Scent of a Story

অণুসন্ধান ৮

ফটো

এইটুকু দেয়াল। নামেই ৩ বেহরা মানে BHK. দেওয়ালে ডিজাইনার পেন্ট। আর এক দেওয়ালে ঘড়ি। হাতে তিনটে ছবি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রজত। বাক্সের মধ্যে আরো দশটা বাঁধানো ফটো। রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি,বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র, বাবা মনে করতেন চারদিকে এঁদের ছবি থাকলে এনারা তাঁর উড়ুক্কু খেলাপাগল ছেলেকে চোখে চোখে রাখবেন। দিন, রাত, ঘুমের সময়ও। রজত মাঝে মাঝে ভেবেছে ছবিগুলোর ওপর ঢাকা দিয়ে দেবে। এমন পরীক্ষার গার্ডের মত চেয়ে থাকে।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো? সুদেষ্ণার পরিশীলিত সরগম করা গলার গমকে চমকে উঠে রজত খেয়াল করল এই ছবিগুলোর আর জায়গা হবে না নতুন ফ্ল্যাটে। সে দৌড়য় প্যাকারদের থেকে কার্টুনগুলো বুঝে নিতে। ভয়ে বা সম্ভ্রমে রজতের দৌড় কার্টুনের মতই লাগে।

মাঝে মাঝে একটু খুঁতখুঁত করে মনটা। বাবা মার মুখটাও ভুলে যাবো। শুনে চা ঢালতে ঢালতে সুদেষ্ণা বড় বড় চোখ করে বলে,
-আচ্ছা তোমার ঐ ভূত হয়ে যাওয়া লোকদের ছবি ঝুলিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয় কি করে? আমার তো ভয় লাগে। দরজা খুলে অন্ধকারে ঘরে ঢুকে দেখি অন্ধকারের মধ্যে তোমার দাদু ফিকফিক করে হাসছেন। গা কেমন করে।
রজত ক্ষুণ্ণ হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করার আগেই সুদেষ্ণা শেষ কথাটি বলে দেয়,
-যা যা ছবি লাগবে সব ফটো তোল তারপরে গুগল ফটোতে আপলোড করে দাও। আজকাল আবার কেউ ফটো ছাপায় ? আমাদের ছোটবেলায় ওসব ঝঞ্ঝাট ছিল। ক্লিক করো, রীল শেষ হলে দোকানে ছোটো, ডেভেলপ কর, প্রিন্ট করে এলবাম ভর্তি করো বা এনলার্জ করে ফ্রেমে বাঁধিঁযে দেওয়ালে ঝোলাও। প্রিমিটিভ। বাড়ীগুলো সব যেন মিউজিয়াম।

সব তোলা হয় না। বিয়ের কিছু ফটো, আর বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ি, পাঁচ মামা, নিজের স্কুলের পিকনিকের ফটো, সুদেষ্ণার বিয়ের সম্বন্ধের জন্য তোলা ম্যাট্রিমনির ফটো যা হাতে এল তুলে তুলে জমা হল গুগলে। লকডাউনের সন্ধে। বিরক্তিকর টিভি। সময়গুলো কেটে গেল।

এরপর একদিন সুদেষ্ণা যত এলবাম ছিলো বেচে দিল কাগজওলাকে। আর পুরনো বাঁধানো ফটোগুলো নিয়ে গেল ভাঙা বাসন হারমোনিয়ম, ল্যাপটপ ওলা।
-হ্যাঁ বেশ খানিকটা জন্জাল খালি হল। আলমারিগুলো ভরে উঠলো ডিনার সেট, ইউরোপ থেকে কিনে আনা সুইজারল্যান্ডের গরুর ঘণ্টা, লন্ডনের ববি পুতুল ইত্যাদি দরকারী ফ্যাশনেবল জিনিষে।

দেখতে দেখতে দিন যায় পাঁচ বছরের বিবাহ বার্ষিকী খুব ঘটা করে পালন হল। ফাইভ স্টারে পার্টি, গোয়ায় মানডোভীর বুকে স্টিমারে নাচ গান, কত ঘটনা। সব ছবি উঠে গেল। যত খুশি ছবি। রীল ফুরোয়ই না। আর গুগল আছে। সেখানে সব স্মৃতি মণিকোঠায় সাজানো।

ফিরে এসে রজতের হঠাৎ পেটে ব্যথা। খুব যন্ত্রণা। সারা রাত ঘুম নেই। সকালে এপোলা ক্লিনিকে দৌড়ল সুদেষ্ণা। নামকরা ডাক্তার। রেটিং ৫/৫। তিনি সারা শরীরের ছবি তোলালেন। এক্স রে সোনোগ্রাফি, সিটি কত কি। ছবির প্লেটে ভরে উঠল ঘর। টারমিনাল প্যানক্রিয়াস ক্যানসার। ৩০ দিনের মধ্যে শেষ।

সুদেষ্ণা প্রফেশনাল। আইটি কম্পানীর এইচ আর। লোকে আসে যায়। কম্পানীর যায় আসে না। সেভাবে ব্যাপারটা আত্মীভূত করার চেষ্টা করতে হবে এই ভাবতে ভাবতে শ্মশান থেকে বাড়ী ফিরল। দরজা খুলে ফাঁকা দেয়াল। ঘড়িটা বন্ধ। ব্যাটারী পাল্টানো হয় নি। যাক, দেয়ালে কেউ ফটো থেকে তাকিয়ে নেই ওর দিকে। নিশ্চিন্তে ঘুম দিল। শেষ ১৫ দিন ঘুম হয় নি।

সকাল বেলা কফি একটাই কাপে ঢালছিল সুদেষ্ণা। হঠাৎ তেরে বিনা জিন্দগীমে গান বেজে উঠল ওর ফোনে। রিং টোন রজতের পছন্দ। ওর অফিসের ফোন। অফিসে শোকসভা করবে। তার জন্য একটা বড় ছবি চাই। বাঁধানো ফটো থাকলে ভালো। নৈলে জেপেগ পাঠালে ওরা ব্যবস্থা করে নেবে।

ল্যাপটপটা অনেকদিন পরে খুলে বসল। ওতে ছবি দেখতে সুবিধে। কিন্তু নেট লাগছে না। শেষে ফোনে হটস্পট করতে বাধ্য হল। ক্রোম খুলল। ফোটোয় ক্লিক করেই ওর বুকটা ছাঁত করে উঠলো।

ইয়োর গুগল ফোটো ইস এমপটি।
আবার লগআউট লগ ইন। একই অবস্থা। মেল খুলল। কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যায় যদি। দেখতে দেখতে চোখ এসে আটকালো একটা মেলে। কিছুক্ষণ যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে রইল সুদেষ্ণার। তারপর জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মেলটা পড়ল
-আমরা ফ্রি ফটো সার্ভিস বন্ধ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী একমাসের মধ্যে রেজিস্টার করে পেমেন্ট করুন। না হলে আপনার যাবতীয় ছবি আমরা মুছে দিতে বাধ্য হব।

জিনিষপত্র আসবাব কিউরিও তে ভর্তি সুন্দর ফ্ল্যাট। কোথাও একটাও ছবি নেই। অতীত জীবনটা যেন এক ফুঁ দিয়ে কেউ নিভিয়ে দিয়েছে। যেন কেউ কোনদিন ছিল না। মা না বাবা না রজত না রজতের সংগে ওর কোন উৎসব কোন ভ্রমণ আর রইলোনা। সব নিমেষে তলিয়ে গেল সময়ের অন্ধকার গহ্বরে। রজতকেই কেমন দেখতে মনে করার চেষ্টা করল সুদেষ্ণা। মনে পড়ল না।

ঘর ভর্তি শুধু রজতের এক্স রে সোনো গ্রাফি ওর ফুসফুস হার্ট কিডনী লিভার সব কিছুর ছবি।
রজতের ছবি কোথায়?

( সমাপ্ত )

About Author


বাসুদেব গুপ্ত। বয়স ৭০। অধুনা নিবাস সল্ট লেক কলিকাতা। পেশা কম্পিউটার সফটওয়ার ডিজাইন ও এক্সপোরট। নেশা বাংলা ইংরাজী কবিতা ও গল্প লেখা। দ্বিতীয় প্রেম কুকিং

Scent of a Story

2 thoughts on “Scent of a Story

  • September 15, 2022 at 4:47 pm
    Permalink

    Very nice 👌👌 sir

    Reply
  • September 15, 2022 at 5:40 pm
    Permalink

    নিরেট বাঁধুনি, দারুণ গল্প।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *