Tie – Ghalib Lekhniwal

টাই

কলমে : গালিব লেখনিয়াল

সেটা 2000 এর প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়। তখনো ক‍্যামেরাওয়ালা মোবাইল মুড়ি-মুড়কির মতো লোকের হাতে আসে নি, সে বস্তু তখনও নভেলটি আইটেম। কোন ঝাঁ-চকচকে জায়গায় গিয়ে (শপিং মল, এয়ার পোর্ট, রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারা হোটেল, টুরিস্ট স্পট ইত‍্যাদি) সেলফি তুলে রাজ‍্যের লোককে জানানোর বিলাসিতা যে I also have arrived – তখনও অনেকেরই আয়ত্তের বাইরে।

সেই সময়ে হায়দ্রাবাদে তৈরী হয়েছিল নতুন এয়ার পোর্ট – একদম ঝাঁ চকচকে। GMR গ্রুপ তখন তুঙ্গে। ওদের বেস হায়দ্রাবাদে। ওরা তখন সারা দুনিয়া জুড়ে এয়ার পোর্ট বানাচ্ছে। ইস্তাম্বুল ইত‍্যাদি আরও কত জায়গায়। ওরাই তৈরী করল হায়দ্রাবাদের এয়ার পোর্ট। কুয়ালালামপুরের ধাঁচে, অতি অতি আধুনিক। দিল্লী T 3, মুম্বাই, ব‍্যঙ্গালোর তখনো আসে নি। লোকেদের দেখে তাক লেগে গেলো। এয়ারপোর্ট চৌহদ্দির অনেকটা দূর থেকে আনডিউলেটেড ল‍্যান্ডস্কেপিং, বিশাল এয়ারপোর্ট বিল্ডিং এ সবই কাঁচের দেয়াল, অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রিমীয়াম রিটেইল আউটলেটস, হাই স্ট্রিট শপিং এর মতো। সে এক এলাহি ব‍্যাপার। তখনো পাইকারী দরে প্রোপাগান্ডার যুগ শুরু হয় নি। লোকেরা নিজের চিন্তা ভাবনার অভিমুখ মতো মত প্রকাশ করতো। তাই তাক লাগানোর বাহাদুরি থাকা সত্বেও এই এয়ারপোর্ট দেখে ফৈজ-পন্থিরা বলল, এক শাহনশাহ নে দৌলতো কা সাহারা লেকর হম গরীবোঁকা উড়ায়া হ‍্যায় মজাক। একদল বলল – Picnic atop a volcano। আরও সব নানা ধরণের কথাবার্তা। তবে কেউই বলল না যে মেরা দেশ বদল রহা হ‍্যায়। কারণ প্রোপাগান্ডা ছিল না। অথবা হয়তো এরকম তাজমহল মার্কা বদল চায় নি বেশীর ভাগ লোক।

এখানকার আর একটা বিশেষ আকর্ষন ছিল একটা সেলফি-পয়েন্ট। এয়ারপোর্টের একটা জায়গায় একটা ফটো তোলার স্পট মতো বানানো ছিল, সাথে ক‍্যামেরার বন্দোবস্ত। কেউ সেই স্পটে দাঁড়ালে এয়ারপোর্টের ব‍্যাকগ্রাউন্ডে তার ছবি অটোমেটিক তোলা হয়ে যেতো। সেখানে নিজের মোবাইল নম্বর ফিড করার একটা ব‍্যবস্থা ছিল। সেই নম্বর দিলে সেই সেলফি ধরনের ছবি নিজের মোবাইলে আপনা আপনিই চলে আসত। সে একটা উদ্দীপনাময় ব‍্যাপার। যত লোক ছবি তুলতো তার পাঁচ গূণ লোক পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনার পর্যায়ক্রমগুলো দেখতো, বোঝার চেষ্টা করতো যে ঘটনাটা কি চলছে।

কূমার আজ দিল্লী যাচ্ছে, অফিসের মিটিং -এ।এয়ারপোর্টে একটু আগেই পৌঁছে গেছে। হাতে বেশ কিছুটা সময় দেখে ও রিটেইল স্পেসের দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। জামা-কাপড়, পারফিউম, মেয়েদের হ‍্যান্ডব‍্যাগ আরও নানান জিনিস। সব দোকানেই প্রচুর আলোর ব‍্যবস্থা, ক্রেতাদের চোখ আর বুদ্ধিসুদ্ধি ধাঁধিয়ে দেবার জন‍্য। কুমার মনে মনে ভাবলো – vulger display of glitter. যদি ছাদ না থাকত তবে কি এটা রাত্তিরে স্পেসশিপ থেকে খালি চোখে দেখা যেতো ? যেমন লাস ভেগাসকে দেখা যায়, লোকে বলে !

কুমার এ দোকান সে দোকান ঘুরে, ভালো লাগা জিনিস উল্টে পাল্টে দেখে, তাদের প্রাইস ট‍্যাগে চোখ বুলোতে লাগলো। মার্কেট ইন্টালিজেন্স, মাথায় মধ‍্যে ডাটা ঢুকিয়ে রাখা, পরে সত‍‍্যিকারের কেনার সময়ে কাজে লাগে। এটা কুমারের একটা পছন্দের কাজ। ছুটির দিনে বা কাজের সময়ের বাইরে ও এখানে সেখানে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, নানান জিনিস দেখে বেরায়। কোন বাছ-বিচারের বাইরে সেই লম্বা পরিধি। মির্জা গালিবের গলির পরোটা থেকে গুড়গাঁও গ্রান্ভের গুরমে কুইজিন, মোরালাটো ঘড়ি থেকে জেনুইন ফেক ওমেগা সবখানেই অবাধ গতি।

ঘুরতে ঘুরতে নজরে এলো এক টাই-য়ের দোকান। লাইন করে টাই ঝুলিয়ে রেখেছে। খালি টাইয়েরই দোকান, সাথে অন‍্য কিছূ বিক্রির জন‍্য নেই – এটা আগে দেখে নি। এত বেশী টাই যে দেয়াল পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। কুমার হিসেব করে দেখলো প্রায় হাজার দুই টাই হবে। কোনোটা পেইসলে ডিজাইন, কোনোটা ফ্লোরাল, কোনোটা জিয়োমেট্রিক, কোনোটা স্ট্রাকচারড।

কুমার স্কুল জীবনের শেষের দিকে বাবাকে হারায়। তারপর সংসারের চাকা পাঁকের মূখে পড়ে। উপার্জন নেই, খাওয়া পড়ারই বেশ টানাটানি। শখ সাধ মেটানো সাধ‍্যের বাইরে। একটা তথাকথিত ভালো প‍্যান্টে চার বছর ধরে চালানো। পড়া শেষ করে এক ইন্টারভিউ দিতে এসে খোলা রাস্তার ধারে পরনের সাধারণ প‍্যান্ট পাল্টে সেই চার বছরের পুরোনো একমাত্র ‘ভালো’ প‍্যান্ট পড়ে ইন্টালভিউ দিতে যাওয়া – সেসব এখনও জ্বলপ্ত স্মৃতি।

তবে ভগবান তো মানুষকে তৈরী করেছেন ক্রমাগত খুশী হতে, হারকে বারবার পরাস্ত করে এগিয়ে যেতে। তাই খোলা রাস্তায় প‍্যান্ট পাল্টানোটা কুমারের কাছে এখন শুধুই এক স্মৃতি – দুঃস্বপ্ন নয়। যখন সেটা ঘটছে তখনও সেটা কুমারের মনে কোন মলিনতা আনে নি। এটা একটা রাস্তার ঢিবি যেটা টপকে এগিয়ে যেতে হবে। আজ মহার্ঘ‍্য টাই-এর বন্দীশালায় দাঁড়িয়ে কুমারের সেই খোলা রাস্তার কথা মনে পড়লো। ভগবানের করুণা বর্ষণের জন‍্য কৃতজ্ঞ বোধ করলো ও। পেছনের পঁচিশ বছরের লম্বা চলার পথে অনেকটা রাস্তাতেই ভগবান ওর হাত ধরে থেকেছেন। তাই ভালো দেখার চোখটা বা ভালো খোঁজার মনটা এখনও তরতরিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখন কুমারের ড্রেস সেন্সের খ‍্যাতি ওর বন্ধুমহলে। অফিসে ওর তকমা বেষ্ট ড্রেসড ম‍্যান। খবরের কাগজে রিচার্ড গেয়ারের ছবি (best dressed Man of the year) দেখে ওর ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলের মন্তব‍্য – তুমি তো এর থেকে ভাল ড্রেস করো ! যাত্রাপথের এই উত্তরণ তো ভগবানেরি দান।

কূমার এখন সেই দোকানে একা। শূরুর দিকে ও কয়েকটা টাই ঘুরিয়ে সেগুলোর ব্রান্ড আর প্রাইস ট‍্যাগ দেখলো। তারপর চোখটাকেই চালাতে থাকলো এমাথা থেকে ওমাথা।

বেশ খানিকক্ষণ ধরে দেখে টেখে শেষে একটার ওপর ওর নজর আটকালো। গ্রে টোনের বেস কালার। তার ভেতর ব্লাড রেড জিয়োমেট্রিকাল মোটিফ। পুরোটাই স্ট্রাকচার্ড। সিল্ক। খুব আন্ডারস্টেটেড এলিগ‍্যান্স। একটা চিরন্তনী আকর্ষণের দ‍্যোতনা আছে। পেছন দিকের দেয়ালে একটু উচুতে টাঙ্গানো আছে। টাইটা উল্টে ব্রান্ড বা প্রাইস ট‍্যাগ দেখা যাচ্ছে না। যদিও কুমার এখন ওটা কিনবে না, তবূও দোকানের সেলসম‍্যানের কাছে ও দাম জিজ্ঞেস করল।

দোকানে তখনো একা কুমারই দাঁড়িয়ে। সেলসম‍্যানের পুরো মনোযোগটা কুমারেরই দিকে। কুমারের প্রশ্ন শুনে তিনি ধীর পায়ে কুমারের দিকে এগিয়ে গেলেন। মুখে এক রহস‍্যময় হাসি। বললেন, স‍্যার, আমাদের এতগুলো টাইয়ের ভেতর মাত্র একটা টাই”ই ইটালিয়ান, ম‍্যানজোxxর। সেরকম আর নেই আমাদের ডিসপ্লেতে। দামটাও অনেকটাই বেশী বাকিগুলোর চেয়ে। কিন্তু ব্রানডের নাম বা প্রাইস ট‍্যাগ তো দেখা যাচ্ছে না ডিসপ্লে থেকে। তা সত্বেও আপনি সবচেয়ে দামী টাইটা চিনে ফেললেন দৃর থেকে আর খালি চোখে দেখে। ধন‍্য আপনার নজর !

কূমার আরেক বার ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করলো।

(সমাপ্ত)

কলমে : গালিব লেখনিয়াল

লেখক পরিচিতি :
গালিব লেখনিয়াল একজন গঙ্গা-জুয়ারি অ‍্যাকাডেমির সদস‍্য – ছদ্ম নামে। তিনি এখন গোয়াতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।

Tie – Ghalib Lekhniwal

17 thoughts on “Tie – Ghalib Lekhniwal

  • September 15, 2022 at 4:28 pm
    Permalink

    অনবদ্য। লেখায় মুজতবা আলী/ সত্যজিত রায় স্টাহল এর হালকা ছোয়া দেখছি। এক টানটান ছোট গল্পের মাঝে কিছু স্বল্প জানা তথ্যের ঠাসবুনান । এগিয়ে চলো লেখক ।
    – সমীর কুমার দাশ।

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:10 pm
      Permalink

      অনেক ধন‍্যবাদ।
      উৎসাহ পেলাম।
      – গালিব লেখনিয়াল

      Reply
  • September 15, 2022 at 6:06 pm
    Permalink

    খুব…খুব ভাল লেখা।

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:12 pm
      Permalink

      গুণীজনের প্রশংসা -বাক‍্য এক সুখদায়ক অনুভূতি।
      ধন‍্যবাদ।

      Reply
  • September 16, 2022 at 8:45 am
    Permalink

    লেখার স্টাইলটা ইটালিয়ান ম্যানজো টাই-এর মতোই এলিগেন্ট।

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:14 pm
      Permalink

      কভল-হীরের পাথরের দ‍্যুতির মতো ?
      ধন‍্যবাদ।

      Reply
  • September 16, 2022 at 10:51 am
    Permalink

    Good.
    – Ranjit Adhikari

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:15 pm
      Permalink

      Thank you.
      – Ghalib Lekhniwak

      Reply
  • September 16, 2022 at 11:36 am
    Permalink

    বাহ্ , খুব ভালো লাগলো। ঝরঝরে বাংলায় কাব্যরসে সিক্ত স্মৃতির ঝলক। অসাধারণ।
    – সলিল পঞ্চানন

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:19 pm
      Permalink

      ধন‍্যবাদ।
      প্রশংসা -বাক‍্যেরা সর্বদাই বলবর্দ্ধক।
      – গালিব লেখনিয়াল

      Reply
  • September 16, 2022 at 12:42 pm
    Permalink

    লেখা পড়ে ভালো লাগলো।

    – অশোক ঘোষ

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:21 pm
      Permalink

      ধন‍্যবাদ।
      পাঠকের ভাললাগাতে লেখকও খুশী ।

      Reply
  • September 16, 2022 at 1:11 pm
    Permalink

    Khoob mazadar lekha. Show biz er jamana. Tai sales person ra ektu over smart hoye Jay kono samay. Customers der ektu over assessment kore ebong pare bujte pare. Reality of life. None can deny.

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:23 pm
      Permalink

      Nice that it amused you. Thank you for your nice words.
      – Ghalib Lekhniwal

      Reply
  • September 16, 2022 at 1:20 pm
    Permalink

    তথ‍্যসমৃদ্ধ একটি ঝকঝকে লেখা। খুব ভালো লাগলো।

    মৃগাঙ্ক বসাক।

    Reply
    • September 19, 2022 at 5:29 pm
      Permalink

      পাঠকদের ভালো লাগাতে লেখকও খুশী।
      ধন‍্যবাদ।

      Reply
  • September 19, 2022 at 5:08 pm
    Permalink

    Thank you.
    It would have been nice if GZA could know the senders.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *