Dipankar Choudhuri

।।  দশ না, চতুর্প্রহরণধারিণীঃ– বাকসা চৌধুরীবাড়ির দুর্গোৎসব    ।।

—দীপঙ্কর চৌধুরী

…..তখন দেবতারা বললেন সর্বনাশ, এই মহিষাসুরের সঙ্গে তো কিছুতেই পেরে ওঠা যাচ্ছে না। ব্রহ্মা ওঁকে এমন বর দিয়েছেন যে কোনো অস্ত্রতেই তাঁকে বধ করা যাবে না। তখন তাঁরা গিয়ে ধরলেন বিষ্ণুকে আর মহাদিদেব শিবকে ।  বিষ্ণু আর শিব আর সমস্ত দেবতাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো তেজ—যা দিয়ে  সৃষ্টি হলেন এই দেবী দুর্গা। এই দুর্গা মহাশক্তিরূপিনী, দশটা  হাত তাঁর। বাহন হলেন তাঁর সিংহ

—বাহন কী?

—বাহন? দুর্গার বাহন হলো সিংহ, গণেশের ইঁদুর, লক্ষ্মীর….

—আচ্ছা শশীদাদু, এ’সব কি সত্যি?

—মিথ্যে কী করে বলি রুকুবাবু? মুনিঋষিরা লিখে গেছেন যে!

সত্যজিতের ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবি কে ভুলতে পারে?

 

মস্ত দুর্গামন্দিরে বসে বৃদ্ধ কুমোর  গড়ছেন ঠাকুর আর এক বালক অবাক বিস্ময়ে দেখে চলেছে ক্রমে ক্রমে শিল্পীর তুলিতে  ঠাকুরের নাক-চোখ-কান  ফুটে ওঠা!

**

এই  বালকও দেখতো।

সে-ও ছিল এক ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’! শুকতারা-শিশুসাথী-সন্দেশ পড়া তার মনে সদাই খেলে বেড়ায় হাজার রঙীন কাহিনী!

 

‘সব সত্যি—মা দুর্গা সত্যি, অসুর সত্যি,  হার্পুন ছোঁড়া ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি’—১৯৬০এর দশকের কথা এ’।

মোবাইল আর ইন্টারনেট আর ইউ-টিউব তখন কোথায়? অসুরের বুকে মা-দুর্গার ত্রিশূল বিঁধে রক্ত বেরোতে দেখে দুখী হয় সে বালকের মন।

**

আর এই ২০২০-তেও দেখে এলাম সেই প্রাচীন বাড়িতে ঠাকুর গড়া চলেছে। সেই প্রাচীন ধারা! ‘জন্মাষ্টমী’-র পরের দিন ‘নন্দোৎসব’। সেইদিন হয় ‘কাঠে-ঘা’ অনুষ্ঠান।

সেটা কী? সেটাই তো দুগগা পুজোর শুরুয়াৎ গো, মানে  মূর্তি গড়ার।

 

একচালের প্রতিমা হয় বাকসার চৌধুরী বাড়িতে।

‘একচালা প্রতিমা’ ?

বলছি।

বাঁশের একটাই কাঠামোতে মাঝখানে  মা-দুর্গাকে রেখে তাঁর চারপাশে কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতীকে গড়ে তোলা হয়, অর্থাৎ ছাড়া ছাড়া নয়, একসাথে। মাথায় দেবাদিদেব মহাদেব।

চৌধুরীবাড়ির ঠাকুরের একটা বিশেষত্ব হলো যে কাঠামোর মাথার কাছে দু’পাশে কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণও বিরাজ করেন। থাকে তাঁদেরও একটা একটা মূর্তি। শাক্ত ও বৈষ্ণবমতের মিলন!

 

আগের বছর বিসর্জনের পরে এই একচালা বাঁশের কাঠামোখানি নদী থেকে তুলে এনে রেখে দেওয়া হয় নাটমন্দিরে। সারা বছর ধরে  শুকোয়।

এ’বছর একখানি নধর বংশদন্ড সদ্য ঝাড় থেকে কেটে এনে  নন্দোৎসবের দিনে তার যথাবিহিত পূজা করেন কুলপুরোহিত মশাই। আর এই পুজো করতে করতে মন্ত্রোচ্চারণের  মধ্যেই ঐ বংশদণ্ডটির  তিনটি স্থানে দা দিয়ে তিন বার ঘা দিয়ে দেন উনি। সেই হয়ে গেল ‘কাঠে ঘা’ অনুষ্ঠান।  এবার সেই  বাঁশটি এনে পুরনো কাঠামোর সাথে বেঁধে দেওয়া হবে। তার উপরে খড়-মাটির প্রলেপ দিতে দিতে এগিয়ে চলবে মা দুর্গার মূর্তি গড়ার কাজ।

**

হুগলী নদীর উজানে চন্দননগর-চুঁচুড়া-ব্যান্ডেল।

ত্রিবেণী। ত্রি-বেণী!

তিনটি বেণীর মতো  গঙ্গা, কুন্তী ও সরস্বতী নদী ছড়িয়ে পড়েছিল এ’স্থল থেকেই।  মুক্তবেণী! ‘মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে…’। তবে কুন্তী ও সরস্বতী নদী আজ লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায়। আই টি সি-র ত্রিবেণী টিস্যু ফ্যাক্টরীর নিকটে সরস্বতী নদীর উপরে একটি  ‘নেতাজী সুভাষ সেতু’ অবশ্য আজও রয়েছে।

ত্রিবেণী থেকে আরও  দক্ষিণে নেমে এসে চণ্ডীতলা থানার মধ্যে অবস্থিত  আজকের  বাকসা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সরস্বতী নদীর মজা রূপ দেখলে কে বলবে যে সেকালে পালতোলা পর্তুগীজ জাহাজ সমুদ্র থেকে উজিয়ে আসতো এই নদী বেয়ে, চলে যেত সপ্তগ্রাম!   নোঙর করতো এখানে, যা থেকে Buxa (অর্থঃ  ‘বয়া’) গ্রামের নামটা  এয়েচে। বাকসা। এই বাকসা গ্রামে চৌধুরীরা আছেন প্রায় পৌনে তিন শত বৎসর। এক পূর্বজ রূপনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন মহারাজ নন্দকুমারের সমসাময়িক ও সুহৃদ—যাঁর সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের টক্কর লাগে। ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের’ সময়ে প্রজাহিতার্থে  কাটিয়েছিলেন মস্ত বড়  ‘চৌধুরী পুষ্করিণী’, যা আজও বিরাজমান, যেখানে ঐ যে মহাষষ্ঠীর দিনে কলা-বৌ স্নান করিয়ে ‘আবাহন’ হলো দেবীর!

 

না, তার আগে আছে মহালয়ার পিতৃতর্পণ ——যে অনুষ্ঠান এই পুষ্করিণীতে করলে  গঙ্গাস্নানের অধিক পুণ্যলাভ হয় বলে বিশ্বাস করেন আজকের বংশধরগণ। এ’সবই হলো দুর্গোৎসবের বৃহত্তর অঙ্গ। পুজো তো কেবলমাত্র মৃন্ময়ীর সামনে দীপ নাড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি করা নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে সুদীর্ঘ পরম্পরা এবং নানান আর্থ-সামাজিক দিক।

**

কিছু কিছু ‘অদ্ভুত’ পরম্পরা মিশে আছে এই বাড়ির দুর্গোৎসবের সঙ্গে।  ‘অদ্ভুত’, কারণ দুর্গোৎসবের  প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে এ’বাড়ির পুজোর মিল নেই।

প্রথমেই তো বলতে হয় প্রতিমাটির কথা।

মা দুর্গা এখানে দশভূজা নন, চতুর্ভূজা। বগলা রূপে পূজিতা হন তিনি এখানে।

কালী,তারা,ললিতা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা,  মাতঙ্গী ও কমলা—দশমহাবিদ্যার এই অষ্টম রূপখানি কেন এ’বাড়িতে নেওয়া হয়েছে, কবে থেকে— সেটা জানা যায় না। তবে, মহা ধূমধামে, ছাগবলি সহ এখানে মায়ের পূজা হয়ে আসছে আড়াইশ’ বছরের অধিক কাল ধরে। সম্প্রতি এক গবেষক এক খাজনার রশিদ উদ্ধার করেছেন সিন্দুক  ঘেঁটে যেটা ফার্সি ভাষায় লেখা। পড়বে কে? কলকাতার মৌলানা আজাদ কলেজের অধ্যাপক রহমান সাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে আনা হলো—দুর্গা পূজা করলে সে আমলে এক ট্যাক্সো ভরতে হতো সুবেদারের ঘরে। এটি সেটি। বাকসা গ্রামে ঢুকতে আজও   রয়েছে ‘সুবেদার মোড়’ [ যেখানে জনাই-বাকসার বিখ্যাত মিষ্টি মনোহরা র  অনেক অনেক ময়রা-দোকান অবস্থিত!—সে  অন্য গল্প]

 

**

আরেক ‘অদ্ভুত’ পরম্পরা—ষষ্ঠীর দিন এখানে ‘বোধন’ হয় না দেবীর, হয় ‘আবাহন’ ও ‘অধিবাস’ । কেন? কারণ, শ্রীরামচন্দ্র মা দুর্গার যে ‘অকাল বোধন’ করেছিলেন, সেই ‘অকাল’ তত্ত্বে চৌধুরীদের বিশ্বাস নেই। মায়ের পূজার জন্য সকল কালই শুভ-কাল, কোন কালই ‘অকাল’ নয়।

 

একটি কদলীকাণ্ডে দুটি পক্ক বিল্ব (বেল ফল) , কদলী, মানকচু, হরিদ্রা ,জয়ন্তী, দাড়িম, ধান ও অশোক —এই এই উদ্ভিদ/দ্রব্য/ফল  যুক্ত করা হয় এবার নয়টি দড়ি দিয়ে নয়বার বেঁধে ‘নবপত্রিকা’-র প্রস্তুতি হয়। এরপর হয় ‘বিল্ববরণ’—কাছের এক বেলগাছের নিকট নিয়ে গিয়ে এবার হবে এঁর পূজা। সদর-পুকুরে তারপর  হবে এঁর  স্নান। অতঃপর তাকে  লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিয়ে ‘কলা-বৌ’ হিসেবে গণেশ ঠাকুরের পাশে স্থান দেওয়া হবে পুজোর চারটি দিন। মা দুর্গার পাশে পূজা পাবেন নবপত্রিকাও।

 

**

দুর্গোৎসবের সঙ্গে নানান আর্থ-সামাজিক বিষয় ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে,—ছিল বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে।

যেমন, ঠাকুরগড়া কুমোর, কামার (মস্তবড় খাঁড়াখানি দিয়ে ছাগবলি দিত—যে চকচকে খড়্গখানি আজও যত্ন করে রাখা আছে), সাজ-শিল্পী [পঞ্চমীর দিন ডাকের সাজ পরানো হয় মা-কে], পুরোহিত-ব্রাহ্মণ—এঁরা সকলে বংশপরম্পরায় নিষ্কর জমি ভোগ করে আসতেন—যার বিনিময়ে এই বাৎসরিক উৎসবে তাঁদের নিজ নিজ  ভূমিকাটুকু পালন করে আসেন অতি ভক্তিভরে। যদিও যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে কিছু কিছু অদলবদল এসেছে কিন্তু মূল পরম্পরা অব্যাহত আছে আজও।

**

সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী—এই তিন দিন সকাল-সন্ধ্যা ষোড়শোপাচারে মায়ের পূজা হয়—চামর ব্যজনে, শঙ্খ ঘন্টা, প্রদীপ ও ঢং ঢং  মস্ত কাঁসর বাদ্যের সঙ্গে ,তবে এয়োস্ত্রীদের উলুধ্বনির প্রচলন এখানে নেই। এক দল ঢাকি-ঢুলি এ’সময়ে বাদ্যি বাজিয়ে আসছে বংশ পরম্পরায়। তালও তাদের প্রাচীন, নতুন কিছু নয়। এ’বাড়ির পূজায়, আলোকসজ্জায়, উপাচারে নব্যতার ছোঁয়া একেবারেই নেই, সকলই আদি পরম্পরাগত। দশমীর ভাসান-সন্ধ্যায় এই ঢাক-ঢোল উঠে আসে বাড়ির ছেলেদের কাঁধে।  চমৎকার বাজায় তারা নাচের তালে তালে (সঙ্গে সামান্য সিদ্ধি-পানও চলে কিনা।)

 

অষ্টমী ও নবমীর ঠিক মাঝখানে ‘সন্ধিক্ষণ’-এর পূজা। সেটা  মাঝরাতে পড়লেও ঢাকঢোল সহযোগে সাড়ম্বরে পূজা হয়। এ’সময়ে  ছাগবলি হতো কয়েকবছর আগেও। যেমন নবমীর দিন পরপর চারটি ছাগবলির প্রচলন ছিল , সাথে কুমড়ো আখ ইত্যাদি।

পূজা উপলক্ষ্যে দেশের কোণা কোণা থেকে বংশধরগণ চলে আসেন। সন্ধ্যায় মঞ্চ সাজিয়ে  সঙ্গীত-আবৃত্তি-নাটকের আসর বসে। সে এক মহা আনন্দের অনুষ্ঠান।

 

দশমীর সন্ধ্যায় মায়ের নিরঞ্জন এক বেদনাঘন অনুভূতি।

‘যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে…’

চৌধুরীবাড়ি থেকে মাইলটাক দূরে সরস্বতী নদীঘাটে বিসর্জন হয় দেবীর। এখনও বাঁশের মাচায় কাঁধে চড়িয়ে মা-কে নিয়ে যাবার রীতি!

**

আজকাল ধর্মাচারণের  রাজনীতিকরণের চল এসেছে—চিন্তাভাবনায় তো বটেই। মানে, এহেন ধর্মাচারণ রাজনৈতিকভাবে কতটা ঠিক?! আমার প্রকাশ্য ধর্মাচার অপর কোন ধর্মালম্বীর মনে আঘাত দিলো না তো? [এক কোপে ছাগের বলিদান, না আড়াই পোঁচে  কণ্ঠনালী ছেদন? ]. যদিও বাতুলতা এ’সব, আর কিছু নয়।

 

‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে’—-রামায়ণ পাঠানুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে  “ভারতবর্ষ”   নামক স্মৃতিচারণটি এককালে  স্কুলে পাঠ্য ছিল আমাদের। লেখক ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী সাহেব (১৮৯০-১৯৫১) পাশের ‘বড়তাজপুর’ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন, আমার ঠাকুর্দা যাঁকে ‘দাদা’ ডাকতেন। জনাই স্কুল ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় অকাতর দান ছিল তাঁর। এককালে এই চৌধুরীবাড়ির দুর্গাপুজার নিয়মিত অতিথি ছিলেন উনি। গম্ভীর মানুষ, কিন্তু অসাধারণ রসবোধ ছিল—ছোট ছোট মন্তব্যে প্রকাশ পেত।

ওঁর পুত্র প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার আহমেদ আলী সাহেবকে আমরাও ছোটবেলা পুজোর অনুষ্ঠানে আসতে দেখেছি—তাঁর কন্যা নাফিসা তখন ভারত-চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু।

**

দুর্গা পুজা এক মহা পর্ব! আনন্দের। প্রাণের।

বেঁচে থাকুক দুর্গাপুজার আনন্দানুষ্ঠান।

প্রতি বছর যাই, যাবো এই বাকসা চৌধুরীবাড়ির দুর্গাপুজার অনুষ্ঠানে।

জয় মা!

===সমাপ্ত===

Dipankar Choudhuri

3 thoughts on “Dipankar Choudhuri

  • Pingback:Druga Puja – Ganga Zuari Academy

  • October 1, 2021 at 5:16 pm
    Permalink

    Khub valo laglo apnar lekha ta, anek kichu jante parlam. Ei rokom social-history vishon proyojon aajker ei sarbonasa religious-history er yuge. Namaskar janben. Aaro rochona porbar ichhe niye sesh korlam.

    Reply
  • October 27, 2021 at 8:08 pm
    Permalink

    দুর্দান্ত বর্ণনা!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *