.)। টাউন হলে জ্বালাময়ী এক বক্তৃতা দিলেন
স্যার ফিরোজ লাটসাহেবের ঐ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, কারণ এটা
তো বোম্বাইবাসীর ইজ্জতের প্রশ্ন। তাাঁরা কেন মাদ্রাজের টাইম মেনে
চলতে যাবেন? এর পরের বিশ বছর পর্যন্ত স্যার ফিরোজ এই বিরোধিতা
টিকিয়ে রেখেছিলেন যখন সন ১৯০৩-এ’ লণ্ডন-জিএমটি থেকে সাড়ে পাাঁচ

ঘন্টা এগিয়ে ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড টাইম নির্ধারিত করে ফেলেছে বৃটিশ
পার্লামেন্ট, এবং ১৯০৫-এর পয়লা জুলাই থেকে তা লাগুও হয়ে গেছে।
হ্যাাঁ, এর উনিশ দিন পরেই লর্ড কার্জন সাহেব বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করে
ফেলেছিলেন বটে! এ’ নিয়ে বম্বের টাইমস অব্ইণ্ডিয়া তখন এক দীর্ঘ
নিবন্ধও প্রকাশ করেছিল [২৩শে জানুয়ারি ১৯০৬].
এর ফলস্বরূপ এই সিদ্ধান্ত হলো যে বম্বের ক্রফোর্ড মার্কেট ও
ভিক্টোরিয়া গার্ডেনের দুটি শীর্ষঘড়িতে বম্বে-টাইম রাখা হবে, আর
আর সর্বত্র আই.এস.টি মানা হৈবেএএএএ…….
ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম-শিখ-পারসীক মানুষজন প্রাকৃতিক সূর্যচান্দ্রঘড়ি মেনে চলে এসেছে সেই কোন্পুরাকাল থেকে। সূর্যোদয়
হলে হিন্দুর দিন শুরুহয়, চাাঁদের দেখা পেলে মুসলমানের ঈদ উদযাপিত
হয়। ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড টাইম লাগুহবার পর বম্বের সেই হিন্দু-
মুসলিম ভারতীয় বস্ত্রশ্রমিক, সংখ্যায় হাজার পাাঁচেকের কম হবেন
না, জানুয়ারি ১৯০৬-এর বম্বে-তে এক বিশাল ধর্মঘটে সামিল হলেন,
কারণ আই.এস.টি ওাঁদের শ্রমদিবসের দৈর্ঘ্য বারো থেকে বাড়িয়ে
পনেরো ঘন্টা করে দিয়েছে যে,— উপরন্তুহাতে ধরিয়ে দিয়েছে নবাবিষ্কৃত
বিজলী বাতি! দিনের আলো নিভে এলেও কাজ করে চলো—-ঐ তো আলো!
ঘণ্টাঘর ও বৃটিশ শাসকদের খবর্দারির রাজনীতির শিকড় যে আরও
অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত ছিল—-মুনাফা বাড়ানো চাই যে!!
।।৪।।
এবার অন্য গল্পে আসি। স্থান পুনে শহর।

খৃ ১৮৯৭এর বাইশে জুন সারা বিশ্বব্যাপী বৃটিশ সাম্রাজ্যে সাম্রাজ্ঞী
ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহণের হীরক জয়ন্তী পালিত হয়েছিল,
মারাঠা দেশের পুণ্যা নগরীও এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রাচীন এই পুণ্যা
নগরীই আজকের পুনা বা পুনে শহর।
সকাল থেকেই পুনের গভর্নর হাউজে মহা সমারোহে হীরক জয়ন্তীর
অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যাবেলায় ‘প্লেগ কমিশনার’
ওয়াল্টার র্যান্ডের ফিটন গাড়িখানা যখন সেখান থেকে ফিরছে, এক বছর
ত্রিশেকের মারাঠী যুবক ‘গাড়ি আসছে রে!’ বলে চিৎকার করে উঠে
লাফিয়ে ওঠে পা-দানিতে ও অতি নিকট থেকে র্যান্ডের ওপরে গুলি চালায়
পিস্তল দিয়ে। তার ভাই বালকিষেণও তৈরি ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি……এ’
এক দীর্ঘ কাহিনি।
এই চাপেকার ভাই দামোদর ও বালকিষেণ পরাধীন ভারতীয়ের রাগ-দ্বেষহতাশা প্রকাশের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে দাাঁড়ান—এক আইকন! দুর্বল
পরাধীন ভারতবাসীও যে ঘুরে দাাঁড়াতে পারে, দিতে পারে মার—ওাঁরাই প্রথম
সেটা দেখিয়ে দিলেন। মনে রাখতে হবে, ওাঁদের এই প্রতিবাদ ক্ষুদিরামপ্রফুল্ল চাকীর চেয়েও এক দশক আগেকার ঘটনা। ফাাঁসির মঞ্চে
চাপেকার ভাইয়েরাই তাই দিয়েছিলেন আধুনিক ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনের প্রথম আত্মবলিদান (১৮৯৮-৯৯ খৃ.)
কিন্তুকেন এই আই. সি. এস. অফিসার র্যান্ডকে মরতে হলো বিপ্লবীদের
হাতে?
সে বছরই মারাঠাদেশে প্লেগ মহামারীর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়া শুরুহওয়া
থেকে এই র্যান্ডের নেতৃত্বে বৃটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনী প্লেগ যাচাইয়ের
নামে ভারতীয়দের ঘরে ঘরে ঢুকে বেপরোয়া ছানবিন শুরুকরে দেয়। সামান্য
সন্দেহ হলেই তাদের ধরে ধরে আলাদা শিবিরে বন্দী করে রাখা হতো।
বিশেষ করে সৈন্যদের জুতো পরে ধর্মস্থানে ঢুকে যাওয়া ও ঘরের

নারীদের বে আব্রুকরাটা পুনেবাসীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল। যার
প্রতিবাদ বেরিয়ে এসেছিল চাপেকার ভাইদের পিস্তলের মুখে।
এবার পুনে ছেড়ে বোম্বাইতে আসি। যদিও এ’ঘটনা র্যান্ড হত্যার
তিনমাস আগেকার।
৭ই মার্চ ১৮৯৮ সোমবার এক সাাঁজোয়া বাহিনী প্লেগ সার্চ করতে এলে
মাহিমের অধিবাসীরা তাদের পাথর ছুাঁড়ে তাড়ায়। দুদিন পরে মদনপুরার
মুসলিম মহল্লায় সৈন্যবাহিনী নিয়ে পুং ডাক্তাররা মহিলাদেরও সার্চ
করতে এলে প্রতিবাদ চরম রূপ নিলো । জনতার ছোাঁড়া পাথরে এক
ম্যাজিস্ট্রেটের মাথা ফেটে গেলে সে বাহিনীকে গুলি চালনার আদেশ দেয় ও
পাাঁচজন নিরীহ ভারতীয়ের মৃত্যুহয়।
সেদিন ৯ই মার্চ ১৮৯৮ ছিল হোলি উৎসব উপলক্ষ্যে সব কটন মিলে
ছুটি। অচিরাৎ হিন্দুভাইয়েরাও মুসলমানদের প্রতিবাদ আন্দোলনে
যোগ দেন , এবং সেন্ট্রাল জেল ও দমকল অফিসে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষতঃ, ক্রফোর্ড মার্কেটে তুমুল দাঙ্গা হয়, যেটা কিনা ছিল ‘সাদা’-
বোম্বাই এর সীমানা। মানে, এর দক্ষিণে কোলাবা প্রভৃতি অঞ্চল ছিল
ইউরোপীয় অধ্যুষিত, বাকিটা কালো ভারতীয়দের।
চারশো ভারতীয়দের ছত্রভঙ্গ করতে ফৌজের ডাক পড়ে ও তাদের গুলিতে
৮৩ জন মুসলিম ও ২৫ জন হিন্দুভারতীয় মৃত্যুবরণ করে। উপরন্তু, তার
ঠিক পরে পরেই দুপুরবেলা ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেখানেই কোর্ট বসিয়ে
দাঙ্গাকারীদের বিচারসভা শুরুকরে দেয়।
পরের দিন বৃহস্পতিবার কমোডিটি মার্কেট বন্ধ থাকত, অর্থাৎ শস্য,
বীজ প্রভৃতির ব্যাপারীরা আসেননি। তার পরেরদিন এগারোই মার্চ

শুক্রবার রেল, ডক ও বস্ত্র-ব্যবসায়ীরাও স্বতঃস্ফূর্ত হড়তালে সামিল
হয়ে পড়লেন।
লক্ষ করবেন, প্রিয় পাঠক, এটা কিন্তুকোনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
পরবর্তী ঘটনার কথা বলছি না এখানে আমরা। বিংশ শতাব্দী পড়তেই
তখনও দুই বছর বাকী ছিল। এরও সাত বছর পরে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ
করবেন। দেশীয় ইংরেজদের মুখপাত্র বম্বের ‘টাইমস অব্ইন্ডিয়া’ কাগজ
লিখেছিল, ‘এভাবে কমোডিটি মার্কেটে বন্ধ্ডেকে ভারতীয়রা ইংরেজদের
ভাতে মারতে চাইছে।’
বৃটিশ রাজশক্তির প্রতীক ক্রফোর্ড মার্কেট গার্ড দেবার জন্যে
বম্বের গভর্নর নিজের বিশ জন সশস্ত্র বডিগার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মার্কেটের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডগলাস বেনেট ঐ বিল্ডিঙেই থাকতেন। তাাঁর
স্ত্রী সেই রাতেই গুলির শব্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু লাঠি-ভাল্লাধারী
ভারতীয়রা বন্দুক পেলো কোত্থেকে?
পরেরদিন সকালে সারা শহর অবাক হয়ে দেখল কোনো ইংরেজ মরেনি,
কিন্তু ক্রফোর্ড টাওয়ারের মাথার মস্ত ঘড়িটি বুলেটের আঘাতে
ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে।
বিদ্রোহী ভারতীয়রা যেন বৃটিশ প্রভুর চক্ষুকানা করে দিয়েছে!
এই প্রতীকি প্রতিবাদের তুলনা কী?!
বৃটিশ নির্বিচার তথা প্লেগতাড়িত ভারতীয়ের বেদনায়
অকাতর বৃটিশ রাজশক্তির প্রতিভূসেই একচক্ষুদানবের নির্বিবাদী
ভূমিকা যেন সইতে পারেনি কালো ভারতবাসী। তারা তার একচক্ষুকানা
করে দিয়েছে।এটাকে কি ‘ক্লাস স্ট্রাগল’ বলা যাবে, হে প্রিয় পাঠক? বৃটিশ
ধনিকশ্রেণীর উপরেও এ’ছিল এক প্রবল আঘাত, এক প্রতীকী প্রতিবাদ!

শেষে অধ্যাপিকা শ্রীমতি ভেনেসা ওগ্লের লেখনীতে ফিরে আসতে হয় তাইঃ-
— ‘সময়,তুমি কার?’ কার জন্যে এই টাইমকিপিং বা, সময়রক্ষা? কার
সুবিধার জন্যে? সে কি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জন্যে, না
মুষ্টিমেয় ধনিকের জন্যে ও তাদের মুনাফাবৃদ্ধির লক্ষ্যে?
ঐ ঐ শোনো তবুবাজে মস্তশীর্ষঘড়ি—ঢং ঢং ঢং ঢং……ওঠো ছাত্রদল,
পাঠে মন দাও। চলো যাত্রীদল, যন্ত্রশকট প্রস্তুত যে দ্বারে! সময় যে
অক্ষয়-অব্যয়-সদাগতিময়! কোনো ধর্মীয় প্রকরণে বাাঁধতে পারবে কি
তাকে? না। সে বয়ে চলে আপন মনে, আপন স্রোতে। যুগযুগান্তের প্রতীক
তার এই মস্ত ডায়ালঘড়ি, অসীমের প্রতিভূ!
যতই আজ ডিজিটাল ক্লক আনো না কেন, সৌধশীর্ষের ঐ যন্ত্রঘড়ির
টিক্টিক্টিক্টিক্-এর তুলনা পাবে কি কোনো? ও’ যে একটা জাত-কে
নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছে!
ওঠো! জাগো!
টিক্টিক্টিক্টিক্!
এখন ক’টা বাজে?
===সমাপ্ত===

গ্রন্থসূত্রঃ
1. Vanessa Ogle (2015), The Global Transformation of Time, 1870-
1950. Cambridge, MA: Harvard University Press
2. Catanach, Ian. “‘Who are your leaders?’ Plague, The Raj and
the ‘Communities’ in Bombay, 1896–1901.” In Society and
Page 12 of 12
Ideology: Essays in South Asian History presented to Professor K.A.
Ballhatchet, edited by Peter Robb, 196–221. Delhi: Oxford UP,
1993.
3. Chandavarkar, Rajnarayan. Imperial Power and Popular
Politics: Class, Resistance and the State in India, c.1850–
1950. Cambridge: Cambridge UP, 1998.
4. Wikipedia articles

Clock Tower by Dipankar Choudhuri

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *